ষাট দশকের ছাত্র-আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ

মুহাম্মদ তাহের আলমদার | মঙ্গলবার , ২১ নভেম্বর, ২০২৩ at ৭:২৫ পূর্বাহ্ণ

পূর্ব প্রকাশিতের পর

মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর থেকে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শোনার জন্য মুক্তিকামী জনতা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকতো। বিপ্লবী বেতারের সব অনুষ্ঠানই ছিল জনপ্রিয়; বিশেষ করে ব্যাঙ্গকৌতুক মিশ্রিত এম আর আখতার মুকুল পরিবেশিত চরমপত্রও জল্লাদেরদরবার ছিল ভীষণ জনপ্রিয়। বিবিসির খবরও শোনা হতো নিয়মিত। রাত্রিবেলায় চায়ের দোকানসহ যেখানে রেডিও পেতাম, সেখানেই বসে অনুষ্ঠান শুনতাম এবং পাড়াপড়শী যুবসমাজদের এসমস্ত অনুষ্ঠান শোনার জন্য উৎসাহিত করতাম।

মুক্তিযুদ্ধের এই ধারাবাহিকতায় সারাদেশ বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যায়। অন্যদিনের মতো আমি ভোর সকালে চট্টগ্রাম শহরের খাতুনগঞ্জ থেকে আন্দরকিল্লায় আসি। চারদিকে খবর ছড়িয়ে পড়লো, আজ ১৬ই ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করবে। জনগণ স্বাধীনতার আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠে। দিকেদিকে আনন্দের জয়ধ্বনি। জনতা সেই মুহূর্তটির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, কখন আত্মসমর্পণ হবে।

এভাবে অপেক্ষার ক্ষণ গড়িয়ে বিকেল চারটা একত্রিশ মিনিটে রমনা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যৌথ কমান্ডের পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং পাকিস্তানী বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন। যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয় সম্পন্ন হলো।

মিত্রবাহিনীর অংশ হিসেবে মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী যৌথভাবে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান সফল করে। এখানে জেনে রাখা প্রয়োজন, পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ ছিল মিত্র বাহিনীর কাছে; এককভাবে ভারতীয় বাহিনীর কাছে নয়। যদি আত্মসমর্পণ এককভাবে ভারতীয় বাহিনীর কাছে হতো, তাহলে ভারতের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল শ্যাম মানেকশ উপস্থিত থাকতেন এবং প্রটোকল অনুযায়ী আমাদের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানীও উপস্থিত থাকতেন। (জাফর ইমাম বীর বিক্রম এর প্রতিবেদন হতে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী)

বাঙালির মুক্তি সংগ্রাম ও স্বাধীনতার বিজয়ের আনন্দঘন উল্লাসধ্বনিতে সেদিন আমাদের চারদিকে জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু ধ্বনিতে মুখরিত হয়। চট্টগ্রাম শহরের অলিগলি, সড়কজুড়ে সর্বত্র গণমানুষের বিজয় মিছিল চলছে। হাতে বিজয়ের পতাকা ও স্লোগানেস্লোগানে সারানগরী প্রকম্পিত। পুরোটা সময়জুড়ে এসব বিজয়োল্লাস ও মিছিলেই সময় কাটে আমার। সন্ধ্যার দিকে নিজ এলাকা পাটিয়া সদরে আসি। দেখি, স্বাধীনতার বিজয় মিছিলে পটিয়ার সর্বত্র আনন্দের জোয়ার বয়ে চলেছে।

কী অভূতপূর্ব দৃশ্য! এদিকে ভারতফেরত বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের একটি বিশেষ গ্রুপ পটিয়া জমিরিয়া মাদরাসায় অবস্থানগ্রহণ করেন। উল্লেখ থাকে যে, পটিয়া জামিরিয়া মাদরাসায় মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপটি প্রায় তিনমাস অবস্থান করেছিল।

মহান মুক্তিযুদ্ধের নয়মাসের এই ধারাবাহিকতায় ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ বহু আরাধ্য, প্রিয় স্বাধীনতা অর্জিত হলেও মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল তালিকা হয়নি দেশ স্বাধীনের এতো বছর পরও। এখনো মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে চলছে বিতর্ক। গত ২০১৯ সালের পহেলা ডিসেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিগত সরকারের আমলসহ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নরকম সংখ্যা দেওয়া হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের। ১৯৮২ সালে সামরিক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে এইচ এম এরশাদ মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও প্রধান পৃষ্ঠপোষক থাকাকালে সারাদেশে ১লাখ ৩/৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার তালিকা করা হয়। তবে এ তালিকা নিয়ে সবমহলে বিতর্ক ও সমালোচনা হওয়ার পরে এ প্রক্রিয়া অনেকটা চাপা পড়ে যায়।

পূর্বে স্বাধীনতা পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে জেনারেল এম এ জি ওসমানীর সিল ও স্বাক্ষরযুক্ত বেশকিছু সার্টিফিকেট মুক্তিযোদ্ধা দাবিদারদের দেওয়া হলেও পরে এ সার্টিফিকেট বাজারে বিক্রি হতে থাকে এবং তৈরী হয় নানা বিতর্ক। এসব কারণে মুক্তিযোদ্ধার সঠিক তালিকা প্রণয়নে সুফল পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ প্রতিদিনের এ সময়কার প্রতিবেদনে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তখনকার সচিব এস.এম আরিফ উর রহমান বলেছিলেন, ‘তালিকা তো চলমান। এটা বন্ধ হওয়ার সুযোগ নেই’।এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী পুনরায় যাচাইবাছাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে চূড়ান্ত তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কোনো মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না হতে পারলে পরবর্তীতে আপিল ফরম পূরণের মাধ্যমে তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সুযোগ রাখা হয়। এই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযোদ্ধা যাচাইবাছাই নির্দেশিকা, ২০১৬র বিধান মতে পটিয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাইবাছাই কমিটির নির্দেশিত তারিখে উপজেলা অফিসে আমারও উপস্থিত হওয়ার কথা ছিল।

সদ্য আমার হার্ট অপারেশনজনিত কারণে যাচাইবাছাই কমিটির সম্মুখে সরাসরি সবকিছু উপস্থাপন করা জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ছিল বিধায় পটিয়া সদরে সম্মানিত আইনী পরিবারের ভারত ফেরত এক বিশ্বস্ত পরিচিত জনৈক মুক্তিযোদ্ধা, আমার সহযোগিতায় এগিয়ে আসে। যাচাইবাছাই এর তারিখে আমিও সেখানে ছিলাম। কমিটির সিনিয়র ২/১ জনের সাথে আমার দলিলপত্রসহ কথা বলে আমাকে সে আশ্বস্ত করে। পরে জানতে পারি, যাচাইবাছাই কমিটি কর্তৃক মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। একটা কথা আছে যে, ‘আশ্বাসে বিশ্বাস, বিশ্বাসে সর্বনাশ’।

পরবর্তীতে পুনরায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বরাবরে আপিল দায়েরের জন্য বলা হলে পটিয়া সদরস্থ তার বাড়িতে যাই এবং তার দেওয়া ২৯৬৬৭ ক্রমিক নং সম্বলিত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের সিলসহ আপিল দায়েরের এই ফরমে ১৫১০২০১৭ তারিখে আপিলের জন্য ফরম পূরণ করি। কথা ছিল, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল ঢাকার বরাবরে আপিল আবেদনের ফরমটি পাঠিয়ে দেয়া হবে। সেই থেকে ২/৩ বছর অপেক্ষার পরেও আপিল দায়ের সংক্রান্ত কোনো ইতিবাচক তথ্য পাওয়া যায়নি।

যা হোক, এ লেখার সমাপ্তি পর্যায়ে বিশেষভাবে গর্বের সাথে উল্লেখ করতে হয় আমার ষাটসত্তর দশকের টানা আন্দোলনসংগ্রামের কথা। সত্তরের দশকে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও স্বাধীনতা বিনির্মাণের কাজটি শুরু হয় মূলত ষাটের দশকে। যে কারণে বলা হয়, ‘ষাটের দশকের ইতিহাস হলো স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস। এ দশককে বাদ দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের কথা কল্পনা করাও কঠিন। ষাটের দশকজুড়ে এ দেশে যে আন্দোলন সংগ্রাম চলেছে, তারই অনিবার্য পরিণতি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ’। যদি তাই হয়, তাহলে সেই দশকে যারা স্বাধীকার অর্জনের সংগ্রামে দশকজুড়ে রাজপথে ত্যাগ স্বীকার করেছেন, শহীদ হয়েছেন, রাজপথই ছিলো যাদের ঠিকানা, স্বাধীনতা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যথোপযুক্ত মর্যাদায় তাঁদের অভিষিক্ত করা উচিত।

যুদ্ধ হঠাৎ করে শুরু হয় না। ‘পলিটিক্স অরিজিনেটস ওয়্যার’, ‘রাজনীতি থেকেই সব যুদ্ধের উৎপত্তি’ এবং ‘রাজনীতির প্রক্রিয়াতেই সব যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে’। আমাদের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ ছিল ষাটের দশকের এবং তারও পূর্বেকার রাজনীতিরই অনিবার্য ফসল। ষাটের দশকে ধাপেধাপে এগিয়ে যাওয়া ছাত্রআন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়কে ইতিহাসের অঙ্গীভূত করা এবং প্রতিটি পর্যায়ে যার যা অবদান, তা যথাযথভাবে প্রতিফলিত করা উচিত। ষাটের দশকজুড়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সেদিন যারা সক্রিয় ছিলেন, তাদের অনেকেই এখনও বেঁচে আছেন। তাদের সম্মিলিত প্রয়াসেই কেবল আমাদের মহান স্বাধীনতাকে ‘নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের বন্দিদশা থেকে মুক্ত করা সম্ভব’। তাই বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলাউপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে আমাদের সুসংগঠিত ও সম্মিলিত প্রচেষ্টা নেওয়ার এখনই সময়।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস লিখতে বসলে যেমন নয়মাসের প্রতি পরত হতে বাদ দেওয়া যাবে না কোনো বিষয়, ঠিক তেমনই স্বাধীন বাংলার ভিত রচনা করতে ত্যাগদানকারী ৬০র দশকের আন্দোলনকারীদের ইতিহাস লিখনব্যতীত মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ও পরিপূর্ণ ইতিহাস রচনা অসম্ভব। বৃক্ষের ফল যদি আসে ৭১র ডিসেম্বরে, তবে সে বৃক্ষকে পরিচর্যা করা হয়েছে এই ৬০র দশকেই, ধারাবাহিক বিভিন্ন আন্দোলনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে। সমাপ্ত।

লেখক : ষাট দশকের ছাত্রনেতা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অগ্রগতির কাজে অংশ নিতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রতিকূলতা ডিঙিয়ে আলোকের ঝরনাধারায় আমাদের বাংলাদেশ