সাধারণত আমি যখন অলস সময় কাটাই তখন শ্রম আইন ও শ্রম বিধিমালা নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করার চেষ্টা করি। এর মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে, শ্রম আইন ও বিধিমালার ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অসামঞ্জস্যতা খুঁজে বের করা এবং উক্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি ও অসামঞ্জস্যতাগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচরে আনা।
তেমনি এক অলস সময়ে কিছুদিন আগে শ্রম আইনের ৫৯(খ) ধারা পড়তে গিয়ে হঠাৎ হোঁচট খেলাম। উক্ত ধারায় উল্লেখ আছে প্রত্যেক কারখানায় নারী এবং পুরুষ শ্রমিকদের জন্য পৃথক শৌচাগারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। খুবই যৌক্তিক এবং প্রয়োজনীয় একটি ধারা। তাহলে আমার হোঁচট খাওয়ার হেতু কী? শ্রম আইনের এই ধারাটি পড়ার সাথে সাথেই আমার মনের মধ্যে একটি নতুন ভাবনা উদয় হলো। আমি জানিনা আমার এ ভাবনা কতটুকু বাস্তব সম্মত বা আদৌ যৌক্তিক কিনা?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ শাহিন চৌধুরির সাথে আমার প্রায়শঃ শ্রম আইন ও বিধিমালা নিয়ে আলোচনা হয়। তাঁর একটি কথা আমার খুব মনঃপূত হয়েছে। সেটি হলো, শ্রম আইন এবং বিধিমালা সম্পর্কে যে কোনো ধরণের ধোঁয়াশা বা প্রশ্ন যাই তৈরি হোক না কেন সেটাকে আমলে নিতে হবে। হোক সেটা অবাস্তব, অপ্রয়োজনীয় কিংবা হাস্যকর। তাছাড়া কোনো নতুন ভাবনা কিংবা প্রশ্ন তৈরি হলে তার একটি বাস্তব ভিত্তি অবশ্যই থাকে। সময়ের সাথে সাথে সেটা হয়তো ক্রমশঃ প্রস্ফুটিত হয় এবং পরে তা বাস্তব ভিত্তি পায়।
এবার আমার ভাবনার বিষয়ে আসি, আমার ভাবনার বিষয়টি ছিল- প্রকৃত অর্থে লিঙ্গ ভেদে মানুষ কয় ভাগে বিভক্ত? মানুষ কি কেবলই নারী এবং পুরুষ তথা দুই ভাগে বিভক্ত? তাহলে আমরা যাদেরকে হিজড়া বলে অভিহিত করি তারা কী? কী তাদের লিংগ পরিচয়? অনেকে হয়তো বলবেন, যে সকল হিজড়ার শারীরিক গঠন বেশীর ভাগ পুরুষের মত তারা পুরুষ আর যাদের শারীরিক গঠন বেশীরভাগ নারীর মতন তাদের নারী বলা যেতে পারে। এভাবে সমস্যার সমাধান ভেবে নিজে নিজে আত্মতৃপ্তিও পেতে পারেন।
কিন্তু বিষয়টা অতটা সরল এবং সহজ নয়। সে ধরনের কোনো সমাধানের পথ যদি আমরা খুঁজি সেটা কখনোই প্রকৃত সমাধান হবে না। বরং এ ধরনের জগাখিচুড়ি মার্কা সমাধানের মাধ্যমে প্রকৃত সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া হবে বলেই আমি মনে করি। হিজড়ারা মানুষ তবে পুর্ণাঙ্গ নারী বা পুরুষ কোনোটাই নয়। তাই তাদেরকে বর্তমান বিশ্বে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবেই অভিহিত করা হয়ে থাকে। সেটাই হিজড়াদের যথার্থ লিঙ্গ পরিচয় বলে আমি মনে করি। তাই শ্রম আইন এবং বিধিমালায় যে সকল অধ্যায়ে লিঙ্গ ভিত্তিক ধারা বা বিধি আছে সেগুলি আরো বিস্তারিত পর্যালোচনা করতে হবে। অতঃপর লিঙ্গ ভিত্তিক শ্রম আইনের ধারা গুলোতে হিজড়া তথা তৃতীয় লিঙ্গের শ্রমিকদের জন্য পৃথক ভাবে তাদের উপযোগী করে সুনির্দিষ্ট ধারা বা অনুচ্ছেদ যুক্ত করার প্রয়োজন রয়েছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শ্রম আইন ও বিধিমালায় লিঙ্গ ভিত্তিক ধারা বা বিধি সমূহ কী? আগেই উল্লেখ করেছি ধারা ৫৯(খ) এর ব্যাপারে। এ ধারাটির সাথে সংশ্লিষ্ট বিধি ৫১ এবং বিধিমালার তফসিল-২ তে উল্লেখ আছে, মহিলা শ্রমিকের ক্ষেত্রে প্রথম ১০০ জন পর্যন্ত প্রতি ২৫ জনের জন্য ১টি করে এবং পরবর্তী প্রতি ৫০ জনের জন্য একটি করে শৌচাগার ব্যবস্থা থাকতে হবে। আবার পুরুষ শ্রমিকের ক্ষেত্রে প্রথম ১০০ জন পর্যন্ত প্রতি ৪০ জনের জন্য একটি করে পরবর্তী প্রতি ৬০ জনের জন্য একটি করে শৌচাগারের ব্যবস্থা থাকতে হবে। আমার প্রশ্ন হল, হিজড়া শ্রমিকেরা কোন শৌচাগার ব্যবহার করবে?
বিধি ৬৩ তে উল্লেখ আছে প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ৫০ কিলোগ্রাম এবং প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলা ৩০ কিলোগ্রামের বেশি ওজনের কোনো দ্রব্য, যন্ত্রপাতি, হাতিয়ার বা সরঞ্জাম মাথায় বহন করতে পারবে না। আবার ওজন বহন করে উপরে উত্তোলনের সময় প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ৪০ কিলোগ্রাম এবং প্রাপ্ত বয়স্ক মহিলা ২৫ কিলোগ্রামের বেশি ওজনের কোন বস্তু বহন করতে পারবে না। হিজড়াদের জন্য এক্ষেত্রেও একটা জটিলতা তৈরি হতে পারে। তাদের জন্য কোনটি প্রযোজ্য হবে সে প্রশ্ন উঠাতো স্বাভাবিক।
আমাদের শ্রম আইনের ১০৯ ধারায় মহিলা শ্রমিকদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে তাদেরকে দিয়ে রাত ১০ টা হতে ভোর ৬ টা পর্যন্ত কাজ করানো নিষেধ করা হয়েছে। ১৭৬(ঙ) ধারায় বলা হয়েছে কোনো প্রতিষ্ঠানের মোট শ্রমশক্তি বা সদস্যের শতকরা ২০ ভাগ মহিলা থাকলে ট্রেড ইউনিয়নের নির্বাহী কমিটিতে ন্যূনতম শতকরা ১০ ভাগ মহিলা সদস্য থাকতে হবে। ধারা ৩৩২ এ উল্লেখ আছে মহিলা শ্রমিকদের প্রতি শালীনতা ও সম্ভ্রমের পরিপন্থী অশ্লীল কিংবা অভদ্রজনোচিত কোনো আচরণ করা যাবে না। নারীরা পুরুষের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে এছাড়া নারীর শারীরিক ও প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতার বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নারী শ্রমিকদের প্রটেকশন দেয়ার জন্যেই এ ধরনের ধারা শ্রম আইনে যুক্ত করা হয়েছে। একইভাবে হিজড়ারাও যেহেতু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এবং তাদেরও শারীরিক ও প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে সেহেতু তাদেরকেও সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রটেকশন দেয়ার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তাই নারী শ্রমিকদের প্রটেকশন দেয়ার জন্য প্রণীত আইন গুলোর অনুকরণে হিজড়াদের প্রটেকশন দেয়ার নিমিত্তে আলাদা কোনো আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিনা সে ব্যাপারেও নিবিড় পর্যালোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
২০১৬ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন সমাজ কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রমোদ মানকিন দেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ৯৮৯২ জন বলে জাতীয় সংসদকে অবহিত করেছিলেন। দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি এবং শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা সাড়ে ৬ কোটির বেশী। দেশের মোট জনসংখ্যা এবং শ্রমজীবী মানুষের অনুপাতে হিজড়াদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। অথচ তারা ন্যূনতম মানুষ হিসাবেও মর্যাদা পায় না। তারা দেশের শ্রম খাতের মূলধারা থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। তাদেরকে শ্রম খাতের মূল ধারার সাথে যুক্ত করার রাষ্ট্রীয় বা সামাজিক কোনো উদ্যোগও পরিলক্ষিত হয় না। ফলে ভিক্ষাবৃত্তিই তাদের একমাত্র পেশাতে পরিণত হয়েছে। হিজড়া জনগোষ্ঠী কেবল শ্রম অধিকার থেকে বঞ্চিত তাই নয়। তাদের বাবা মায়ের সম্পত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রেও দেশের আইনে অস্পষ্টতা রয়েছে। যা খুবই দুঃখজনক এবং মানব সভ্যতার জন্য লজ্জাজনকও বটে। সুতরাং নাগরিক হিসাবে সকল অধিকার থেকে বঞ্চিত ক্ষুদ্র এ জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্র সুদৃষ্টি দিবে এমনটিই সবার কাম্য।
লেখক: শ্রম আইন বিশ্লেষক ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠক