দেশে হাজার হাজার দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী রয়েছেন। লেখাপড়া চালিয়ে যেতে যাদের পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা। তাদের জন্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বান্ধব ডিজিটাল উপকরণ সামগ্রীর সমন্বয়ে তৈরি করা পাঠ্যবই এখন আশীর্বাদ। তাদেরই একজন সাতকানিয়ার মোহাম্মদ শাকিল খান। এগারো বছর বয়সে তিনি সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যান। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে বিশেষ করে সহজলভ্য অধ্যয়ন সামগ্রীর অভাবে তাকে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। মাধ্যমিক স্তরে তিনি কোনো ডিজিটাল উপকরণ পাননি। তাই তাকে পড়ালেখা চালিয়ে নিতে নানা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। খবর বাসসের।
অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করে শাকিল আজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত। তিনি বলেন, আমি ছোটবেলা থেকে চোখের সমস্যায় ভুগছি। কিন্তু এগারো বছর বয়সে সমস্যাটি প্রকট হয়। সাতকানিয়া উপজেলায় নিজ গ্রাম থেকে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেষ করে চট্টগ্রাম শহরের একটি বিশেষায়িত স্কুলে (সরকারি মুরাদপুর স্কুল ফর দ্য ব্লাইন্ড) অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তি হই। অষ্টম শ্রেণি শেষ করে রহমানিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে সমর্থন ও সহায়তা পাওয়ায় শাকিল তার বাবা-মা, বোন এবং ভাইয়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী একটি শিশুর শিক্ষা অব্যাহত রাখার জন্য অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন। তার জন্য চাই কিছু প্রয়োজনীয় অধ্যয়ন উপকরণ। যেসব অভিভাবক তাদের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী সন্তানের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চান তাদের শারীরিক, মানসিক এবং আর্থিক চাপের সম্মুখীন হতে হয়।
দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় অধ্যয়ন উপকরণ পাওয়া ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং এটি তার পরিবারকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সমস্যায় ফেলেছিল। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি অডিও ফরম্যাটে অর্থ্যাৎ শ্রবণবান্ধব পাঠ্যবই হাতে পান। পরে জানতে পারেন, এগুলোকে ডেইজি-স্ট্যান্ডার্ড ডিজিটাল টকিং বুক বলা হয়।
নাগরিক জীবনকে সহজ ও উন্নত করতে সরকারের এটুআই কর্মসূচি কাজ করে যাচ্ছে। সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ লক্ষ্য অর্জনের অংশ হিসেবে এটুআই প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনকে সহজ করতে ডিজিটাল টকিং বইসহ বিভিন্ন নতুন উপকরণ উদ্ভাবন করছে। ডিজিটাল কথা বলার বইগুলো হচ্ছে শ্রবণযোগ্য উপকরণ, যা মুদ্রণ এবং শেখার অক্ষমতাসহ শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অডিও সংস্করণে পাঠ্যক্রম সরবরাহ করে। শ্রবণযোগ্য তথ্য প্রয়োজন এমন সবার জন্যই ডিজিটাল কথা বলার বই এই ‘টকিং বুক’। এর মাধ্যমে পাঠকরা অডিও চালাতে পারে এবং একই সাথে সংশ্লিষ্ট পাঠ্যসূচি দর্শন ও হাইলাইট করতে পারে, যা বাংলাদেশের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন সহজ করেছে।
এর মাধ্যমে এখন শাকিলের শিক্ষাজীবনও অনেক সহজ হয়েছে। এখন নিজের পড়ার উপকরণ পেতে স্মার্টফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি। সর্বক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতি নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে শাকিল বলেন, সহজলভ্য এবং সাশ্রয়ী মূল্যের পঠন সামগ্রী তার কঠিন শিক্ষা জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। ২০১৯ সালে উচ্চ এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হন শাকিল। অক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াই করে পড়াশোনার জন্য সংগ্রামরত অন্যান্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য শাকিলের এ অর্জন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে।
এটুআই কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রতিবন্ধীদের একটি দল ওপেন সোর্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের জন্য (ডিএআইএসওয়াই) স্ট্যান্ডার্ড ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া বই, ই-বুক এবং ডিজিটাল ব্রেইল বই তৈরি করেছে। এসব বই ব্যবহারকারীদের জন্য বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। ডিএআইএসওয়াই কনসোর্টিয়াম, অ্যাঙেসিবল বুকস কনসোর্টিয়াম এবং ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউআইপিও) প্রযুক্তিগত এবং এটুআই তহবিল থেকে সামগ্রিক আর্থিক সহায়তা পাচ্ছে প্রকল্পটি।
এটি সকল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠ্যপুস্তককে সাশ্রয়ী ডিএআইএসওয়াই ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়া ফরম্যাটে রূপান্তরিত। যার মাধ্যমে ব্রেইল, টেঙট, অডিও বুক বা ই-বুক তৈরি সহজ করে তুলেছে।
এটুআইয়ের প্রকল্প পরিচালক ড. দেওয়ান মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, এটুআই প্রকল্পটি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষা উপকরণ সহজলভ্য করতে নিয়মিত কাজ করছে।