শ্রদ্ধায় স্মরণ : শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ

সুবর্ণা চৌধুরী | বুধবার , ১৩ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:৫৪ পূর্বাহ্ণ

‘এদেশ আমার
স্বদেশ আমার উত্তরাধিকার
মৃত্যু মেনে মৃত্যু জেনে
রাখব অধিকার’
স্মৃতি বেদিতে উৎকীর্ণ হয়ে আছে লেখাটি। মৃত্যু মেনে, মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও যিনি দেশের মাটি ছেড়ে যাননি, আজ তাঁর একান্নতম মৃত্যুবার্ষিকী। শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহ, মাত্র আড়াই বছর বয়সে মাতৃহারা হবার পর জগৎপুর আশ্রমে শৈশব কাটিয়ে নয় বছর বয়সে জীবিকার প্রয়োজনে বাবার সাথে বার্মা চলে যাওয়া এই মানুষটি অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে যখন প্রতিষ্ঠিত হলেন নিজ চেষ্টায় তখন দেশ পার করছে মহাসংকটকাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, দেশ বিভাগ এবং তার পরবর্তী পাকিস্তানি শোষণে বাংলা তখন টালমাটাল। কর্মজীবনের শুরুতে মুদির দোকান, কাপড়ের ব্যবসা, ফল ও শরবতের দোকান, সাবান প্রস্তুতকারক সহ বিভিন্ন পেশায় উপার্জিত অর্থ ফেলে রেখে ২য় বিশ্বযুদ্ধের সময় বার্মা ছেড়ে চলে আসেন চট্টগ্রাম। ১৯৪৬ সালে চট্টগ্রামের নিজ গ্রাম গহিরায় প্রতিষ্ঠিত করেন আয়ুর্বেদিক প্রতিষ্ঠান শ্রী কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়। পেছেনে ফেলে এসেছেন ১৯৪৪ সালের দুর্ভিক্ষের নিদারুণ অভিশাপ, ফেলে এসেছেন শৈশব-কৈশোরের দারিদ্রের সাথে যুদ্ধ করা দিন। তাই আর্থিক সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছেও সেই দিনগুলোর দুঃসহ স্মৃতি তাঁকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে গণমানুষের পাশে। অনাড়ম্বর জীবন যাপনে অভ্যস্ত নূতন চন্দ্র সিংহ বিলাসিতায় গা না ভাসিয়ে সমাজ ও মানুষের জন্য কাজ করতে শুরু করেন।
সে সময় চট্টগ্রাম-রাউজান-রাঙামাটি সড়কে হালদা নদীর সত্তারঘাট, এ খেয়াঘাটটি প্রতিদিন পার হতে হতো অনেক লোককে। ইজারাদারদের হয়রানি থেকে রক্ষা করার জন্য খেয়াঘাটটি সারা বছরের জন্য নিজের নামে ইজারা নিয়ে যাত্রীদের বিনা পয়সায় পারাপারের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি।
তিনি সম্পদ আঁকড়ে না থেকে দান করেছেন অকাতরে যেখানে কোনো সামপ্রদায়িকতা প্রশ্রয় পায়নি। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অগণিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মন্দির-মসজিদ-গীর্জায়ও তিনি অকাতরে দান করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয়ের যে শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে আছে তার থেকে লব্ধ অর্থে দেশের সকল সমপ্রদায়েরই অধিকার আছে।
কিন্তু দান করে মহান হবার অভিপ্রায় তাঁর ছিল না। তাই নিজ গ্রামে নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করতে যেমন নিয়েছেন গ্রামের প্রতি ঘর থেকে মুষ্টিভিক্ষা, তেমনি বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তিনি চেয়েছেন সে অঞ্চলের মানুষের দান যুক্ত থাকুক সেখানে। একটি স্মৃতিকথায় এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘আমি চাই সে অঞ্চলের অধিবাসীদেরও কিছু কিছু ত্যাগের ভাগ এই প্রতিষ্ঠানে জড়িত থাকুক। নইলে প্রতিষ্ঠানটির প্রতি গ্রামবাসীদের দরদ থাকবে না। তাই আমি প্রস্তাব করলাম, আপনাদের এলাকার অধিবাসীদের থেকে প্রথমে প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থ সংগ্রহ করুন এবং আপনারা যত টাকা সংগ্রহ করতে পারবেন, আমি নিজে তত টাকা আপনাদের দেব। আমার কাছ থেকে বেশি পাবার আশায় এই সৎকাজে তাদের ত্যাগের পরিমাণ যেন বেশি হয়, এটাই ছিল আমার উদ্দেশ্য’।
তিনি নিজেই শুধু দান করেননি, চেয়েছেন মানুষের মধ্যে ভালো কাজে দানের ইচ্ছে জন্মাতে। কুণ্ডেশ্বরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো গড়তে তিনি এলাকার ঘরে ঘরে গেছেন সাহায্য চায়তে। যার যেমন সামর্থ্য সেভাবে সাহায্য গ্রহণ করেছেন, যে পরিবার টাকা দিতে পারেনি সে পরিবার ধান-চাল দিয়ে সাহায্য করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন গ্রামের প্রথম মেয়েদের স্কুলটি প্রতিষ্ঠার গর্বিত অংশীদার যেন হতে পারেন এলাকার সবাই।
নারী শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তিনি ১৯৬০ সালে কুণ্ডেশ্বরী বালিকা বিদ্যামন্দির ও ১৯৬৯ সালে বালিকা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। শুধু শিক্ষা নয়, দরিদ্র নারীদের স্বনির্ভরতার কথাও তিনি ভেবেছেন, তাই সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তাঁর প্রতিষ্ঠানে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছেন নারীদের। বর্ণভেদপ্রথার তুমুল সেই সময়ে প্রায় ৭৫ বছর আগে কুণ্ডেশ্বরী পূজায় তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে পংক্তিভোজের আয়োজন করেন। অনেক বিরুদ্ধ মতবাদ, হুমকি ও প্রতিবন্ধকতা জয় করে তিনি এটি প্রতিষ্ঠিত করেন যা আজও চলমান।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই তিনি নিঃশঙ্কচিত্তে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। কুণ্ডেশ্বরী ভবন মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি হয়ে উঠে। ২৫ শে মার্চের পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে সারা দেশের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পরিবারগুলোকে আশ্রয় দিয়েছেন নিঃসংকোচে। ড. মনিরুজ্জামান স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘তাঁর নির্ভয়, নিশ্চিত ও নম্র আহ্বানে আগে পরে ৩২টি পরিবার কুণ্ডেশ্বরী এসে উঠি, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্জয় ঘাঁটিতে লুটেরা শত্রুদের বর্বর প্রবেশের সুযোগ দিয়ে’।
ড. আনিসুজ্জামানের স্মৃতিকথায় উঠে আসে সেই সময়, ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হবার কয়েক দিনের মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে আর নিরাপদ বলে মনে হল না। তিরিশে মার্চ তাই এখান থেকে সব পরিবার সরিয়ে দেয়া হল। নূতন বাবু আর তাঁর পুত্রদের সৌজন্যে বেশিরভাগ পরিবারই আশ্রয় নিলেন কুণ্ডেশ্বরী বিদ্যালয় ভবনে।…পরে সবাই যখন কুণ্ডেশ্বরী ছেড়ে চলে আসেন, তখন নূতন বাবুকেও তাঁরা সরে যাবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি শোনেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘সত্য ও ধর্মের পথে যে থাকে, তার বিনাশ হয় না’।
বাঙালি জীবনের সবচেয়ে বড় ধর্মতত্ত্ব ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’- এই আপ্তবাক্যটিকে জীবনে ধারণ করেছিলেন তিনি। চারিদিকে সামপ্রদায়িকতার বিষবাষ্প যখন ছেয়ে ফেলছে বাংলাদেশ, তখন এইসব মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে, যারা একটি শোষণহীন, মানবিক বাংলাদেশের জন্য প্রাণ দিয়েছিল, যারা সবুজের বুকে লাল বৃত্তের পতাকা স্বাধীনভাবে ওড়ানোর স্বপ্নে নির্দ্বিধায় বুক পেতে দিয়েছিল শত্রুর গুলির সামনে। দেশকে ভালোবেসে, দেশের মাটিতে মৃত্যুর ইচ্ছেকে জয়ী করে ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকারের গুলিতে শহীদ হন নূতন চন্দ্র সিংহ। একান্নতম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করি বিনম্র শ্রদ্ধায়।
লেখক : কলেজ শিক্ষক ও আবৃত্তি শিল্পী; শহীদ নূতন চন্দ্র সিংহের পৌত্রবধূ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধপ্রবাহ