১৯৬৯ সালে মৃণাল সেনের ‘ভুবন সোম’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে হিন্দি চলচ্চিত্রের নবতরঙ্গ বা নিউওয়েভ চলচ্চিত্র আন্দোলনের সূচনা হয়। স্বল্প বাজেট–চরিত্রানুগ নতুন অভিনয়শিল্পী, নতুন কলাকুশলী নিয়ে ভিন্ন স্বাদের চলচ্চিত্র নির্মাণই ছিল এই চলচ্চিত্র আন্দোলনের লক্ষ্য। ভুবন সোমে যদিও নাম ভূমিকায় উৎপল দত্তের মতো তারকা অভিনেতা অভিনয় করেছিলেন, কিন্তু কোটি টাকার হিন্দি সিনেমার জগতে মৃণাল সেন মাত্র দেড় লক্ষ টাকায় ছবিটি তৈরি করেছিলেন আর ছবিটি হয়েছিল সুপার হিট। কোনো ধরনের রূপসজ্জা ছাড়া অত্যন্ত সাদামাটাভাবে অভিনয় শিল্পীদের উপস্থাপন করেছিলেন মৃণাল ‘ভুবন সোম’ ছবিতে। ছবিটি শুটিংও হয় বেশির ভাগ আউটডোরে অর্থাৎ কৃত্রিম সেটের বাইরে।
ভুবন সোমের সফলতা হিন্দি সিনেমার নব জাগরণের সূচনা ঘটে। মৃণালের দেখানো পথ ধরে একে একে এগিয়ে আসেন শ্যাম বেনেগাল, এম এস সথ্যু, মনি কাউল, গোবিন্দ নিহালনি, কুমার সাহানি, কেতন মেহেতা, সৈয়দ আখতার মির্জা, রবীন্দ্র ধর্মরাজসহ আরও কয়েকজন মেধাবী নির্মাতা। স্বভাবতই এঁরা নির্মাণগত দিক থেকে মৃণাল সেন প্রভাবিত ছিলেন না। তবে হিন্দি সিনেমার প্রভূত লগ্নী ও স্টারডমের বিপরীতে এঁরা সীমিত বাজেটে ও নিত্যনতুন শিল্পী কলাকুশলীর সমন্বয়ে ভিন্নতর এক পরিবেশ গড়ে তোলেন মৃণাল সেনের অনুসরণে। রাজনৈতিক ও সামাজিক সচেতনতা ছিল এঁদের ইবিতে যা হিন্দি চলচ্চিত্রে শক্তিশালী ও মননশীল একটি ধারা প্রতিষ্ঠা করে ক্রমান্বয়ে।
এঁদের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রবর্তী ছিলেন শ্যাম বেনেগাল। পুরো হিন্দি চলচ্চিত্র জগতে তিনি প্রথম ছবি ‘অংকুর’ থেকেই সম্ভ্রম জাগানিয়া চলচ্চিত্রকার হয়ে ওঠেন কাজ, সাহস আর অবদানের মধ্য দিয়ে। তাঁর হাত ধরে চলচ্চিত্রে আগমন ঘটে শাবানা আজমী, অনন্ত নাগ, নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরী, স্মিতা পাতিল, সাধু মেহের, মোহন আগাসে, দীপ্তি নাভাল, কুলভূষণ খারাবান্দার মতো যুগন্ধর অভিনয় শিল্পীর, গোবিন্দ নিহালনির মতো প্রথিতযশা সিনেমাটোগ্রাফারের। মৃণাল সেন শ্যাম বেনেগালের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেছিলেন, ‘…একটা কথা না বললে অন্যায় হবে যে ভারতীয় ফিল্মে এই নতুন অভিনেতা অভিনেত্রীদের জন্যে–নাসির, ওম, স্মিতা, শাবানা–আমরা সকলেই শ্যাম বেনেগালের কাছে কৃতজ্ঞ, কারণ শ্যামই প্রথম এদের অভিনয়ের দিকে আমদের নজর টানে।’
শ্যাম বেনেগালের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য–কোনো বৃত্তাবদ্ধতা তাঁর মধ্যে ছিল না। স্বভাবতই একটা ঘরানা তাঁরও ছিল, কিন্তু প্রতিটি ছবিতে তিনি নতুনভাবে আত্মপ্রকাশ ঘটাতেন। জীবনের শেষ কাজটি ছাড়া প্রতিটি ছবিতে আমরা এক শক্তিশালী চলচ্চিত্রকারের দর্শন পাই। শেষের কাজটি অনুল্লেখ্য হওয়ার নেপথ্যে তাঁর বার্ধক্যজনিত সীমাবদ্ধতা প্রধান অন্তরায় হয়ে উঠেছিল বলে মনে হয়। অথচ তিনি সুভাষচন্দ্র ও গান্ধীকে নিয়ে চমৎকার দু’টি বায়োপিক নির্মাণ করেছিলেন।
যে ছবিটি পরিচালনার মধ্য দিয়ে তাঁর প্রায় ছয় দশকের দীর্ঘ কর্মজীবনের শুরু সেটি-‘অংকুর’ (১৯৭৪)। তবে শ্যামের চিত্রজীবনের শুরু দূরদর্শনে। তারপর তিনি বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাতা হিসেবেও সাফল্যের স্বাক্ষর রাখেন। তাঁর বিজ্ঞাপন চিত্রগুলি স্বতঃস্ফূর্ত কল্পনাশক্তির পরিচয় পাওয়া যেত। এসময়ে তিনি বেশ কিছু ভ্রমণচিত্র ও তথ্যচিত্রও নির্মাণ করেন। এসব অভিজ্ঞতা তাঁকে কাহিনীচিত্রের নির্মাণে মুন্সিয়ানার পরিচয় রাখতে যথেষ্ট সহায়তা করে। শ্যাম বেনেগাল ৯০০টি বিজ্ঞাপন চিত্র ও ১১টি ভ্রমণ ও তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। তবে প্রথম কাহিনীচিত্র ‘অংকুর’ই তাঁকে পাদপ্রদীপের আলোতে নিয়ে আসে।
ভারতীয় সমাজব্যবস্থার শোষণ, বৈষম্য, বর্ণপ্রথা, রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা ইত্যকার জটিল বিষয়াদি বারবার তাঁর চলচ্চিত্রের বিষয় হয়ে উঠেছে। দেশভাগ নিয়ে শ্যামের পার্টিশান ট্রিলজি বা মুসলিম ওমেন ট্রিলজিঃ মাম্মো (১৯৯৫), সর্দারি বেগম (১৯৯৭) এবং জুবেইদা (২০০১)। তিনজন মুসলিম নারীর জীবনের টানাপোড়নের কাহিনীর মধ্য দিয়ে ১৯৪৭–এর দেশভাগের মর্মন্তুদ পরিণতি ও তৎপরবর্তী প্রতিক্রিয়াকে তুলে ধরনের তিনি নির্মোহভাবে।
তেমনি তাঁর আরেকটি স্মরণীয় ট্রিলজি প্রথম তিনটি ছবির সমন্বয়ে : অংকুর (১৯৭৪), নিশান্ত (১৯৭৫) ও মন্থন (১৯৭৬)। এই চিত্রত্রয়ীতে সামন্ততান্ত্রিক সমাজ কাঠামোর অবিচার ও শোষণ জনিত সমস্যার নানা ঘাত প্রতিঘাতের চিত্র সোচ্চার প্রতিবাদে প্রকাশ পেয়েছে। নর–নারীর সম্পর্কের জটিলতার বিষয়টিও উঠে এসেছে তাঁর কিছু ছবিতে মনস্তত্বের গভীর বুননে; ভূমিকা (১৯৭৭), অনুগ্রহম (কণ্ডুরা) (১৯৭৮) কলযুগ (১৯৮১), অন্তর্নাদ (১৯৯১)। শ্যামের দুটি ছবিতে ভারতের দুগ্ধ সমবায় পরিসেবা ও তাঁতশিল্পের নানা সমস্যার চিত্রও দেখা যায় কাহিনীর আঙ্গিকে; মন্থন (১৯৭৬) ও সুষমান (১৯৮৬)। এক বাক্যে বলা যায়, শ্যাম বেনেগাল তাঁর চলচ্চিত্রকে সমস্যার প্রতি দিগনির্দেশ ও প্রতিবাদের হাতিয়ার করে তুলতে সমর্থ ছিলেন।
চলচ্চিত্রবিদ অধ্যাপক ধীমান দাশগুপ্তের ভাষ্যে, শোষণের দরুণ যে শ্রেণিবৈষম্য তা বেনেগালের প্রিয় বিষয়, কিন্তু এই শোষণ তাঁর হাতে অনেক সময়ই অর্থনৈতিক শোষণ না হয়ে আগে হয়ে উঠেছে যৌন শোষণ (প্রায়ই দরিদ্র বা নিচ জাতির কোনো নারীকে), পেশাদারী দক্ষ লেখকের লেখায় যেমন থাকে….এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে বেনেগাল একবার বলেছিলেন, তিনি মার্ক্সীয় দর্শনে বিশ্বাসী, ফলে তাঁর ছবির বিষয়বস্তু যদি কোনো সমস্যার ওপর ভর করে থাকে তবে তা সামাজিক সমস্যা এবং তিনি তা বিচার করবেন অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে।…. আধুনিক ভারতীয় চলচ্চিত্রে প্রকরণগতভাবে সম্ভবত সবচেয়ে দক্ষ এই পরিচালক, তাঁর বক্তব্যে দ্বিধা–দ্বন্দ্ব, সত্ত্বেও তাঁর বক্তব্যের জন্যও তাই গুরুত্বপূর্ণ।
প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণে সুদক্ষ শ্যাম বেনেগালের অসাধারণ দুটি প্রামাণ্যচিত্র যথাক্রমে জওহর লাল নেহেরু ও সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে। তেমনি নেহেরুর ভিসকভারি অব ইন্ডিয়া তাঁর টিভি ধারাবাহিকও খুবই আকর্ষণীয়।
শ্যামের চলচ্চিত্র নির্মিতির আরেকটি বড় গুণ পরিশীলিত পরিমিতিবোধ, যা তাঁর নির্মাণকে উচ্চকিত হতে দেয় না । দর্শককে নিজস্ব চিন্তার যথেষ্ট সুযোগ করে দেয়। তাঁর আর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাজ জুনুন (১৯৭৮), আরোহন (১৯৮২), মান্ডি (১৯৮৩), ত্রিকাল (১৯৮৫), সুরজকা সাতওয়া ঘোড়া (১৯৯১)। অন্যান্য ছবিগুলি হলো: দি মেকিং অফ দ্য মহাত্মা (১৯৯৬), সমর (১৯৯৯) হরি ভরি (২০০০), বোস, দি ফরগটেন হিরো (২০০৫), ওয়েলকাম টু সজ্জনপুর (২০১০) এবং সর্বশেষ মুজিব দি মেকিং অফ এ নেশন (২০২৩)। শেষোক্ত ছবিটি তাঁর ফিল্মোগাফির সবচেয়ে অনুল্লেখযোগ্য কাজ যেটি তিনি না করলেও পারতেন। এট বায়েপিক না হয়ে বরং প্রচার সর্বস্ব দুর্বল একট কাজ হয়ে রয়েছে তাঁর ক্যারিয়ারে।
শ্যাম বেনেগালের জন্ম ১৯৩৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর তেলেঙ্গানার তিরুমালাগিরিতে। পিতা শ্রীধর বেনেগাল ছিলেন নামকরা ফটোগ্রাফার, সম্পর্কে ছিলেন চিত্রপরিচালক গুরু দত্ত ও কল্পনা লাজমির ভাই। ফলে শৈশব থেকেই চলচ্চিত্রক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছেন শ্যাম বেনেগাল ব্যাঙ্গালুরুতে। পড়াশোনাও সেখানে। কর্মস্থান মুম্বাই। ২০২৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর তিনি প্রয়াত হলেন এই শহরে। দীর্ঘজীবনে কর্মক্ষম থেকেছেন জীবনের প্রায় শেষ সময় পর্যন্ত, যেটা একজন শিল্পীর জন্যে বড় পাওয়া। হিন্দি চলচ্চিত্রের জগতে সুবিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময় পদচারণা এবং গুরুত্বপূর্ণ অবদান শ্যাম বেনেগালকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। সকৃতজ্ঞ শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করি নবতরঙ্গ চলচ্চিত্র আন্দোলন ও চর্চার এই উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের স্মৃতিতে।