শৈশব : ‘পেছনে তাকালে বুক হুহু করে ওঠে’

মাইছুরা ইশফাত | শনিবার , ১১ নভেম্বর, ২০২৩ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

শৈশবের স্মৃতি মনে পড়ে না এমন মানুষ পাওয়া দুষ্কর। স্মৃতিগুলো শুধু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় এগুলো অনেক সময় ঐতিহ্য বহন করে। আমার শৈশব কেটেছে চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার চুনতি গ্রামে। শৈশবের বেড়ে উঠার স্থানটা আসলে শেকড়ের মতো। শেকড়ের টান পড়লেই ছুটে যেতে ইচ্ছে করে। আমিও ছুটে যাই। কিন্তু সেই শৈশব, গ্রামীণ ঐতিহ্য ফিরে পাই না। আমি আজ যে বিষয়টি অবতারণা করতে যাচ্ছি সেটি হলো চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় এমন কিছু শব্দ, কথামালা ছিল যেগুলো এখন শোনা যায় না তথা চর্চা করা হয় না। সেই শব্দ, কথাগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে গ্রামীণ ঐতিহ্য, আমাদের শৈশব। আমি এমনই কয়েকটি স্মৃতিকথা উল্লেখ করছি।

তখনকার সময়ে মোবাইল ছিল না তাই বাড়িতে কোনো অতিথি আসলে আগে জানা যেত না। মোবাইল না থাকলে কী হবে অতিথি আসার খবর জানান দেয়ার জন্য হলদে পাখিতো ছিল। দাদী বলতেন, ‘ফুগদ্দি অলইদ্যা চরই মাতের গরবা আইবো’ (পূর্ব দিকে হলদে পাখি ডাকছে, অতিথি আসবে)। এখানে ‘গরবা’ অর্থ অতিথি। আর এই সংকেত কিন্তু প্রায় সময় সত্যি হতো। বাসায় অতিথি আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেলে বাড়িতে তো সবাই উদ্বিগ্ন। কী দিয়ে আপ্যায়ন করবো! কারণ সেই সময় কারো বাড়িতে ফ্রিজতো দূরের কথা বিদ্যুৎ থাকাটাও বিরল ছিল। আর গ্রামের বাজারে হাঁট বসত সপ্তাহে দুই দিন। কেউ আসলেই শুরু হতো তোড়জোড়। বাড়ির কর্ত্রীর ঘোষণা আসত, ‘আরাইলত্তো উগগা কুরা ধরি যরা, আঁসর ডিম ইঝাদ্দে’ (মুরগীর ঘর থেকে মুরগী ধরে জবাই কর হাঁসের ডিম সিদ্ধ কর)। তো এভাবেই চলতো আয়োজন। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত সব সিজনে পাড়ার মহিলাদের থাকত বৈকালিক আড্ডা। একজনের পিছনে আরেকজন বসে লম্বা লাইন করে চুল থেকে উকুন বেছে নিত। তাদের আমন্ত্রণের ভাষাটা ছিল সবচেয়ে চমৎকার। ‘অ বযি, দুঁইরগা মাথার উইন বাইচত আইস্য, এদিন্না তেতই হর লয়্যিদে ইন আইন্যম / মুচ্চিদি বরইচ্চান্নি হাবাইয়্যুম’ (বুবুজি দুপুরে উকুন বেছে দিতে আসিও, সেদিনের বানানো তেঁতুলের আঁচার/ কাঁঠালের মুচি দিয়ে বড়ইয়ের চাটনি খাওয়াবো)

সকালে ঘুম থেকে উঠতে আমরা ঘড়ির এলার্ম ব্যবহার করি। কিন্তু তখন এত এত ঘড়ির ব্যবহার ছিল না। বাড়ির মুরব্বিরা বলতেন ‘রাতা কুরা কুক্কুরু কুক হর, বেইন্যা ফযর অইয়্যে, তোঁয়ারা ঘুমত্তু উড়িয়্যেরে ডর ডর গরি কোরান ফর নইলে ঘরত ফেরেশতা ন আইব’ (মোরগ ডাকছে, সকাল হয়েছে, তোমরা ঘুম থেকে উঠে কোরান পড় না হলে ঘরে রহমতের ফেরেশতা আসবে না)। তখন ভোরে সবার ঘর থেকে ভেসে আসত কোরআন তেলওয়াতের সুমধুর সুর। ঘরের দাওয়া সূর্যের মুঠো মুঠো সোনারোদে ভরে গেলেই বোঝা যেত দুপুর। এভাবেই বেলার হিসাব রাখা হতো।

আমি আর আমার বড় বোন সন্ধ্যা হলেই হারিকেনের (বিদ্যুৎ সংযোগ নামে ছিল, বেশির ভাগ সময় লোডশেডিং চলত) আলোয় পড়তে বসতাম। যেহেতু সে বড় ছিল আলোর অংশ তার দিকে আর ছায়ার অংশ আমার দিকে দিত। আমিও তেজ দেখাতে ছাড়তাম না। ‘ফর বেক্কিন অনে লন আধারগিন আঁরে দিয়্যন, আঁই আম্মারে হই দিয়্যমবই’ (আলো সব আপনি নিয়ে আমাকে অন্ধকার দিচ্ছেন, আম্মাকে বলে দিব)

এমন মজাদার ছিল আমাদের শৈশব। এখনো গ্রামীণ জনজীবন আছে কিন্তু আগের সেই জৌলুস নেই। শীতকালের খেজুর রস নেই, আগুন পোহানো নেই। আরও কত কিছু নেই। আছে শুধু স্মৃতি। সবচেয়ে বড় সমস্যা আঞ্চলিক ভাষার সেই শব্দ ভাণ্ডার হারিয়ে যাচ্ছে। সেই আবেদনময়ী, আকর্ষণীয়, মায়াবী কথাগুলো এখনকার শিশুরা শুনছে না। তাই তাদের শৈশবের স্মৃতিও মোবাইলের স্ক্রিনের মতো ঝাপসা, ক্ষণস্থায়ী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধলোভ
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে