ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন করে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে দিল্লি পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি বিশেষ ফ্লাইটে গতকাল শুক্রবার বিকাল ৩টা ২৯ মিনিটে তিনি নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছান। সেখানে তাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান ভারতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কীর্তি বর্ধন সিং এবং নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. মোস্তাফিজুর রহমান।
বিমানবন্দরে প্রধানমন্ত্রীকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। তাকে স্বাগত জানিয়ে পরিবেশন করা হয় লোকনৃত্য। বিমানবন্দর থেকে প্রধানমন্ত্রী তার সফরকালীন আবাসস্থল হোটেল তাজ প্যালেসে যান। এদিকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রমে বাংলাদেশ ও ভারত যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে তা দূর করতে সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে তিনি এ কথা বলেন। খবর বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।
প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্ক নতুন করে এগিয়ে নিতে সবশেষ নির্বাচনে জয়ী দুই সরকারপ্রধানের আগ্রহের মধ্যে এই সফর হচ্ছে। শেখ হাসিনার এই সফরে দুই দেশের মধ্যকার দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে বলে এর আগে জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান। গত বুধবার তিনি বলেছিলেন, অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য আমাদের প্রস্তুতি আছে। নবনির্বাচিত দুই দেশের দুই নতুন সরকারের মধ্যে দুই দেশের অমীমাংসিত যে বিষয়গুলো আছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে।
টানা তৃতীয় মেয়াদে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া নরেন্দ্র মোদীর আমন্ত্রণে শেখ হাসিনা দিল্লি গেলেন। সফরের শেষ দিন আজ শনিবার দুই প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিক বৈঠক করবেন বলে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে তথ্য দেওয়া হয়েছে। গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে জিতে টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রীর পদে আসা শেখ হাসিনার এই মেয়াদে এটি ভারতে প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর। তবে মোদীর শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত ৮ থেকে ১০ জুন তিনি প্রতিবেশী দেশটিতে সফর করেন। সে হিসেবে চলতি মাসে দ্বিতীয়বারের মতো ভারত সফর করছেন শেখ হাসিনা। ওই সফরেও নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে শেখ হাসিনার বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, সফরকালে প্রতিনিধি পর্যায়ে আলোচনার পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যে কয়েকটি এমওইউ ও চুক্তি স্বাক্ষর হতে পারে। সফর নিয়ে দুই নেতা সংবাদ সম্মেলনেও আসবেন।
বাংলাদেশ–ভারত সংলাপের আহ্বান : অর্থনৈতিক উন্নয়ন কার্যক্রমে বাংলাদেশ ও ভারত যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে তা দূর করতে সংলাপের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল নয়া দিল্লি সময় সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সফরকালীন আবাসস্থল হোটেল তাজ প্যালেসে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর সৌজন্য সাক্ষাৎকালে তিনি এ কথা বলেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে আমরা যে চ্যালেঞ্জগুলো অনুভব করছি সেগুলো আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে পারি।
সৌজন্য সাক্ষাতের আলোচনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, এ সাক্ষাতে দুদেশে নতুন সরকার গঠনের পর দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যকার অংশীদারত্বকে আরও এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তিনি বলেন, দুই নতুন সরকার জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। তাই দুদেশে নতুন ভিশন যুক্ত হবে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর বলেন, গত দশ বছরে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক এমন উচ্চতায় পৌঁছেছে, এ সম্পর্ককে এখন নতুন অধ্যায়ে নেওয়া যেতে পারে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, এ নতুন অধ্যায় বাণিজ্য ক্ষেত্রে করা হবে। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে লজিস্টিক, জ্বালানি ও কানেকটিভিটি খাতে গভীরভাবে কাজ করতে চায়।
আগামীকাল ২৩ জুন আওয়ামী লীগের হীরক জয়ন্তী উদযাপনের জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। শেখ হাসিনাকে বিমসটেকের (বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি–সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কো–অপারেশন) জন্য একটি নতুন ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। আগামী সেপ্টেম্বরে থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিমসটেকের পরবর্তী বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অংশ নেবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। শেখ হাসিনা ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী একমত হন, বিমসটেক শক্তিশালী হলে তা অর্থনৈতিক, বাণিজ্য, কানেকটিভিটি ও ডিজিটাইজেশনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য লাভজনক হবে। সাক্ষাতে ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে কর ও রাজস্ব সংগ্রহ এবং জনগণকে সেবা দেওয়া উন্নয়ন করাসহ ডিজিটাল কর্মসূচির উন্নয়নে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তোফাজ্জল হোসেন মিয়া বলেন, সাক্ষাতে প্রধানমন্ত্রী দুই প্রতিবেশী দেশের প্রকল্প দ্রুত ও সহজে শেষ করার ওপর জোর দেন। এ বিষয়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও একমত হন। রোহিঙ্গা ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব বলেন, মিয়ানমার সরকার ও বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে চলমান সংঘাতের কারণে বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ব্রিফিংয়ে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব মো. নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর বলেছেন প্রয়োজনে বিমসটেকে মিয়ানমারকে বাদ দিয়ে অন্য সদস্য দেশগুলো পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে এগিয়ে যাবে। কারণ মিয়ানমারের কারণে ভারতও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এবারের সফরের দ্বিতীয় দিন আজ শনিবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নয়াদিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী সশস্ত্র সালাম গ্রহণ ও গার্ড পরিদর্শন করবেন। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাজঘাটে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও পরিদর্শন বইয়ে সাক্ষর করবেন। একই দিনে হায়দ্রাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠক করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুই দেশের প্রতিনিধি পর্যায়েও বৈঠক হবে সেখানে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে রাষ্ট্রীয় মধ্যাহ্নভোজেরও আয়োজন করা হবে। দুদিনের সফর শেষে আজ সন্ধ্যা ৬টায় বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকার পথে রওনা দেবেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রসঙ্গত, ভারতে শেখ হাসিনার শেষ দ্বিপক্ষীয় সফর ছিল ২০২২ সালে। ওই বছরের ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর সেই সফরে দুই দেশের মধ্যে সাতটি সমঝোতা স্মারক সই হয়, আলোচনা হয় নিরাপত্তা সহযোগিতা, বিনিয়োগ, বাণিজ্য সম্পর্ক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সহযোগিতা, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, মাদক চোরাচালান, মানব পাচার প্রতিরোধ নিয়ে।
২০২৩ সালের ৮ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনা ভারত যান জি টোয়েন্টি সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে। এই সফরেও ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। সই হয় তিনটি সমঝোতা স্মারক।
শেখ হাসিনা ও মোদীর শাসনামলে দুই দেশ ‘সম্পর্কের নতুন উচ্চতায়’ পৌঁছেছে বলে দুই পক্ষ থেকেই বার্তা দেওয়া হচ্ছে। এক দেশের ভেতর অন্য দেশের ছিটমহল বিনিময়ের পর দুই দেশের স্থল সীমানা নির্ধারিত হয়েছে। অমীমাংসিত আরও অনেক সমস্যার সমাধানে দুই পক্ষ কাছাকাছি এসেছে। তবে সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে মৃত্যুর ঘটনা বন্ধের প্রতিশ্রুতি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি; তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে আটকে যাওয়া চুক্তি সইয়েও অগ্রগতি হয়নি। গত দেড় দশকে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় প্রায় প্রতিটি আলোচনাতে এ চুক্তি নিয়ে আশাবাদের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু নানা জটিলতায় শেষ পর্যন্ত তা আটকে আছে।