অবিভক্ত ভারতে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে ও স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহনকারী যে সব মহানায়কের নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয় তন্মধ্যে একজন হচ্ছেন চট্টগ্রাম জেলার অধিবাসী কাজেম আলী মিয়া। আন্দোলন–সংগ্রামে বলিষ্ঠভূমিকা ও বিশাল কর্মযজ্ঞের কারণে তাঁকে শেখ–ই– চাটগাম নামে অভিহিত করা হয়। আন্দোলন সংগ্রাম করতে গিয়ে তিনি মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, মাওলানা শওকত আলী, মনিরুজ্জামান ইসলামবাদী সহ দেশও উপমহাদেশের অনেক বরেণ্য ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে তিনি এসেছিলেন। কংগ্রেস খেলাফত সমন্বয়ে আন্দোলন পরিচালনা, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন সহ নানা আন্দোলন, ব্যাপক সমাজ কর্ম ও শিক্ষাবিস্তারে ও রেখেছেন ব্যাপক ভূমিকা। ছিলেন কঠোর শৃঙ্খলাপরায়ণ শিক্ষক। তাই তিনি কাজেম আলী মাষ্টার নামে ও পরিচিত ছিলেন। মাহবুবুল আলম চৌধুরীর ‘চট্টগ্রামের ইতিহাস‘ গ্রন্থে তাঁর সম্বন্ধে ব্যাপকভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রতিষ্ঠা করেছেন অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নেতৃত্ব দিয়েছে বার্মা অয়েল কোম্পানী ধর্মঘট, রেল ধর্মঘটে। কংগ্রেস ছাড়া তিনি সর্বভারতীয় মুসলিম খাদেমুল ইসলাম সোসাইটি, চট্টগ্রাম এসোসিয়েসন, জমিয়তুল ওলেমা সহ অনেক প্রতিষ্ঠানের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ছিলেন চট্টগ্রামী ভাষার অনলবর্ষী বক্তা। বক্তৃতায় তিনি স্বাধীনতার মন্ত্রে জনতাকে উজ্জীবিত করতেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন চলাকালে একবার চট্টগ্রাম জেলার আদালত ভবনের দোতলা হতে আন্দোলনরত জনতার উদ্দেশ্যে এক কালজয়ী ভাষণ দিয়েছিলেন। সরকার তাঁকে ‘কায়সার –ই–হিন্দ‘ উপাধি ও ‘সার্টিফিকেট অফ অনার‘ সনদ দিয়ে সম্মানিত করেন। তাঁকে খাঁন বাহাদুর উপাধি প্রদান করতে চাইলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। সম্রার্ট ৫ম জর্জের অভিষেকের সময় তাকে ‘সার্টিফিকেট অব অনার‘ দিয়ে সম্মানিত করা হয়। কংগ্রেসের টিকেটে তিনি ভারতীয় আইনসভার সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। আমৃত্যু ছিলেন চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার। ১৯২৬ সালে আইনসভার কাজে তিনি দিল্লী গেলে সেখানে মৃত্যু বরণ করেন। দিল্লীতে তাকে সমাহিত করা হয়। ১৮৫২ সালে কাজেম আলী মাষ্টারের জন্ম। ২০২৬ সালের ১১ই আগষ্ট তাঁর ১৭১ তম জন্ম বার্ষিকী ও ২০২৬ সালের ২য় ফেব্রুয়ারী হবে তাঁর শততম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রতিবছর চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে এবং ভারতের কোলকাতায় ও বিভিন্ন স্থানে বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামী ও বিপ্লবীদের স্বরণে সভা–সেমিনার হয়। কিন্তু কাজেম আলী মাষ্টারকে নিয়ে কোন উল্লেখযোগ্য অনুষ্ঠান হয়েছে বলে এ পর্যন্ত জানা যায়নি। তিব্বত থেকে জ্ঞানী অতীশ দিপঙ্করের দেহভষ্ম অনেক বছর পর বাংলাদেশে আনা হয়েছে। পাকিস্থান থেকে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের মৃতদেহ, ভারতের ত্রিপুরা থেকে মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হামিদের মৃতদেহ কবর থেকে তুলে এনে বাংলাদেশে সমাধিস্থ করা হয়েছে। কাজেম আলী মাষ্টারের মৃতদেহ এখন শনাক্ত করা ও দিল্লী থেকে আনা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বিধ্বস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্নস্থানে পাকিস্তানী বাহিনীর পুঁতে রাখা মাইন অপসারন, ক্ষতিগ্রস্ত বন্দর ও জাহাজের সংস্কার কাজের জন্য বঙ্গবন্ধুর আহবানে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া থেকে নৌবাহিনীর একটি চৌকশ দল চট্টগ্রামে এসে উদ্ধার কাজে অংশগ্রহণ করে। কাজ করতে গিয়ে রেনিকিন নামে একজন নাবিক সেনা মাইন বিস্ফোরণে নিহত হয়। পতেঙ্গা সমুদ্রপারের নিকটে একটি নিরাপদ জায়গায় তাকে সমাহিত করে তার পরিচয় ও তার কাজের কথা উল্লেখ করে সমাধির পাশে স্মৃতিফলক উৎকীর্ণ করা হয়। লালদিঘির পার্কে তার নামে একটি স্মৃতিমঞ্চ করা হয়। ইংল্যান্ডে রাজা রামমোহন রায়ের সমাধিতে স্মৃতিফলক উৎকীর্ণ করা আছে। ১ম ও ২য় মহাযুদ্ধে বৃটিশদের পক্ষে অবিভক্ত ভারতে বাঙ্গালী ও অন্যান্য জনগোষ্ঠির যারা যুদ্ধ করেছিল বৃটিশ সরকার তাদের নামফলক দিয়ে ও শ্রদ্ধাবাণী দিয়ে তাদের সসম্মানে সমাধিস্থ করেছে। ঈড়সসড়হবিধষঃয ডধৎ ঈবসবঃবৎু তার সাক্ষ্য বহন করছে। শেখ–ই– চাটগাম কাজেম আলীর ক্ষেত্রে কোন স্মরণযোগ্য পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। কাজেম আলীকে দিল্লীর যেখানে সমাহিত করা হয়েছে সমাধিস্থান স্থান সঠিকভাবে চিহ্নিত করে কবরের পাশে তার গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার তথ্য উল্লেখ করে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করা যেতে পারে। এ স্মৃতিফলক হবে দিল্লীর বুকে গৌরবময় ইতিহাসের উজ্জ্বল চট্টগ্রাম। ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে ভারত সরকারের সাথে যোগাযোগ করে কাজেম আলীর উত্তর প্রজন্ম বিশিষ্ট কণ্ঠ শিল্পী শাহরিয়ার খালেদ ও তাদের প্রভাবশালী আত্মীয়স্বজন, চট্টগ্রাম ও জাতীয় পর্যায়ের ইতিহাস আগ্রহী গবেষক, ঐতিহাসিক বুদ্ধিজীবী সমাজ কাজেম আলী স্মৃতিফলক নির্মাণ করার কাজে এগিয়ে আসতে পারেন। ইতিহাসপ্রেমী পর্যটক কাজেম আলীর কবর জেয়ারত করে দর্শনার্থী খাতায় শ্রদ্ধাবলী লিখে ইতিহাসের গৌরব অনুভব করবেন। যেমন গৌরবের অনুভূতিতে স্ফীত হয়ে উঠেছিলেন ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় সফরে মায়ানমার (তৎকালে বার্মা) গমন করেন। সফরের এক পর্যায়ে তিনি দিল্লীর শেষ মোগল সম্রাট ও কবি বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধি পরিদর্শন করেন। সমাধির ফলক গাত্রে উৎকীর্ণ ছিল কবি ও সম্রাটের কবিতার অংশ :
এত নে বদনসীব তোম জাফর/ তেরে দাফনকে লিয়ে দোগজ জমি নেহি মিলা হিন্দুস্থানমে
(হে জাফর, তুমি কত ভাগ্যহত, তোমার দাফনের জন্য হিন্দুস্থানে দুই গজ জমিও মিললো না)
প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী দর্শনার্থী খাতায় লিখলেনঃ–
বদনসীব তু নেহী জাফর /তেরি নাম লিখা হায় হিন্দুস্থান কি শান আওর শওকত মে তেরি কোরবানী সে উঠা হিন্দুস্থানকি আজাদী কি আওয়াজ (হ জাফর তুমি ভাগ্যহত নও/ তোমার নাম লেখা হিন্দুস্থানের ইতিহাসে দীপ্ত গৌরবে। তোমার ত্যাগ থেকেই উঠেছে হিন্দুস্থানের স্বাধীনতার সোচ্চার বাণী।)
এখনো এ উপমহাদেশের যে কোন স্থানে সংঙ্গীতানুুষ্ঠানে বাহাদুর শাহের সেই বিখ্যাত গজল শিল্পীরা পরিবেশন করে অনুষ্ঠানকে গৌরবান্বিত করেন। ১৯৮২ সালে ভারতের সংগীত জগতের দুই বিশিষ্ট শিল্পী কিরিট খান ও কুমকুম ভট্টাচার্য চট্টগ্রাম সফরে এসেছিলেন। চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে অনুষ্ঠিত সংগীতানুষ্ঠানে শিল্পী কুমকুম ভট্টাচার্য সম্রাট বাহাদুর শাহের সেই বিখ্যাত গজলটি পরিবেশন করে চট্টগ্রামবাসীকে ধন্য করেছিলেন।
বিভিন্ন ঐতিহাসিকগণ এ উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস লিখতে গিয়ে কাজেম আলী খানের কথা শ্রদ্ধার সাথে উল্লেখ করেছেন। তা সত্বেও চট্টগ্রামের অনেকে এখন কাজেম আলীকে চেনেন না। চট্টগামের কলেজ রোডে কাজেম আলী স্কুলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের কাজেম আলী সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে শিক্ষার্থীরা তেমন কিছু জানে না। অনেকে কাজেম আলীর বাড়িও কোথায় জানে না। স্কুল কম্পাউন্ডের এক কোণে এক ঘেরা বাগানের মধ্যে দেয়ালে তাঁর একটি ছবি এঁকে রাখা হয়েছে যা কদাচিৎ চোখে পড়ে। তাই স্কুলের প্রবেশ মুখে এ নেতার ছবিসহ রাজনীতি ও সমাজ সেবায় তাঁর সংক্ষিপ্ত ভূমিকা সম্বলিত একটি স্মৃতিফলক রাখা প্রয়োজন। অবশেষে বলতে চাই শেখ–ই– চাটগাম কাজেম আলীকে নিয়ে সভা সেমিনার হওয়া প্রয়োজন। স্বাধীনতার ইতিহাস সৃষ্টিতে জাতীয়ভাবে তাঁর ভূমিকা মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। এটা সময়ের দাবি। আশা করি উৎসাহী পাঠক, কাজেম আলীর উত্তর প্রজন্ম, ইতিহাস প্রেমিক সুধীজন আবেদনটি ভেবে দেখবেন।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক