শৃঙ্খলাবোধ উন্নয়নের চাবিকাঠি

ডা. দুলাল দাশ | মঙ্গলবার , ২৪ জুন, ২০২৫ at ৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ

সম্প্রতি রোমের ভ্যাটিক্যান সিটিতে ‘পোপ ফ্রান্সির’ অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানটা টেলিভিশনে লাইভ প্রোগ্রামে দেখে আমার মনে উদ্রেক হয়েছে আজকের লিখাটা লেখার। হাজার হাজার উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ পুরো অনুষ্ঠানটিতে নিয়মানুবর্তিতা বা ডিসিপ্লিন ও সুশৃঙ্খলার যে পরিচয় প্রদান করেছেন তা আমাদের মত দেশের ও জাতির জন্য ভাবনার বিষয়। গুণীজ্ঞানী লোকদের মধ্যে এটা বিশেষভাবে আলোচিত হয়েছে। সুশৃঙ্খল জীবন, পরিবার, সমাজ এবং দেশ ধাপে ধাপে উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহন করে। যে জাতি যত বেশি সুশৃঙ্খল সে জাতি তত বেশি উন্নত। আমরা যখন বহিঃবিশ্বে বেড়াতে যাই, সেখান থেকে এসে বলি, ওরা কত সুশৃঙ্খল জাতি। তাদের রাস্তাঘাট, চলাফেরা কত পরিষ্কার ও সুন্দর। কোথাও গাড়ির কানফাটা হর্নের শব্দ নেই। সব কিছুতেই শৃঙ্খলাবোধ পরিলক্ষিত হয়। কথায় আছে ডিসিপ্লিন ইজ ফাস্ট অর্থাৎ শৃঙ্খলায় প্রথম। আমরা যখন হাই স্কুলে (উচ্চ বিদ্যালয়) পড়তাম ১৯৫৬৫৭ সালে ‘ডিসিপ্লিন’ সম্বন্ধে ইংরেজিতে মেট্রিক পরীক্ষায় রচনা আসতো। এখন অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা আরো বিশৃঙ্খল ও উশৃঙ্খল হয়ে গেছি। দীর্ঘ ৫৩ বছর পরও কোনো পরিবর্তন আসেনি। এখন ক্লাসে ডিসিপ্লিন সম্বন্ধে পড়ায় কিনা জানি না। কারণ নিয়মানুবর্তিতা বা ডিসিপ্লিন কথাটা সবাই ভুলে গেছি। যে কোন কাজে, যে কোন জায়গায়, যে কোন অবস্থাতে আমরা শৃঙ্খলাবোধটাকে ধরে রাখতে পারিনি। তাই আমরা বিশৃঙ্খল জাতি। তাতে বারে বারে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষ দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। ব্যক্তি জীবনে পরিবারে, সমাজে সমগ্র দেশে যত্রতত্রই বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। ইদানীং আমরা যে মবের কথা বলি সেটাতে উচ্ছৃঙ্খলতা প্রকাশ পায়। একটা মেধাবী ছাত্রের দিকে খেয়াল করলে বুঝা যায় তার চলনে বলনে, পোশাকে, টেবিলে বই খাতা রাখা থেকে শুরু করে খাওয়াদাওয়া সবই নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে থাকে। সেনাবাহিনীর কথায় বলিদেশের সেনাবাহিনীকে আমরা এত প্রশংসা করি কেন, কারণ তারা সব কিছুতেই কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে আবদ্ধ থাকে বলেই তাদের প্রতি সবার বিশ্বাস, আনুগত্য বিদ্যমান। একটা পরিবারে পিতামাতা যদি সুশৃঙ্খল হয় ছেলে মেয়েরাও অবশ্যই সুশৃঙ্খল হবে। শৃঙ্খলাবোধ খুব ছোট বেলা থেকেই শিখতে হয়। এটা অনেকটা পরিবার থেকে আসতে হবে, মাতাপিতা হলো প্রথম শিক্ষাগুরু। তারপর শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান। উচ্ছৃঙ্খল জীবন, ব্যক্তি জীবনে, পরিবারে, সমাজে ধ্বংস ডেকে আনে। তাদের পরিণতি কোনদিন সুখকর নয়। খরচপাতিও যদি শৃঙ্খলার সহিত করা হয় তবে পরিবারে আর্থিক সাশ্রয় আসবে। ভবিষ্যৎ জীবন টেকসই হবে। আমরা যখন কোন কিছুর জন্য লাইনে দাঁড়াই; যে ব্যক্তি শৃঙ্খলা মেনে দাঁড়ায় তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাবোধ জন্মায়। মানুষ যদি সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করে তখন তার প্রতি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগে। ইতিহাস বলে যে সকল দেশআজ উন্নতির উচ্চ শিখরেতাদের অগ্রযাত্রার পেছনে রয়েছে সে দেশের জনগণের নিয়মানুবর্তিতা এবং সমাজে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, প্রতিটি স্তরে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাতা। এতক্ষণ ধরে এই কথাগুলো বলার উদ্দেশ্য, কারণ ইটালির রোমের ভ্যাটিক্যান সিটিতে সম্প্রতি প্রয়াত ‘পোপফ্রান্সিসের’ অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, ধর্মীয় ব্যক্তিবর্গ ও অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত থেকে যে নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার পরিচয় প্রদান করেছেন সেটা দেশে দেশে বিজ্ঞজনেরা এবং নিয়মানুবর্তিতায় বিশ্বাসী জনগণ ভূয়সী প্রশংসায় মুখরিত। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শ্রদ্ধেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস উক্ত অনুষ্ঠানে যোগদান করেন। আমি নিজেও প্রোগ্রামটা সরাসরি উপভোগ করেছি বলেই আজকে এই কথাগুলো আসছে। পুরোটাই ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল। সি.এন.এন সংবাদ মাধ্যম অনুষ্ঠানটি গুরুত্ব সহকারে প্রচার করে। সামরিক বাহিনীর ন্যায় সর্বস্তরের রক্ষা করে সম্পূর্ণ অনুষ্ঠানটি পরিচালিত হয়। হাজার হাজার লোকের উপস্থিতিতে কোন প্রকার বিশৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হয়নি। সেখানে কোন ব্যক্তিগত প্রচারের অবকাশ ছিল না। ইহা একটা শিক্ষনীয় দৃশ্য। এর ঠিক বিপরীত দিকে চিন্তা করলে দেখা যায় আমরা যারা তৃতীয় বিশ্বে বাস করি আমরা প্রায়শই দেখি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সেমিনারে পর্যন্ত ব্যাপক বিশৃঙ্খলা পরিলক্ষিত হয়।

আমরা দেখি দাওয়াতে, বিবাহ অনুষ্ঠানে, খাওয়ার টেবিলে, সভাসমাবেশে, গুরুত্বপূর্ণ নেতার মাজার জিয়ারতে, বিশেষ ব্যক্তিদের স্বাগত জানাতে হুড়োহুড়ি ও ধাক্কাধাক্কিতে পরিবেশ দূষিত করে ফেলি। কে, কার আগে পুষ্পমাল্য অর্পণ করবে। কিংবা টিভি ক্যামেরার সম্মুখে আসবেন এই নিয়ে অনাকাঙ্খিত ও অযৌক্তিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ইহা জাতির জন্য ভাল কিছু বয়ে আনে না। ইহার মূল কারণ তারা ডিসিপ্লিন/ নিয়মানুবর্তিতা মানেন না বা বুঝেন না। আমরা জাতি হিসেবে নিয়ম না মানার সারিতে আছি। আমরা নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে উন্নত বিশ্বের কাতারে যেতে পারবো কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমরা বুঝিয়াও বুঝি না যে ডিসিপ্লিন, সমাজ ও দেশের সংহতিকে দৃঢ় করে। শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল পরিবেশই অর্থনৈতিক সামাজিক, সাংস্কৃতিক উন্নয়নের পূর্ব শর্ত। ডিসিপ্লিন রক্ষা করার জন্য আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ খুবই কষ্টকর। কারণ ছোট একটা দেশে কোটি কোটি জনগোষ্ঠী।

দরকারবশত আইন পরিবর্তন করা হোক। বর্তমান প্রতি বর্গমাইলে ৩ হাজার ৪৯৬ লোকের বাস। আর ঢাকা শহরে ঘনত্ব বর্গমাইলে ৫০ হাজার ১ জন। বাংলাদেশ পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ দেশের মধ্যে অন্যতম। প্রতিদিন ইহার লোক সংখ্যা বাড়ছে। তার উপর রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ১৩ লক্ষ ছাড়িয়েছে এবং আরও প্রবেশ করছে। প্রতিবছর ৩০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিচ্ছে। পরিণতি আরও ভয়বহ। জাতি আরও বিশৃঙ্খলার মধ্যে পড়বে। তারপরও মানুষ চিন্তা করলে সুশৃঙ্খল হওয়া যায়। খেয়াল করলে বুঝবেন পশু পাখীর মধ্যেও শৃঙ্খলাবোধ আছে, ব্রিটিশ আমাদেরকে দুইশত বছর শাসন করেছিল। কিন্তু তারা ভারতবাসীকে দমন পীড়নে ব্যস্ত ছিল। কারণ ভারতবাসীরা কোনদিন এ শাসন মেনে নেয়নি। কারণ বৃটিশরা ভারতীয়দের পরাধীনতার শৃঙ্খলা আবদ্ধ রেখেছিল। তারা নিজেদের সুশৃঙ্খল জাতি হিসেবে পরিচয় দিলেও কিন্তু আমাদের সুশৃঙ্খল করে তোলেনি বা সেই শিক্ষা দেয়নি। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা দেশটাকে দ্বিজাতি ভিত্তিতে ভাগ করে জাতিগত ও ধর্মগত বিশৃঙ্খলার মধ্যে রেখে চলে গেল যা আজও বিদ্যমান। তাদের শাসন ক্ষমতার মূলমন্ত্র ছিল ডিভাইড এন্ড রুল অর্থাৎ বিভাজন এবং শাসন। পরিশেষে প্রয়াত পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের সুশৃঙ্খল চিত্র আমাদের জন্য তথা উন্নয়নশীল দেশের জন্য শিক্ষণীয় বিষয়।

লেখক : প্রাক্তন চিফ অ্যানাসথেসিও লজিস্ট, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতাল, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসোনালি প্রান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধদ্রোহের কবি নজরুলের চট্টগ্রাম