শিশু ওয়ার্ডে ঠাঁই নেই

চমেক হাসপাতাল।। জ্বর-শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ার প্রকোপ শয্যার তিন-চারগুণ বেশি রোগী

আজাদী প্রতিবেদন | শুক্রবার , ৪ নভেম্বর, ২০২২ at ৫:৩২ পূর্বাহ্ণ

হেমন্ত চলছে। ভোর রাতে শীতের আবহ জানান দিচ্ছে শীতও আসি আসি করছে। তবে দিনের বাকি সময় জুড়ে থাকছে গরমও। ঠান্ডা-গরমের মিশ্র আবহাওয়ার এই সময়ে শিশুদের মাঝে দেখা দিয়েছে উচ্চ মাত্রায় জ্বর (হাই ফেভার), ব্রঙ্কিউলাইটিস (শ্বাসকষ্ট) ও ডায়রিয়া রোগের প্রকোপ। নিউমোনিয়া তো আছেই। এই সময়ে যোগ হয়েছে ডেঙ্গুর প্রকোপও। এসব রোগে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা অন্যান্য সময়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। শিশু রোগীতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডে যেন ঠাঁই নেই অবস্থা। শয্যা সংকটে এক শয্যায় তিন থেকে চার শিশুকে রেখেও চিকিৎসা দিতে হচ্ছে এখানে। শিশু স্বাস্থ্য বিভাগে সব মিলিয়ে শয্যা সংখ্যা একশোর কিছু বেশি। কিন্তু গত বেশ কিছু দিন ধরে বিভাগে ভর্তি শিশু রোগীর সংখ্যা চারশর কম নয়। হিসেবে শয্যার তুলনায় প্রায় তিন থেকে চারগুণ বেশি শিশু রোগী ভর্তি থাকছে এই বিভাগে।
ওয়ার্ডের চিকিৎসকরা বলছেন, পুরো হাসপাতালে দৈনিক আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার রোগী ভর্তি থাকে। এর মধ্যে কেবল শিশু স্বাস্থ্য বিভাগেই ভর্তি রোগীর সংখ্যা পাঁচশর কিছু কম-বেশি। হিসেবে হাসপাতালের মোট রোগীর উল্লেখযোগ্য অংশই ভর্তি থাকছে শিশু স্বাস্থ্য বিভাগে। যদিও হাসপাতালে মোট ওয়ার্ড সংখ্যা ৪০টির কম নয়। দিন দিন রোগীর চাপ বাড়ায় শয্যা সংকট প্রকট থেকে প্রকটতর হয়েছে শিশু বিভাগে। শয্যা সংকটের কারণে বাধ্য হয়ে এক শয্যায় তিন থেকে চার শিশুকে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে জানিয়ে শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম আজাদীকে বলেন, গরীব-অসহায় পরিবারের শিশু রোগীদের চিকিৎসায় এই হাসপাতালই একমাত্র ভরসা। বৃহত্তর চট্টগ্রামের দূর-দূরান্ত থেকে শিশু রোগীদের এখানে নিয়ে আসা হয়। যার কারণে এখানে সবসময় রোগীর চাপ থাকে। এই সময়ে রোগীর চাপ আরো বেড়েছে। চাপ সামাল দিতে বিভাগের শয্যা সংখ্যা বাড়ানো জরুরি বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।
বিভাগের চিকিৎসকরা বলছেন- ব্রঙ্কিউলাইটিস (শ্বাসকষ্ট), ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়া, সবকয়টি রোগই ভাইরাস জনিত। তবে নিউমোনিয়ার প্রকোপ শিশুদের মাঝে সারা বছর কম-বেশি দেখা গেলেও ব্রঙ্কিউলাইটিসের প্রকোপ তেমন থাকে না। কিন্তু ঋতু পরিবর্তনের সময় আরএসবি (রেসপিরেটরী সিনসেটিয়াল ভাইরাস) ও ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমন জনিত এই রোগটির প্রকোপ হঠাৎ বেড়ে যায়। আর গরম-ঠান্ডায় যোগ হয়েছে ভাইরাল ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ার প্রকোপ। আর এই সময়ে ডেঙ্গুর প্রকোপও উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। হাসপাতালে আসা শিশু রোগীদের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ শ্বাসকষ্টের জটিলতায় (ব্রঙ্কিউলাইটিসে) ভুগছে জানিয়ে শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. সনত কুমার বড়ুয়া বলেন, অনেকে উচ্চ মাত্রায় জ্বরে (হাই ফেভার) আক্রান্ত। এসব শিশুদের ১০২ থেকে ১০৩ ডিগ্রীর বেশি তাপমাত্রা পাওয়া যাচ্ছে। এই জ্বর ৫ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত ভোগাচ্ছে। ভাইরাল জনিত এসব রোগে আতংকিত হওয়ার কিছু নেই বললেও এ নিয়ে অভিভাবকদের সজাগ হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. সনত কুমার বড়ুয়া।
এদিকে, শ্বাসকষ্টের জটিলতায় আক্রান্ত শিশুদের নেবুলাইজড করতে হচ্ছে জানিয়ে শিশু আইসিইউ বিভাগের ইনচার্জ ধীমান চৌধুরী বলছেন, ওয়ার্ডে বেশ কয়টি নেবুলাইজার মেশিন রয়েছে। কিন্তু বেশ কয়দিন ধরে শ্বাসকষ্টের শিশু রোগীর সংখ্যা অত্যধিক হারে বেড়ে গেছে। ৬ ঘণ্টা পরপর শিশু রোগীদের এই নেবুলাইজড করতে হয়। ফলে আরো বেশি সংখ্যক নেবুলাইজার মেশিনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ওয়ার্ডে অন্তত আরো দশটি নেবুলাইজার মেশিন প্রয়োজন বলেও জানান চিকিৎসকরা।
অবশ্য, জরুরি ভাবে শিশু বিভাগে বেশ কয়টি নেবুলাইজার মেশিন সরবরাহ করা হয়েছে জানিয়ে চমেক হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান বলেন, শ্বাসকষ্টের রোগী বেড়ে যাওয়ায় আমরা আরো বেশ কয়টি মেশিন ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- চমেক হাসপাতালের শিশু-স্বাস্থ্য বিভাগে অন্য সময় দৈনিক ৪ থেকে ৫ জন শিশু ব্রঙ্কিউলাইটিস (শ্বাসকষ্ট) রোগে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হতো। কিন্তু গত বেশ কিছুদিন ধরে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে ১৫ থেকে ২০ জন শিশু ভর্তি হচ্ছে। এর মাঝে জ্বরে আক্রান্ত শিশুও রয়েছে। এছাড়া ডায়রিয়া ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশু রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে। সবমিলিয়ে বর্তমানে দৈনিক শতাধিক রোগী শিশু স্বাস্থ্য বিভাগে ভর্তি হচ্ছে।
শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, শিশু ওয়ার্ডের দুটি সাধারণ ইউনিটে মোট ৮৪ শয্যার বিপরীতে ৩৯৪ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। আর বিশেষ চারটি ইউনিটসহ বিভাগের মোট ১৩২ শয্যার বিপরীতে গত কয়েকদিন ধরে প্রায় পাঁচশ শিশু রোগী চিকিৎসাধীন। আগের ২৪ ঘণ্টায় বিভাগে ৯৮ জন শিশু রোগী ভর্তি হয়েছে জানিয়ে শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম বলেন, ২৪ ঘণ্টায় ভর্তিকৃত শিশুদের মাঝে শ্বাসকষ্ট (ব্রঙ্কিউলাইটিস) ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ৫৩ জন শিশু রয়েছে। এছাড়া জ্বর ও ডায়রিয়ায় আক্রান্ত শিশুও রয়েছে। শয্যা সংকটে এক শয্যায় তিন/চারজন শিশুকে রেখে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে বলেও জানান বিভাগীয় প্রধান।
চিকিৎসকের পরামর্শ : ঠান্ডাজনিত রোগের প্রায় সবকয়টি রোগই ভাইরাসজনিত কারণে হয়ে থাকে জানিয়ে শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. সনত কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘ঋতু পরিবর্তন, ঘর স্যাতস্যাতে-অপরিস্কার থাকা, ঠান্ডা-গরমের মিশ্র আবহাওয়া ও ঠান্ডাজনিত কারণে শিশুদের এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এছাড়া আক্রান্ত শিশুর হাঁচি থেকেও ব্রঙ্কিউলাইটিস রোগটি সংক্রমণের ঝুঁকি রয়েছে। মূলত এসব কারণেই আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা বেড়ে যেতে পারে। এ রোগের লক্ষন হিসেবে হঠাৎ কাঁশি বেড়ে যাওয়া, নাক দিয়ে পানি পড়া ও জ্বরের সাথে শ্বাসকষ্ট দেখা দিতে পারে। আর এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে রক্ষা পেতে ঘর ও শিশুকে সব সময় পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, শিশুর নাক পরিস্কার রাখা এবং শিশুর শরীরে ঠান্ডা লাগতে না দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের এই চিকিৎসক। তবে শ্বাসকষ্ট, ডায়রিয়া কিংবা নিউমোনিয়া দেখা দিলে দেরি না করে শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. রেজাউল করিম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিএনপি বেশি বাড়াবাড়ি করলে, খালেদাকে আবারো জেলে পাঠাব : প্রধানমন্ত্রী
পরবর্তী নিবন্ধভেসে আসা মহিষ লুকিয়ে রাখায় জরিমানা