বাংলাদেশ শিশু একাডেমি একটা সেমিনারের আয়োজন করেছিলো। সেমিনারের বিষয় ছিলো ‘শিশুসাহিত্য শিশুর অধিকার’। শিশু একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক শিশুসাহিত্যিক আনজীর লিটনের আমন্ত্রণে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছিলাম আমি। সেই সময়ে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছিলো।
শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে কমবেশি সবাই চিন্তিত। বড়রা তাদের নিয়ে ভাবনায় অস্থির। পৃথিবীতে এ জন্য স্লোগান তৈরি হয়েছে ‘সবার আগে শিশু’। যাঁরা সমাজের অভিভাবক, তাঁদের অনেক দায়িত্ব। তাঁরা গুরুত্বের সঙ্গে বলছেন ‘শিশুরা আগামী দিনের আলো।’ বাংলা ভাষার আরেক মহান কবি অনেক আগেই সমাজের দায়িত্বের কথা বলে গেছেন :
‘এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ মৃত আর ধ্বংসস্তূপ পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাবো, তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’
পৃথিবীর জঞ্জাল সরিয়ে শিশুকে তার বাসযোগ্য করার অঙ্গীকার গ্রহণ খুবই জরুরি। কেননা, অনেকের প্রত্যয় ভরা কণ্ঠে শিশুর সম্ভাবনার কথা শোনা গেলেও সে এখনো নির্যাতনের শিকার। সে অবহেলিত। সুবিধা বঞ্চিত। কোথাও কোথাও সে তার স্বাভাবিক কাজে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। কোথাও না কোথাও সে অপমানিত হচ্ছে। কোথাও ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শ্রম দিতে হচ্ছে। ফলে গোটা পৃথিবী আজ তার জন্য নিবেদিত। সব কটি দেশে শুরু হয়েছে বিশ্ব শিশু আন্দোলন। তার অগ্রযাত্রা ত্বরান্বিত করতে বৃদ্ধি পাচ্ছে জন–সচেতনতা। শিশুর প্রতি নির্যাতন ও অবহেলার বিরুদ্ধে গড়ে তোলা হচ্ছে জনমত। নেওয়া হচ্ছে সামাজিক উদ্যোগ। বিশ্বের এক জননন্দিত মহানায়ক–দক্ষিণ আফ্রিকার বিপ্লবী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘যে জাতি শিশুদের কথা ভাবে না, সেটা কোনো জাতিই নয়।’ তাই বলা যায়, একটি জাতিকে যদি অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিতে হয়, তাহলে প্রথমেই দরকার শিশুর পরিচর্যা। মেধায় মননে শক্তিতে তাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলেই জাতি সমৃদ্ধ হবে।
শিশুর মৌলিক অধিকার বিষয়ে সোচ্চার জাতিসংঘ। প্রণয়ন করা হয়েছে শিশু অধিকার সনদ। এটি জাতিসংঘের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এই সনদ এখন একটি আন্তর্জাতিক আইন।
আইন বলতে গেলে অনেক সময় জটিল মনে হতে পারে। কেননা কালাকানুনকে অনেকে ভয় পায়। তাই এখানে শিশুর অধিকারগুলোকে সহজভাবে দেখার চেষ্টা করি। মোটা দাগে আমরা বলতে পারি, শিশুর অধিকারগুলোকে চারটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এক. বেঁচে থাকার অধিকার। দুই. বিকাশের অধিকার। তিন. সুরক্ষার অধিকার। চার. অংশগ্রহণের অধিকার। আর সব কিছু ভুলে গেলেও মনে হয়, এ চার অধিকারের ব্যাপারটি ভুলবার নয়।
সে শিশু। পদে পদে আজ সে বঞ্চিত। সে এগোতে পারে না। তার অনেক বাধা। তার ভালোভাবে বাঁচা দরকার, পড়াশোনা করা দরকার। খেলাধুলা করা দরকার। কিন্তু সবসময় সে হাসিখুশি থাকতে পারে না। খেলতে পারে না। তার জন্য মাঠই নেই। তাই তার সাহায্য এগিয়ে আসছে অনেক প্রতিষ্ঠান। এগিয়ে আসছে সরকার। এগিয়ে আসছে রাষ্ট্র। শিশুকে সুন্দরভাবে বাঁচানোর জন্য, স্বাভাবিক বেড়ে ওঠার পথকে মসৃণ করার জন্য তারা তৎপর। তার সুষ্ঠু বিকাশের জন্য নানা কর্মসূচি আজ আমরা দেখি। তার প্রতি সহানুভূতিশীল সবাই। আদর, স্নেহ, মমতা ও ভালোবাসা দিয়ে তাকে বড় করে তোলার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। কেননা, শিশুর সুষ্ঠু বিকাশের ওপর নির্ভর করে গোটা জাতির কল্যাণ। সে বড় হোক উদ্দীপনার মাঝে, হয়ে উঠুক আত্মবিশ্বাসী। তার চোখে অবারিত স্বপ্ন। সে হোক স্বপ্ন–রাজ্যের দুরন্ত রাজকুমার।
তার বেঁচে থাকার অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে রয়েছে বিকাশের অধিকার। কীভাবে বিকশিত হবে সে? তার চায় শিক্ষা। তার প্রয়োজন অবকাশ যাপন। তার জন্য জরুরি বিনোদন। মানসিক বিকাশে দরকার সাহিত্য। শিশুসাহিত্য। শিশুসাহিত্য শিশুর অধিকার।
শিশুসাহিত্য কী? শিশুর উপযোগী রচনা। হতে পারে ছড়া, হতে পারে কবিতা, হতে পারে গল্প বা রূপকথা। যেইসব ছড়া শিশু পড়তে ভালোবাসে, যেগুলো তার শৈশবের মতো মজাদার হয়। রঙিন হয়। স্বপ্নময় হয়। ছড়ার সৌন্দর্য তার ছন্দে, তার সুরে। তার তালে তালে দোল খায় শিশু। ছড়া নেচে নেচে যায়, আর ঝলমল করে বেজে ওঠে শিশুর নুপূর।
ভোর হলো দোর খোলো খুকুমনি ওঠরে
ওই ডাকে জুঁই শাখে ফুলখুকি ছোটরে।
ছড়ার সৌন্দর্যের কথা বলতে গিয়ে হুমায়ুন আজাদ লিখেছিলেন : ‘ছড়া সবাইকে মোহিত করে। তোমরা হেমিলনের বাঁশিঅলার কথা শুনেছো। আজ সে–মায়াবী বাঁশিঅলা আর নেই। তাই তোমরা যাবে কার সাথে? যদি জিজ্ঞেস করো, তবে বলবো, নিশ্চয়ই যাবে ছড়ার সাথে। তার বাঁশি আছে, তার জাদু আছে। তার সুর আছে, তার নূপুর আছে। ’
একইভাবে কবিতার কথা বলি। কবিতা ঘুড়ির মতো রঙিন। পাখির মতো মিষ্টি। পাতার মতো সবুজ। এসব কবিতা পড়ে শিশুরা মুগ্ধ হয়। পুলকিত হয়। কবিতার ভিতর জেগে ওঠে স্বপ্ন। কবিতার মধ্য দিয়ে চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি ছবি। বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে কবি শিশুকে নিয়ে যান কল্পনার রাজ্যে। কিছু কিছু বিশেষণ ও উপমা কবিতাকে আকর্ষণীয় করে তোলে।
নারকেলের ওই লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল
ডাবের মতো চাঁদ উঠেছে ঠান্ডা ও গোলগাল।
কিংবা,
এখানে আকাশ নীল, কচি রোদ ঝিলমিল,
এখানে ফুলের মউ ভেসে ভেসে যায়–
এখানে সাগর নদী, ছুটে চলে নিরবধি,
ঘাসের উপরে হাওয়া হেসে হেসে যায়।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিশুর মনের রাজ্যে প্রবেশ করে কল্পনার আলো। তখন সে যেদিকে তাকায়, সব দিকে পায় কবিতার সৌন্দর্যকে। কবিতা তাকে আলোড়িত করে, আন্দোলিত করে, মোহিত করে।
এবার বলি গল্প–উপন্যাস আর রূপকথা নিয়ে। রূপকথা মানে শিশুদের জন্য অপরূপ কথা। রাজা বাদশা, মন্ত্রী উজির, ভূত–পেত্নী, দেবতা, পরিদের নিয়ে কাহিনি। আর গল্প উপন্যাস বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই রচিত হয় মানুষের কাহিনি নিয়ে। মানুষের ঘরে, তার মনে, তার চারদিকে যে সব কাহিনি আছে, তা বলার মতো গল্পই রচনা করেন লেখকরা। মানুষের চারপাশ উঠে আসে গল্পে। মানুষের হাসি–কান্না, আনন্দ–বেদনা, কৌতুক ও স্বপ্নগুলো কাহিনি হয়ে ধরা দেয় লেখকের রচনায়। এসব পড়ে শিশুরা আনন্দিত হয়, উপকৃত হয়। বিজ্ঞান কল্পকাহিনিও আজ হয়ে উঠেছে শিশুদের আকর্ষণের বিষয়। কল্পনা আর বিষ্ময়ের সমন্বয়ে রচিত এ সব কাহিনি শিশুর মনকে বিকশিত করে। সবশেষে এটুকু বলা যায়, শিশুর জন্য ভালো বই রচনা ও প্রকাশ জরুরি। এগুলো পাওয়া শিশুর অধিকার।
বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমির উদ্যোগে দুদিনব্যাপী শিশুসাহিত্য উৎসব ২০২৫ আগামী ২৪ ও ২৫ অক্টোবর (শুক্র ও শনিবার) চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হবে। এ উপলক্ষ্যে গৃহীত কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল ১০টায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। এছাড়াও রয়েছে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, শিশুসাহিত্যিক সম্মাননা, বইয়ের পৃষ্ঠপোষক সম্মাননা, আবৃত্তি প্রতিযোগিতা, লেখা পাঠ, নতুন বইয়ের প্রদর্শনী প্রভৃতি। শিশু ও শিশুদরদিদের দীপ্ত পদচারণায় সফল হোক উৎসব।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী; ফেলো, বাংলা একাডেমি।