শিশুশিক্ষায় মাতৃভাষার গুরুত্ব

তহুরীন সবুর ডালিয়া | শুক্রবার , ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৯:২৪ পূর্বাহ্ণ

মাতৃদুগ্ধ পান করতে করতে মায়ের মুখ থেকে শেখা যে ভাষা তাইই মাতৃভাষা। মায়ের দুধের যেমন বিকল্প নেই, তেমনি বিকল্প নেই মাতৃভাষার। ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বলেছেন, ‘মা, মাতৃভূমি ও মাতৃভাষা এই তিনটি জিনিস মানুষের প্রিয় হওয়া উচিত’।

মূলত একটি জাতির সত্তা তার নিজস্ব ভাষার মধ্যে নিহিত। ভাষার সাহায্যে মানুষ তার প্রত্যয়ের কথা বলে, বিশ্বাসের কথা বলে, ভাব প্রকাশ করে। মাতৃভাষার সাথে জড়িয়ে থাকে একজন ব্যক্তির শৈশব এবং এটিই তার মুখের প্রথম প্রস্ফুটিত বোল। সুতরাং ভাষা যদি নিরুদ্ধ হয়, জাতি তার আত্মপ্রকাশের পথ খুঁজে পায় না।

শিশু শিক্ষায় মাতৃভাষার গুরুত্ব অনেক। মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে কানাডা টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় এর অধ্যাপক জিম কামিন্স বলেন, ‘মাতৃভাষার গুরুত্ব এই কারণে যে বাবামা তাদের মাতৃভাষায় শিশুদের সাথে কথা বলেন, যা শিশুর বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে’। তাঁর গবেষণায় তিনি দেখতে পান, একটি শক্তিশালী মাতৃভাষার মাধ্যমে শিশুরা একইসঙ্গে দুটি বা এমনকি তিনটি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারে। আবার তারা বড় হয়ে বাক্য এবং বাক্য গঠন করে তার মর্মার্থ উপলব্ধি করে, এবং সামগ্রিকভাবে ভাষার ব্যবহারে আরও দক্ষ হয়ে ওঠে। যেমন, কোনও শিশু যদি কোনো শব্দের অর্থ বুঝতে পারার ক্ষমতা বা লাইন বাই লাইন পড়ে অর্থ অনুধাবনে দক্ষতা অর্জন করতে পারে, তবে সে যখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষায় অধ্যয়ন করতে যায়, তখন অতি সহজেই এই দক্ষতাগুলো স্থানান্তরিত হয়ে উক্ত ভাষা সমূহ আয়ত্তে তাকে সাহায্য করে। কিন্তু এই বহুমাত্রিক দক্ষতা সরাসরি দ্বিতীয় বা তৃতীয় ভাষার মাধ্যমে শেখানো অনেক কঠিন। গবেষকদের মতে, ‘শিশুর জ্ঞান এবং দক্ষতা ভাষাজুড়ে স্থানান্তরিত হয়। তবে মাতৃভাষায় শেখানো দক্ষতাগুলো ভাষা শেখার পদ্ধতির মধ্যেও স্থানান্তরিত হতে পারে।’ সুতরাং যদি কোনও শিশু কীভাবে বাক্যটি সরবরাহ করতে হয় এবং কখন এটি ব্যবহার করতে হয় সে সম্পর্কে আরও চিন্তা করতে পারে, তবে তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সঙ্গে সে সহজেই খাপ খাইয়ে নিতে পারে। মাতৃভাষার ব্যবহার শিশুদের সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা এবং শিক্ষার দক্ষতা বিকাশে শুধু সহায়তা করে না, তাদের ব্যক্তিগত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ও বহন করে।

মাতৃভাষা শিশুর উপলব্ধির ধারণা ও মননের স্বাভাবিক সামর্থ্য গড়ে তোলে। স্বাভাবিকভাবেই, এটি তাদের শিক্ষাগত কৃতিত্বসহ তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই স্বাক্ষর রাখে। আর তাই স্কুলে যদি পাঠ দান পদ্ধতি হয় মাতৃভাষার মাধ্যমে তবে তা শিশুর পক্ষে অনুধাবন কর এবং তা আয়ত্ব করা সহজ হয়ে ওঠে। মায়ের মুখের ভাষা বিধায় একজন শিশুর কাছে মাতৃভাষা অন্য যে কোনও ভাষার চেয়ে সহজ। মাতৃভাষায় শেখা শিশুরা তাদের পরিবেশে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করার কারণে আরও বেশি স্কুল উপভোগ করে এবং দ্রুত শিখতে পারে। অন্য ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা লাভে শিক্ষার্থীর দৈহিক মানসিক শক্তির যথেষ্ট অপচয় হয়। সেখানে শিক্ষার সাথে মনের, জীবনের যোগ থাকে না। শিশুশিক্ষা বিষয়ক গবেষক পি শ্রী নায়ার ‘শিক্ষা স্তরে শিক্ষার মাধ্যমের প্রভাব’ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে বলেছেন– ‘শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে যদি শিক্ষার্থীদের ইংরেজি থাকে তবে, শিক্ষার্থীদের শিক্ষার স্তরগুলি নিম্ন স্তরের বিদ্যালয়ের পড়াশোনায় ভোগান্তির কারণ হয়। এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি দরিদ্র পরিবারের শিশুদের উপর পড়ে। কারণ তারা ইংরেজি শিখতে পরিবারের কাছ থেকে খুব কমই সাহায্য পায়’।

দেশ, কাল, ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা সংস্কৃতির মাঝে গভীর মেলবন্ধন রচনা করে মাতৃভাষা। স্বদেশের মাটি ও মানুষের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাবোধ ও দায়বদ্ধতার চেতনা গড়ে ওঠে মাতৃভাষার মাধ্যমে। আজকাল উন্নত যে কোনও দেশে জ্ঞান অর্জন করতে গেলে প্রথমেই শিখতে হয় সেই দেশের ভাষা। আজকের উন্নত দেশগুলো জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রযুক্তি, উন্নত দক্ষ শিক্ষিত সমাজ সব কিছুতেই গুরুত্ব আরোপ করছে মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের উপর। আর তাই সংগত কারণেই মাতৃভাষায় বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহী ছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু। পদার্থবিজ্ঞানী অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন তাঁর যোগ্য উত্তরসূরী। সত্যেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘একমাত্র বিজ্ঞান চর্চাই পারে ভারতবর্ষকে পৃথিবীর প্রথম সারিতে স্থান করে দিতে। আত্মবিশ্বাসের সাথে তাই বিজ্ঞান চর্চা দরকার। আর এই আত্মবিশ্বাস অর্জন সম্ভব একমাত্র মাতৃভাষায় চর্চার মাধ্যমে’। তবেই হবে শিক্ষার সাথে জীবনের প্রকৃত যোগসাধন। সুতরাং শিক্ষার শুরুতেই বাবা মা ও অভিভাবকদের শিশুর ভাষামাধ্যম সম্পর্কে সচেতন হওয়া জরুরি। কেননা, পরিবারের মধ্যেই শিশুশিক্ষার সূচনা ঘটে। পরিবারের ভেতর বাবামা, বড় ভাইবোন ও আত্মীয়স্বজনেরা কোন ভাষায় এবং কিভাবে কথা বলছে, তা অনুকরণের মাধ্যমে শিশু ধাপেধাপে রপ্ত করতে থাকে। এখান থেকেই শিশুরা আয়ত্ত করে ভাষার ব্যবহার ও বাচনিক ভঙ্গি।

শিক্ষায় মাতৃভাষার গুরুত্ব রয়েছে বলেই ১৯৯৯ সালের নভেম্বর মাসে ইউনেস্কো কর্তৃক ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর বাংলা ভাষাকে একুশে ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে উদযাপনের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু দুঃখ এই যেএই প্রিয় মধুর বাংলা ভাষাকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আমরা এখনো পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। পারিনি একুশের আদর্শকে সম্পূণরূপে চেতনায় ধারণ করতে। আমাদের উচ্চ শিক্ষা, গবেষণা এখনো ইংরেজি মাধ্যমে নির্ভরশীল।

শিশু শিক্ষায় তাই প্রথমেই প্রয়োজন মাতৃভাষা। শিশুরাই আলোকোজ্জ্বল আগামীর পথচলা আগামীর নির্মাতা। আগামীতে কেমন হবে আমাদের প্রিয়তম দেশ তা নির্ধারণ করবে আজকের শিশুরাই। তাই সবার আগে প্রয়োজন এই শিশুদের যথার্থ বিকাশ, প্রকৃত শিক্ষায় গড়ে তোলা। পরিবার সমাজ ও রাষ্ট্র সকলের আন্তরিক প্রয়াস ও প্রচেষ্টা এবং সচেতনতাই পারে মাতৃভাষায় শিশুশিক্ষার ক্ষেত্রে সাফল্য বয়ে আনতে। সুতরাং দেশপ্রেম ও মাতৃভাষা প্রীতিকে স্থান দিতে হবে সবার উর্ধ্বে। আমাদের ভাষাবিদ কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী সকলকে এগিয়ে আসতে হবে মাতৃভাষার সমৃদ্ধি সাধনে।

লেখক: কবিপ্রবান্ধিককথাসাহিত্যিক; সাবেক অধ্যক্ষ,

মহিলা কলেজচট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকুশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির তাৎপর্য
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা