সম্প্রতি দেশব্যাপী অনুষ্ঠিত হলো ভিটামিন-এ প্লাস ক্যাম্পেইন। এতে ছিল ০৬ মাস থেকে ০৫ বছর বয়সী শিশুকে ভিটামিন-এ খাওয়ানোর পাশাপাশি শিশু যত্নের প্রধান অনুষঙ্গগুলো নিয়ে মা-বাবার প্রতি পরামর্শদান।
এদেশে প্রতি বছর ৬ বছরের কম বয়সী অনেক শিশু ভিটামিন ‘এ’ এবং অপুষ্টির কারণে দৃষ্টিশক্তি হারায়। বাংলাদেশে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গর্ভবতী মহিলা ভিটামিন ‘এ’ অভাবে রাতকানা রোগে ভোগেন। সাম্প্রতিক তথ্য মতে ভিটামিন ‘এ’এর ঘাটতিপূরণ হলে শিশুমৃত্যু হার ২৮ শতাংশ কমবে। আর ডায়রিয়াজনিত মৃত্যুহার কমে প্রায় ৩৩ শতাংশ।
ভিটামিন-এ শিশুর দৈহিক ও মানসিক বিকাশে ও রোগ প্রতিরোধক শক্তি যোগানোর ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই ভিটামিনকে তাই ‘ ইমিউনিটি ভিটামিন ’ নামে অভিহিত করা হয়।
কোন শিশুদের মধ্যে এ ভিটামিনের অভাব বেশি দেখা দেয়ঃ
ধজন্মের পর পর শিশুকে বুকের শালদুধ পান না করানো হলে, শিশুকে বুকের দুধ না খাওয়ালে।
ধ দীর্ঘ সময় ধরে শিশুকে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাবার খেতে না দিলে।
ধ শিশুকে চর্বি বা ফ্যাট জাতীয় খাবার যেমন তেল কম খাওয়ানো হলে যা ভিটামিন ‘এ’ এর শোষণে সাহায্য করে।
ধ শিশু যদি হাম, ঘন ঘন ডায়রিয়া শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়।
ধশিশুর কৃমি রোগের কারণে।
ধসর্বোপরি শিশু যদি প্রোটিন ক্যালরি ঘাটতিজনিত অপুষ্টিতে ভোগে, শিশুকে যদি শুধু নুনভাত, সাগু, বার্লি, চাউলের গুঁড়া মিশ্রির পানি এসব খাবার দেওয়া হয়।
‘এ’ ভিটামিনের অভাবে কি কি হতে পারে :
ক. চোখে:
যখনই দেখা যাবে কোনো শিশু রাতে ভালো দেখতে পায় না, নিকটস্থ কোনো জিনিস হাত দিয়ে খুঁজতে থাকে তখনই বুঝতে হবে তার শরীরে ভিটামিন ‘এ’ এর অভাব শুরু হয়েছে।
-চোখের ভিতরটা শুষ্ক হয়ে যায়। এমনকি কাঁদলে অনেক সময় চোখের পানি বের হয় না।
-চোখের পর্দা ঘোলাটে হয়ে যায় এবং কালো মণির উপরে এক রকমের সাদা সাদা দাগ পড়ে।
-ভিটামিন ‘এ’-এর অভাব প্রকট হয়ে শিশুর চোখের মণি আস্তে আস্তে পুরোটা সাদা হয়ে যায় এবং শিশু সম্পূর্ণ অন্ধ হয়ে যায়। একেই বলে জেরপথ্যালমিয়া ।
খ. ত্বক শুষ্ক ও খসখসে হয়ে অনেক সময় ব্যাঙের চামড়ার মতো হয়ে উঠতে পারে।
গ. ঘন ঘন সংক্রমণে আক্রান্ত হবার ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে শ্বাসনালি ও মূত্রনালির সংক্রমণ।
ঘ. শিশু ঠিকমতো বাড়ে না, শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়। ‘এ’ ভিটামিনের অভাবে অন্ধ হয়ে যাওয়া প্রতি ২ জনের ১ জন এক মাসের মধ্যে মারা যায়, পরিসংখ্যানে এরকম দেখা যায়।
‘এ’ ভিটামিন অভাবজনিত রোগ প্রতিরোধের পদক্ষেপসমূহ :
১. ডেলিভারির দুসপ্তাহের মধ্যে প্রসূতি মাকে ২ লাখ ইউনিটের ১ ডোজ ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খেতে দেওয়া।
২. শিশুকে বুকের শালদুধসহ পূর্ণ ২ বছর বয়স পর্যন্ত সম্ভব হলে আরো দীর্ঘ সময় ধরে বুকের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যাওয়া, বুকের দুধ হচ্ছে ভিটামিন ‘এ’ এর সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ উৎস।
৩. ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাবার শিশুকে খাওয়ানো। সবুজ ও রঙিন শাকসবজি, লালশাক, কচুশাক, গাজর, পেঁপে, মিষ্টি কুমড়া, আম, মলা মাছ, ডিমের কুসুম, ইত্যাদি খাবারের মাঝে যথেষ্ট পরিমাণ ‘ভিটামিন এ’ থাকে। শিশুকে ডিম, দুধ, মাখন, ঘি ইত্যাদি খাইয়ে ভিটামিন ‘এ’ এর চাহিদা পূরণ করতে পারেন।
৪. গর্ভবতী ও প্রসূতি মাকে তার পুষ্টি এবং শিশুর সুস্বাস্থ্যের জন্য বেশি করে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ সবুজ শাক সবজি এবং হলুদ ফলমূল খেতে হবে।
৫. অন্ধত্ব ও মৃত্যুঝুঁকি কমানোর জন্য ১ থেকে ৬ বছরের শিশুকে বছরে দুবার ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ান।
প্রয়োজনের সময় ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুলের সাহায্যে চিকিৎসা :
নিম্নলিখিত রোগের বেলায় ৪ সপ্তাহের মধ্যে রোগী ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল না খেয়ে থাকলে নির্দিষ্ট ডোজ বা মাত্রা অনুযায়ী ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ান, প্রতি ডোজ বয়স অনুযায়ী নির্দিষ্ট করা আছে। যেমন-
৬মাসের নিচে ৫০০০ আই. ইউ. ৬-১১ মাস ১০০০০০০ আই.ইউ. (নীল রঙের ক্যাপসুল) ১ বছরের উপরে ২০০০০০ আই.ইউ (লাল রঙের ক্যাপসুল )। ১টি ক্যাপসুলে ২০০০০০ আই.ইউ বা ৮ ফোঁটা ভিটামিন ‘এ’ থাকে।
১. রাতকানা, বিটটস স্পট, জেরফ থালমিয়া-তিন ডোজ যথাক্রমে ১ম দিন, ২য় দিন ও ১৪তম দিন।
২. হাম- দুই ডোজ ১ম দিন ও ২য় দিন।
৩. ডায়রিয়া, শ্বাসনালীর প্রদাহ- ১ ডোজ প্রতিবার অসুখের পরে।
৪. মারাত্মক অপুষ্টি একডোজ।
চিকিৎসা :
ধ রাতকানা রোগে বা জেরপথ্যালমিয়া রোগে আক্রান্ত শিশু যদি ১ বছরের বেশি বয়সী হয়, তবে প্রতিটি ২ লাখ ইউনিটের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়াতে হবে। ১ম ডোজ-১ম দিন। ২য় ডোজ-২য় দিন, ৩য় ডোজ-২ সপ্তাহ পর।
ধ১ বছরের কমবয়সী শিশুরা একই নিয়মে ৩ দিন এই ওষুধ খাবে তবে প্রতিটি ডোজ অর্ধেক মাত্রায় (১ লাখ ইউনিট অর্থাৎ প্রতিবারে ৪ ফোঁটা করে)।
ধমিজেলস বা হামরোগে আক্রান্তপ্রতিটি শিশুকে অবশ্যই উপরের নিয়মে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়াতে হবে।
অতিরিক্ত ‘এ-ভিটামিন’ জনিত পয়জনিং
এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে ভিটামিন শরীরের জন্য অবশ্য প্রয়োজনীয় এক উপাদান। কিন্তু তার আধিক্য বিষক্রিয়া উৎপন্ন করে।
ইনফ্যান্ট শিশুকে একত্রে ১ লাখ মাইক্রোগ্রাম বা তার বেশি মাত্রার এ-ভিটামিন দেয়া হলে ‘একিউট পয়জনিং’ দেখা দিতে পারে। বমি বমি ভাব, বমি, ঝিমানো, মাথার চাঁদি ফুলে যাওয়া, তীব্রতা অনুযায়ী চোখ ট্যারা অবস্থা, ক্রেনিয়েল নার্ভ পোলসি ও ব্রেইন টিউমারের মতো লক্ষণাদি নিয়ে তা প্রকাশ পায়।
অন্যদিকে অনেক সপ্তাহ বা মাস ধরে শিশুকে এ-ভিটামিন ওষুধ খাওয়ানো হলে তার মধ্যে ক্রনিক এ-ভিটামিনজনিত পয়জনিং দেখা দিতে পারে। এর লক্ষণ হিসেবে শিশুর খিদে লোপ পায়, সারা শরীর চুলকায়, চুল পড়ে যেতে পারে। মুখের কোণায় ঘা, চামড়ায় নানা ক্ষত, লিভার বড় হয়ে যাওয়া, অস্থিতে ব্যথা প্রভৃতি উপসর্গ নিয়ে মাঝে মাঝে শিশুকে চিকিৎসকের কাছে হাজির করানো হয়। কাজেই চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতিরেকে ভিটামিন খাওয়ানোর মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে হবে।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।