১৮৫১ সালে বের হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের ‘বোধোদয়’। এর ভূমিকায় লেখা হয়, ‘অল্পবয়স্ক সুকুমারমতি বালক–বালিকা অনায়াসে বুঝিতে পারিবে, এই আশায় অতি সরল ভাষায় লিখিবার নিমিত্ত সবিশেষ যত্ন করিয়াছি’। এখান থেকে স্পষ্ট অল্পবয়স্ক, ছোট বা শিশুদের জন্য লিখতে হবে সহজ–সরল ও সাবলীল ভাষায়। কারণ সহজ না হলে শিশুরা বুঝতে পারবে না। বুঝতে না পারলে তাদের আকর্ষণ করবে না। তখন শিশু পড়ায় আগ্রহ হারাবে। শিশুদের জন্য সহজ করে লেখা অত সহজ নয়, কঠিন। সেই কঠিন কাজটাই করে যাচ্ছেন শিশুসাহিত্যিকরা। শিশুমনকে কল্পনা ও আনন্দে ভরিয়ে দিতে রচনা করছেন শিশুসাহিত্য।
রকমারি গল্পে ভরপুর শিশুসাহিত্য। শিশুসহিত্যিক আনজীর লিটনের মতে, ‘জীবনের কথা, মায়া–মমতার কথা, বড় হয়ে ওঠার কথা– সব কথাই বর্ণিল হয়ে উঠেছে শিশু–কিশোরদের গল্পকথায়। এসব গল্পে নীতি–নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চরম উপদেশগুলো অতিমাত্রায় অনিবার্য হয়ে উঠেছে কখনো–কখনো। কল্পনার তুমুল আলোড়ন যেমন আছে, তেমনি এসব গল্পে আছে অবিশ্বাস্য ফ্যান্টাসি জগতের কাণ্ডকীর্তি। না দেখা ভূতের হাতছানিও গল্পের জগতে কখনো ভয় যুগিয়েছে, আবার ভূতকে তাড়িয়ে দেবার বাসনা নিয়ে শিশু–নায়করা ঘোড়ায় চড়ে ছুটেছে টগবগিয়ে। কত রাজকুমার, ডালিমকুমার ছুটে বেড়িয়েছে গুপ্তধনের সন্ধানে। লালপরি–নীলপরিরা শিশু–কিশোরদের জন্য তৈরি করে দিয়েছে স্বপ্নময় ভুবন। এ সব নিয়েই সমৃদ্ধ হয়েছে শিশুসাহিত্যের ভাণ্ডার।’
বর্তমানে যারা শিশু–কিশোরদের উপযোগী সাহিত্য রচনা করছেন তাদের মধ্যে চট্টগ্রামের অনেক খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিক রয়েছেন। নগরের সিআরবি শিরীষ তলায় চলছে বইমেলা। মেলা উপলক্ষে চট্টগ্রামের শিশুসাহিত্যিকদের প্রায় শতাধিক বই বেরিয়েছে। এর মধ্যে পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছে অনেকগুলো। প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে শিশুদের ছড়া, রূপকথা, কবিতা, ধাঁধা ও গল্পের বই। আছে কিশোর গল্প ও উপন্যাস, কিশোর রহস্য, গোয়েন্দা কাহিনি, ভৌতিক উপন্যাস, সায়েন্স ফিকশন, বিজ্ঞান ও সাধারণ জ্ঞানের বই উল্লেখযোগ্য। প্রায়–প্রতিদিন অভিভাবকরা এসব বই কিনে দিচ্ছেন তাদের সন্তানদের। শিশু–কিশোরদেরও সেইসব বই কিনে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখা গেছে।
গতকাল সন্ধ্যায় রং পেনসিল–এর স্টলে মায়ের সঙ্গে মেলায় আসা নীলা নামের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীকে দেখা গেছে, ভূতের গল্পের বই খুঁজতে। গল্পের পাশাপাশি তাকে ছড়ার বইও কিনে দেয় তার মা। নীলার মা দোলা আজাদীকে বলেন, মেয়েকে তার পছন্দের বই কিনে দিলাম। যাতে সে বই পড়তে উৎসাহী হয়।
আদিগন্ত প্রকাশন–এর আরিফ রায়হান আজাদীকে বলেন, শিশুদের বই সবসময় বেশি চলে। বন্ধের দিন একটু বেশি বিক্রি হয়। তিনি বলেন, শিশুদের কিছু বই আছে যেগুলো মৌলিক নয়। মৌলিক নয় এমন পাইরেসি বইগুলো ফুটপাতেও বিক্রি হয়। সেগুলোর ছাপা এবং কাগজের মান দুর্বল। এসব বই বইমেলায় রাখার যৌক্তিকতা নেই। আবার এসব বই বিক্রি করা হয় মনগড়া মূল্যে।
শৈলী প্রকাশন–এর বিক্রয়কর্মী হিসাম হিমু আজাদীকে বলেন, শিশু–কিশোর উপযোগী বই বেশি চলে। ‘হাটের কাছে রুপোর সাঁকো’, ‘বাক্সোবন্দী ভূত’ এবং ‘আয়রে আমার রূপালি রূপকথা’ বেশি চলছে। রং পেনসিল–এর বিক্রয়কর্মী বলেন, ধাঁধা এবং উপদেশমূলক গল্পের বই বেশি চলছে। শুরুতে বিক্রি কম হলেও এখন বেড়েছে। বাবুই–এর এক বিক্রয়কর্মী বলেন, শিশুদের বই ভালো চলছে। আমাদের স্টল শিশু কর্নারে হলে হয়তো আরেকটু বেশি সাড়া পেতাম।
নতুন বইয়ের খবর :
এবার প্রকাশিত শিশু ও কিশোর উপযোগী গ্রন্থের মধ্যে পাঠকের মন জয় করেছে এজাজ ইউসুফীর ‘উটকো বুড়োর ছুটকো ছড়া’, রাশেদ রউফের ‘আয়রে আমার রূপালি রূপকথা’ ও শ্রেষ্ঠ কিশোর গল্প’, ওমর কায়সারের ‘এই রোদ্দুর যাবে কদ্দুর’, জাহেদ মোতালেবের ‘পোকা বিজ্ঞানী’, দীপক বড়ুয়ার ‘বন পাহাড়ের দত্যি’, রশীদ এনামের ‘শিয়াল ও বনমোরগের লড়াই’, সিমলা চৌধুরীর ‘বাক্সোবন্দী ভূত’, বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘লাল বাড়িটা ডেঞ্জারাস’।
শুধু ছোটদের নয়, বড়দেরও আনন্দ দেবে রাশেদ রউফের কিশোর কবিতার বই ‘আয়রে আমার রূপালি রূপকথা’। ‘চারপাশের জগৎ, জীবন এবং নির্সগমাধুরী তার অনুভবে যে আলো আর স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দেয় রাশেদ রউফ তার শব্দচয়নে ছন্দ–নৈপুণ্যে, উপমা আর চিত্রকল্পে সেই অনুভবকেই অপরূপ কুশলতায় রূপায়িত করেছেন’।
‘মানুষের খাবার উপযোগী একটি পোকা খুঁজে বেড়াচ্ছেন পোকা বিজ্ঞানী। খুঁজতে খুঁজতে একদিন তিনি নিজেই হারিয়ে গেলেন। দশ বন্ধু, সক্রেটিস ও বুড়া দাদু তাঁকে খুঁজতে বেরিয়েছেন। তারা কি বিজ্ঞানীকে খুঁজে পাবেন? আর পোকা? পোকাটা কোথায়? উত্তর মিলবে জাহেদ মোতালেবের গুপ্তধন সিরিজের দ্বিতীয় বই ‘পোকা বিজ্ঞানী’–এ। বইটি পাওয়া যাবে ‘চন্দ্রবিন্দু’ স্টলে। এবার চন্দ্রবিন্দু প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে বেস্ট সেলার ১০ বইয়ের তালিকায় আছে ‘পোকা বিজ্ঞানী’।
অর্কিড, বিশাল, অর্নব, দীপন, সরল ও অনুপ। সবাই একসঙ্গে একই স্কুলে পড়ে। এবার পঞ্চম শ্রেণিতে উঠেছে তারা। অর্কিডের বাড়ি রাঙামাটি পাহাড়ে। একদিন অর্কিড তার বন্ধুদের বন পাহাড়ে দত্যি দেখতে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। ভয় পলেও সবাই রাজি হয়। শুক্রবার সন্ধ্যায় তারা দত্যি দেখতে বেরুয়। একসময় পাহাড়ের চূড়োয় উঠে অর্কিডের দল। ভীষণ অন্ধকার। সত্যি তো দূরে দত্যিদল দেখা যাচ্ছে। কিন্তু একি দত্যিগুলোর তাদের দিকে আসছে কেন? এখন কী হবে অর্কিডদের? জানতে হলে পড়তে হবে দীপক বড়ুয়ার ‘বন পাহাড়ের দত্যি’। বইটি পাওয়া যাচ্ছে শৈলী প্রকাশনের স্টলে।
কবি হিসেবেই খ্যাতি আছে এজাজ ইউসুফীর। এবার আদিগন্ত প্রকাশন থেকে বেরিয়েছে ‘উটকো বুড়োর ছুটকো ছড়া’ গ্রন্থ। তিনি বলেন, আমি কখনো ছড়ার প্রতি আগ্রহী ছিলাম না। কারণ, আমার মধ্যে শিশুতোষ ভাবনার কমতি ছিল। ছোটবেলা থেকেই সবকিছুকে সিরিয়াসভাবে নেয়ার ফলে ছড়ার দোলা আমাকে কখনোই টানেনি। কিন্তু জীবনের পড়ন্তবেলায় সেই কঠোরতা লঘু হতে শুরু করেছে। কিছু শিশুতোষ ছড়ার পাশাপাশি সমাজের নানান অসঙ্গতি ও রাজনীতি কী শ্লেষধর্মী ছড়া উঁকি দিচ্ছে মনে। তারই প্রকাশ ‘উটকো বুড়োর ছুটকো ছড়া’।
১১টি গল্প আছে রশীদ এনামের ‘শিয়াল ও বনমোরগের লড়াই’–এ। গল্পগুলো পড়ে ‘ছোটোরা শুধু নতুন চমকে ও ভাবনায় অভিভূত হবে না, পাবে বড়ো হওয়ার স্বপ্নের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণাও’। বইটির প্রকাশক আদিগন্ত প্রকাশন।
‘এই রোদ্দুর যাবে কদ্দুর’ গ্রন্থে ‘ঐতিহ্য, ইতিহাস, বর্তমান বাস্তবতা, স্বপ্ন, কল্পনা, রূপকথা আর অপরূপ কথার সমন্বয়ে একটা বিষ্ময়ের জগত ও একটা ঘোর তৈরি করেছেন কবি ওমর কায়সার, যে জগতে প্রবেশ করে শিশু তার পৃথিবীটাকে নিজের মতো করে ভালোবাসতে শিখবে।’
‘বন্ধু শিহাবকে নিয়ে মামাবাড়িতে বেড়াতে এসেছে রাজীব। হঠাৎ জানা গেল, গ্রামের শেষ মাথায় একটা ভুতুড়ে বাড়ি আছে। ভয়ে কেউ সেখানে যায় না। গেলে ফিরে আসতে পারে না। রাজীবের বন্ধু শিহাব দারুণ সাহসী ছেলে। লাল বাড়িটার ভেতর ঢুকতে চায় সে। বাড়িটা কিন্তু ডেঞ্জারাস!’ শিহাব কি শেষ পর্যন্ত বাড়িটাতে ঢুকতে পেরেছে? শিহাব ও রাজীব কি ভুতুড়ে সে বাড়ির রহস্য উন্মোচন করতে পেরেছে? তা জানা যাবে বিশ্বজিৎ চৌধুরীর কিশোর উপন্যাস ‘লাল বাড়িটা ডেঞ্জারাস’ গ্রন্থে।
‘ছোটদের বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি এবং তাদের কল্পনাশক্তিকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন’ ‘বাক্সোবন্দী ভূত’ এর লেখক। ‘প্রাঞ্জল ও সবলীল ভাষায় শিশু মনের কল্পনা, ভালোলাগা, মন্দলাগা, তাদের প্রতি পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি চমৎকারভাবে উপস্থাপিত হয়েছে ‘জাদুর কুমির’ গল্পগ্রন্থে। ‘বহুরূপী জলপরী’ গ্রন্থে ১০ টি গল্প আছে। কোনোটি রূপকথার বা রূপকথার আদলে লেখা শিক্ষামূলক গল্প। আছে বিজ্ঞান, নীতিকথাও’। ‘প্রাবিতা’ হচ্ছে প্রাণি নিয়ে লেখা ছোটদের উপযোগী কবিতার বই। যেখানে আছে নানা রঙের ছবিও।
শিশু–কিশোর উপযোগী প্রকাশিত অন্যান্য বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– সোহেল মাহরুফের ‘ভূতের বাড়ি, সুবর্ণা দাশ মুনমুনের ‘হাটের কাছে রুপোর সাঁকো’ সালাম সৌরভের ‘ইচ্ছে ডানায় স্বপ্ন মাখি’, শিরিন আফরোজের ‘বঙ্গবন্ধু তুমি বাংলাদেশের প্রাণ’, শান্তময় দাশের ‘তেতুল গাছে ভূত’, সুসেন কান্তি দাশের ‘জাদুর কুমির’, অমিত কুমার কুণ্ডুর ‘বহুরূপী জলপরি’, জোনাকী দত্তের ‘টুনটুনির বিয়ে’, মিজানুর রহমান শামীমের ‘অল্পকথার উপদেশমূলক গল্প’, আখতারুল ইসলামের ‘আমাদের দেশটা স্বপ্নপুরী’, সরোয়ার রানার ‘ষড়ঋতুর বাংলাদেশ’, অধ্যাপক ড. আবদুল মালেক ভূঁইয়ার ‘প্রাবিতা’, অধ্যক্ষ এম সোলাইমান কাসেমীর ‘সাহাবিদের গল্প’, লিপি বড়ুয়ার ‘আলোর পাখি শেখ রাসেল’, সুমন্ত আসলামের ‘পাঁচজন দুষ্টু ছেলে’, মোস্তাক শরীফের ‘হাফপ্যান্ট’, প্রিয়াংকা ময়ী দেবীর ‘দুষ্টু বুড়ির মিষ্টি হাসি’, জয়নুল টিটোর ‘পয়েন্ট ওয়াই’, এফ কে সয়ফলের ‘ব্যাঙ কাটার ক্লাস’, ড. মোহাম্মদ শাহ্ হাফেজ কবিরের ‘ভূতধরা সংঘ ও অন্যান্য গল্প’, বাসুদেব খাস্তগীরের ‘বীর কিশোরের গল্প’ ও কাসেম আলী রানার ‘চিত্রমানব’।
মেলা মঞ্চে বিতর্ক উৎসব :
গতকাল সোমবার বইমেলা মঞ্চে আয়োজন করা হয় ‘বিতর্ক উৎসব’। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রাক্তন বিতার্কিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ডা. আবদুন নূর তুষার। নাট্যজন আহমেদ ইকবাল হায়দারের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন চবি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের প্রফেসর ড. আদনান মান্নান, চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ–পরিচালক ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া, সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেডের আঞ্চলিক প্রধান রাশেদুল আমিন রাশেদ। ডা. আবদুন নূর তুষার বলেন, যুক্তি নির্ভর বিজ্ঞানমনস্ক আলোকিত মানুষ গড়তে বিতর্কচর্চা খুবই ফলপ্রসূ অবদান রাখতে পারে।