শিশুদের ওপর কেন এই নিষ্ঠুরতা

বর্ষা, আয়াত ও মাহিয়া খুন

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১০ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৮:১২ পূর্বাহ্ণ

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আর্জেন্টিনার জার্সি পরা শিশু আয়াতের ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে গত কদিন ধরে। ছবির ক্যাপশন মনুষ্যত্বকে একবার হলেও নাড়া দিচ্ছে। গত ১৫ নভেম্বর বিকেলে বাড়ির পাশের মাদরাসায় আরবি পড়তে গিয়ে আর বাসায় ফিরে আসেনি আয়াত। ১০ দিন পর পিবিআইয়ের কল্যাণে আয়াতকে খণ্ডিত অবস্থায় খুঁজে পায় তার পরিবার। খুনি ধরা পড়ে এবং আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়, কখন কেন কীভাবে কী করেছে। আবির নামে ১৯ বছরের এক তরুণ এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে ক্রাইম পেট্রল দেখার অভিজ্ঞতা বাস্তবায়ন করার মানসে। চট্টগ্রামে এভাবে একের পর এক খুন ও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুরা। শিশুর প্রতি এমন ভয়ানক নিষ্ঠুরতায় সর্বত্রই উদ্বেগ-আতঙ্ক বিরাজ করছে। শিশুদের নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, পারিবারিক ও সামাজিক অস্থিরতা, অপসংস্কৃতির নেতিবাচক প্রভাব এবং নৈতিক শিক্ষার অভাবে বাড়ছে এমন নৃশংসতা। আর অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক সাজার নজির না থাকায় এ ভয়ঙ্কর অপরাধ বেড়েই চলেছে।
শিশুর প্রতি সহিংসতাকে একটি সামাজিক সমস্যা অভিহিত করে সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন আজাদীকে বলেন, যখন কেউ ধর্ষণ বা হত্যা করে তখন সে আনকনশাস থাকে। অবদমিত প্রবৃত্তি তখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ ধরনের ঘটনা বাড়তে দিলে সামাজিকীকরণ থাকবে না। আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ হওয়া উচিত। পাশাপাশি পারিবারিক অনুশাসন ও মানুষে মানুষে সামাজিক সম্পর্কটা বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনার মধ্যে সাইকোলজিক্যাল একটি ব্যাপারও কাজ করে। কোনো স্থানে একজন করল। তা প্রচার হওয়ার পর দেখা যায় একনাগাড়ে এখানে-ওখানে হতেই থাকে। কারণ যাদের মধ্যে সেই আদিম মনোবৃত্তি দমানো যায়নি তারা ঘটনার সংবাদটি জেনে উদ্বুদ্ধ হয়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিশুরা পরিচিতজন কিংবা প্রতিবেশীদের দ্বারাই নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। সভ্য সমাজে এমন জঘন্য নিষ্ঠুরতা কল্পনা করা যায় না।
নগরী ও নগরীর বাইরে বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ঘটছে এ রকম ঘটনা। ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই শিশু এবং কিশোর-কিশোরী, যাদের বয়স পাঁচ থেকে ১৭ বছর। চট্টগ্রামে গত ছয় মাসে এমন নিষ্ঠুরতায় প্রাণ গেছে অন্তত ৯ শিশুর।
গত ৮ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় চকলেটের প্রলোভন দেখিয়ে ৫ বছরের এক শিশুকে ধর্ষণের অভিযোগে পারভেজ নামে এক যুবককে গণধোলাইয়ের পর পুলিশে সোপর্দ করেছে গ্রামবাসী। ২ ডিসেম্বর দুপুরে সীতাকুণ্ডের বড় কুমিরা বাজার এলাকায় পেয়ারার লোভ দেখিয়ে পাঁচ বছর বয়সী এক কন্যা শিশুকে ধর্ষণ করে মামুন নামে এক যুবক। ভুক্তভোগী শিশুটির মায়ের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ৮ ডিসেম্বর তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গত ৩০ নভেম্বর মহেশখালীতে মাহিয়া নামের ৭ বছরের এক শিশু খুনের ঘটনা ঘটে। অপহরণের তিন দিন পর ৩ ডিসেম্বর বিকেলে পার্শ্ববর্তী খাল থেকে শিশুটির লাশ উদ্ধার করা হয়। নিহত শিশুর পিতা আয়াত উল্লাহ জানান, ঘটনার পর থেকে তার কয়েকজন ভাড়াটিয়া পলাতক
রয়েছে। ধারণা করছি মাহিয়াকে মুক্তিপণ আদায়ের উদ্দেশ্যে তারা অপহরণ করেছিল। অপহরণের পর অজ্ঞাত একটি মোবাইল ফোনের মাধ্যমে তার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। মুক্তিপণ না পাওয়ায় মেয়েকে হত্যা করে লাশ খালে ফেলে দিয়েছে।
২৭ নভেম্বর নগরীর বাকলিয়ায় দুই বছরের শিশুকে ধর্ষণের ঘটনায় জামাই বাজার এলাকা থেকে দুলাল নামে এক কেয়ারটেকারকে গ্রেপ্তার করা হয়। শিশুটির মা কাজের জন্য বাইরে গেলে শনিবার দুপুরে এই ঘটনা ঘটে।
১৫ নভেম্বর বিকেলে নগরীর ইপিজেড থানার নয়ারহাট এলাকার বাসিন্দা সোহেল রানার পাঁচ বছর বয়সী সন্তান আলীনা ইসলাম আয়াত নিখোঁজ হন। ১০ দিনের মাথায় পিবিআই আবির আলীকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে নিখোঁজ রহস্য উদঘাটন করে। পিবিআইয়ের ভাষ্যমতে, মুক্তিপণ আদায়ের জন্য আয়াতকে অপহরণ ও পরে হত্যা করে আবির আলী।
২ নভেম্বর নগরীর আকবরশাহ থানাধীন উত্তর কাট্টলী এলাকায় ৫ বছরের শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। শিশুটিকে চিপসের লোভ দেখিয়ে এ ঘটনা ঘটায় মো. আলমগীর খান নামের এক রিকশা চালক। ৩০ অক্টোবর শুলকবহর এলাকায় শিক্ষার্থীকে বলাৎকারের অভিযোগে শিক্ষক মোহাম্মদ ইসহাককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
২৪ অক্টোবর জামালখানে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় বর্ষা নামে এক শিশুকে। তিনদিন পর পার্শ্ববর্তী নালা থেকে শিশুটির বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় স্থানীয় মুদি দোকানের কর্মচারী ধর্ষক লক্ষ্মণ দাস (২৮) নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৫ অক্টোবর দুপুরে নগরীর খুলশী এলাকায় একটি ভবনের পেছনে নিয়ে গিয়ে ৮ বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে প্রতিবেশী নানা নজির আহম্মদ (৫২)।
১৮ সেপ্টেম্বর বন্দর থানাধীন আবাসিক পোর্ট কলোনির আট নম্বর রোডের একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে সাত বছর বয়সী শিশু সুরমা আক্তারের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ধর্ষণের পর তাকে হত্যা করে ওসমান হারুন মিন্টু নামে এক রিকশাচালক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসম্মেলন নিয়ে সংশয়ে নেতাকর্মীরা
পরবর্তী নিবন্ধ৭৮৬