শিল্পের বিপ্লবী প্রবাহ

থিয়েটার মেশিন

কামালউদ্দিন নীলু | শুক্রবার , ১৭ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

বিপ্লবের দীর্ঘ প্রতিধ্বনির প্রতি সাড়া দিতে গিয়ে রিচার্ড ভাগনার এবং আনাতোলি লুনাচারস্কি “বিপ্লব ও শিল্পের সম্পর্কগুলোর জটিল রেখা” নিয়ে যা বলতে চেয়েছেন, সেইসব নিয়ে আমার এই ছোট্ট পর্যালোচনা। আমার এই পর্যালোচনাটি হয়তো কিছুটা হলেও কাজে লাগতে পারে আমাদের শিল্পের গতিপথ ও ভাবনার জায়গাটা তৈরির ক্ষেত্রে। এটাকে তত্ত্ব হিসেবে না ধরে একটা ধারণা হিসেবে ধরে এগোলেই বোধ হয় ভালো হয়; যেহেতু কথাগুলো আমি আমার অভিজ্ঞতার একটা পারস্পরিক স্থান থেকে বলার চেষ্টা করছি।

শুরুটা এইভাবে করা যাক, সময়টা ১৮৪৯ সাল, জার্মানিতে ব্যর্থ বুর্জোয়া বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে ভাগনার লিখেছেন “আর্ট অ্যান্ড দ্য রেভোল্যুশন”, এবং এর সত্তর বছর পরে লুনাচারস্কিসফল অক্টোবর বিপ্লবের পরে উত্তরবিপ্লবী সাংস্কৃতিক নীতিগুলোর প্রথম অভিজ্ঞতাগুলোর আলোকে লিখলেন, ” “রেভোল্যুশন অ্যান্ড আর্ট”। এই দুটো তত্ত্বই আমার কাছে শিল্পের শিক্ষা ও জ্ঞানের মধ্যে ঘোরাফেরা করবার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী প্রতিনিধি বলে মনে হয়, যদিও দুজনেই তাদের বিপরীত ভাবাদর্শকে প্রতিফলিত করেছিলেন, শিল্প ও বিপ্লবের একটা ন্যূনতম এবং তাৎপর্যপূর্ণ ভিন্নতাকে স্পষ্টভাবে প্রদর্শন করার মাধ্যমে। ভাগনার মনে করতেন বিপ্লব অনুসরণ করে শিল্পকে, আর লুনাচারস্কি মনে করতেন শিল্প অনুসরণ করে বিপ্লবকে।

এই দ্বৈবিধ্য অবস্থার মধ্যে আমাদের বাংলা সংস্কৃতির ‘বুড়ো বুড়ো (মার্কসবাদী) পন্ডিতদের ব্যাখ্যাস্রেফ ঢপের কর্তাভজা গান’ঘুরপাক খেতে খেতে পাগলা ঘুড়ির মতো একটা শুন্য আকাশে বিচরণ করছে। কোনটা সঠিক আর কোনটা বেঠিক এই তাত্ত্বিক তর্কাতর্কির মধ্যেই বসবাস করতে যেয়ে আমরা আজ কোথাও থিতু হতে পারলাম (না)? এখনও খুঁজে চলেছি, শুদ্ধ ও অশুদ্ধের ভেদাভেদ। খানিকটা আমার গল্প, “মুখবিহীন কন্ঠস্বর”এর বাঁদরদের অন্ডকোষ পরিষ্কারের মতো।

যাক সে কথা। যেটা বলতে চাইছি সেটা হচ্ছে; একদিকে রয়্যাল কোর্টের দক্ষ পরিচালক ও পরিপূর্ণ শিল্পকর্মের প্রতিনিধি ভাগনার, যার জাতীয়তাবাদী, উগ্র স্বদেশভক্তিসম্পন্ন, ইহুদীবিরোধী বক্তৃতাগুলোর জন্যে তিনি হয়ে উঠলেন নন্দনতত্ত্বের রাজনীতির পুরোধা। অন্যদিকে লুনাচারস্কি, ১৯২৯ সাল অবধি লেনিন ও স্তালিনের অধীনে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাংস্কৃতিক নীতিগুলোর বিকাশের জন্য “পৌলেটেয়্যারাইঅ্যান কালচার” তত্ত্বের প্রবক্তা একটু অন্যভাবে বলা যায় “সর্বহারা সংস্কৃতি”র পুরুত ঠাকুর হয়ে উঠলেন– “উত্তরদক্ষিণ” বলয়ের মধ্যে।

প্রসঙ্গক্রমে একটু বলে নিই ১৮৪৮ এর কাছাকাছি সময় প্রুধোঁ, ফয়ারবাখ এবং বাকুনিনের ভাবনাগুলোর অস্পষ্ট প্রভাবের কারণে ভাগনার তার আটোঁসাঁটো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংগীতাশ্রয়ী ভাবনাচিন্তার বাইরেও বিচ্ছুরিত বিপ্লবী সুরকে যুক্ত করেছিলেন। অন্যদিকে লুনাচারস্কির মনোভাবটি গড়ে উঠেছিল শিল্পের প্রকাশের মধ্যে লেনিনের তত্ত্বের সদ্ব্যবহার এবং এগুলো বামপন্থী সর্বহারা সংস্কৃতির নীরিক্ষাগুলোর ভেতরে ফেলে একটা সেতুবন্ধন তৈরি করার মাধ্যমে। আমার কাছে এই সেতুবন্ধন সকল সময় মনে হয়েছে একটা অদ্ভুত রক্ষণশীল অবস্থা, যা কেবলই সমাজতান্ত্রিকদের উদ্ভাবনকেই বাধা দেয়নি, বরং বুর্জোয়া সমাজের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মধ্যে নিজেকে জোরালোভাবে স্থাপন করেছেন। যেমনটি আজকাল বাংলাদেশের কোনো এক নাট্য কর্তাব্যক্তি থিয়েটারকে ঢুকিয়ে দিলেন বুর্জোয়া সমাজের ড্রইংরুমে। এনিয়ে কারো কোনো কথা বলার নেই যেহেতু থিয়েটার নানারূপে হবে এবং হবারই কথা। কিন্তু আমার কাছে সমস্যা হয়ে উঠলো তখনই যখন তিনি এই কু (সু)-কর্মটির সততা প্রতিবেদন করতে যেয়ে বলে ফেললেন, “এটা হচ্ছে, গেরিলা যুদ্ধের মতো একটা কৌশল।” শুনতে বেশ লাগে; যেমনটি লাগে দেবব্রত বিশ্বাসের কন্ঠে:

কে গো তুমি নাটুয়া

কে গো তুমি নাটুয়া

আপন ভোলা নৃত্যে

তালে তালে আকাশে

বাজালে মণিমন্দির

কে গো তুমি নাটুয়া।”

ভাগনার “আর্ট অ্যান্ড দ্য রেভোল্যুশন” লিখেছিলেন ১৮৪৯ সালে। এটা জেনে রাখা ভালো যে এই বছরেই তিনি ড্রেসডেন বিদ্রোহের ব্যর্থতার পরে জুরিখে নির্বাসিত হয়ে ছিলেন। এটা নিয়ে পরে কখনও কথা বলা যাবে। যাক যা বলছিলাম, ভাগনারের “আমাদের আধুনিক শিল্পীদের আর্তনাদ এবং বিপ্লবের প্রতি তাদের ঘৃণা” প্রবন্ধটি ইউরোপীয় শিল্প ইতিহাসের অসাধারণ মুহুর্তগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত জরিপ। ১৮৪৮ সালে ভাগনারকে শিল্প উৎপাদনের শর্তগুলোর প্রতি মনোনিবেশ করতে যেয়ে শিল্পে অর্থায়নের ব্যাপারটিকে সংস্কার করতে হয়েছিল, যেগুলোকে মূলত গণতান্ত্রিক দাবিগুলো থেকে শুরু করে জার্মান রাজকুমারদের সাথে একধরনের পুনর্মিলনের মধ্যপন্থী পথ আবিষ্কারের কৌশল বলে ধরে নেওয়া যায়। আমরা কিন্তু আজকাল ভাগনারের এই কৌশলটি ভালোভাবেই কাজে লাগাচ্ছি, কারণ সংস্কৃতি তথা থিয়েটারকে এখন আমরা কর্পোরেট সেক্টর বা মহাজনী ব্যবসার মধ্যে নিতে চাইছি। দুই বাংলার ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছেটাও যে তাই। এটা আমার কথা নয়, এসব তাদেরই কথা। আমি কেবল ধারকর্জ করে কথা বলছি, খবরের কাগজপত্রে তাদের বিভিন্ন বক্তৃতা ও বক্তব্যের সারাংশ থেকে। পশ্চিমবঙ্গের একজন নাট্যপুরোধা এবং বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ আগেই বলে দিলেন “কোম্পানি থিয়েটার”এর মধ্যেই থিয়েটারের মুক্তি। এই তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে যেয়ে তিনি যে কতোকিছু বলার এবং বোঝানোর চেষ্টা করলেন, সে কি আর বলে শেষ করা যায়? সে অভিজ্ঞতা পেয়েছিলাম তার এই তত্ত্ব নিয়ে কাজ করছিলেন এমন এক গবেষকের কাছ থেকে, সাওপোলোর আন্তর্জাতিক থিয়েটার সম্মেলনে। সৌভাগ্যক্রমে অথবা ধরা যাক দুর্ভাগ্যক্রমে ঐ অধিবেশনের সভাপতির দায়িত্বে ছিলাম আমি। অতএব যেটা শোনার শুনলাম, যেটা হবার সেটা হলো। সভাপতি হিসেবে ধরে নিলাম তত্ত্বটি ধোপে টিকলো না। তবে বুঝলাম ক্ষমতার রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে থাকার একটা সুবিধা আছে আর তা হচ্ছে উনাদের ভাষায় দাদাগিরি। বাংলাদেশেও তথৈবচ। যার যেমন মনে হচ্ছে বলে দিচ্ছেন, বলে যাচ্ছেন। এমনকি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে যেয়ে নামের আগে বিশেষণের নানা রকমের ‘মুষ্ক’ নিজেরাই বসিয়ে দিচ্ছেন। ভাবতে চাই না তারপরও ভাবতে হয়। এইসব কর্তাব্যক্তিদের কথা ভাবতেই আমার ছেলেবেলার বন্ধু হরির কথা মনে হলো। ওর পুরো নাম হরিহর, যার অর্থ করলে দাঁড়ায় বিষ্ণু ও শিবের অভেদমূর্তি। ওর নামটা যেমন, বালকটাও তেমনই ছিল। বাবামা আমাদের বলতেন হরিহর আত্মা। হরি ছিল ভয়ংকর রকমের সাহসী। একদিন স্কুলে যেতেই হঠাৎ করে পন্ডিত স্যার অর্থাৎ শশিকান্ত স্যারের মুখোমুখি হলাম। হাতে লাল জোড়াবেতের লাঠি। আমাদের দেখে হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠলেন: ‘জ্ঞানবিজ্ঞানসম্পন্নো ভজ মাং ভক্তিভাবিতঃ’। আমরা কিছুটা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। হরি, আমি, ছোটকু, টুনটুনি, পরিতোষ আরো অনেকে স্যারের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল। বুঝতে পারছিলাম না কি হলো। তবে কিছু একটা যে কিছু হয়েছে সেটা বুঝতে পারছিলাম। এবার পন্ডিত স্যার বলে উঠলেন: “স্নেহের বালক এবং বালিকার দল আইজ স্কুলে জেলা শিক্ষা দফতর হইতে পত্র আসিয়াছে আগামীকাল প্রাতঃকালে বিদ্যালয়ে বড়বাবু অর্থাৎ স্কুল পরিদর্শক মহাশয় আসিবেন। অতএব হেড স্যারের নির্দেশ, আইজ কোনো শ্রেণীকক্ষ খোলা থাকিবে না কেবলই ধোয়ামোছা আর পয়ঃপরিষ্কার; আজকে তোমাদের ক্লাস হইবে মাঠে, অর্থাৎ খোলা আকাশের নিচে।” হরি কিছুটা এগিয়ে পন্ডিত স্যারকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, “তাইলে স্যার ব্ল্যাকবোর্ড? উহা ছাড়া ষটকর্ম কী রূপে হইবে?” শশিকান্ত স্যার কিছুটা তথমত খেয়ে শ্বদন্ত বের করে বায়ু নিষ্কর্ষণের সাথে বলে উঠলেন, “না, আজ তোমাদের ক্লাসের বিষয়বিদ্যালয়ের ময়দানে সকল ভাঁটফুলের মুন্ডন প্রণালি।” হরি খিলখিল করে হেসে সকলকে বললো “ষড়জর প্রথম স্বর সা’র মধ্যে প্যাঁচ খাইয়া গেল ভ্যাঁভ্যাঁস্যারর।”একদিকে আমাদের হৈচৈ অন্যদিকে পন্ডিত স্যারের সংস্কৃত ভাষার বাণী: “শুচৌ দেশে মনঃ একাগ্রং কৃত্বা আত্মবিশুদ্বয়ে যোগং যুঞ্জ্যাৎ;” সঙ্গে জোড়াবেতের লাঠিপেটা, আমরা সব গরুর পাল ছুটছি গুরুর আগে আগে, ছুটছি

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্‌’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধমুকুটহীন রাজা দেওয়ান হাসন রাজা