শিল্পের বিপ্লবী প্রবাহ

থিয়েটার মেশিন

কামালউদ্দিন নীলু | শুক্রবার , ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৬:৫৭ পূর্বাহ্ণ

দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব

পরের দিন আমরা সকলেই স্কুলের নির্ধারিত সময়ের আগেই শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত। আমরা অপেক্ষায় বড় স্যার অর্থাৎ স্কুল ইন্সপেক্টর স্যারের। ক্লাসে কোন শব্দ নেই। খানিকক্ষণ বাদেই খট্‌ খট্‌ খট্‌ শব্দ। এইরকম শব্দের সাথে কেবলই তুলনা করা চলে এর এগারো বছর পরের সময়, ১৯৭১। হঠাৎ হেড স্যারের মিলিটারি কায়দায় চিৎকার, “ব্যাবাকে খাড়াইয়া পরো” । হরি আমার পাশের থেকে প্রায় সমস্বরে বলে উঠলো, “বেআক্কেলের লগেলগে…”। কোনো শব্দ নেই। আমরা সকলেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে। এবার স্কুল ইন্সপেক্টর স্যার বলে উঠলেন, “ ইয়ে কোন বেওকুফ্‌ ওস্তাদজী?” হেড স্যার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, “না স্যার আওয়াজটা আমাদের দফতরির ষাঁড়ের। ঐ যে স্যার জানালার ঐপাশে।” বড়ো স্যার সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, “ও আচ্ছাআই অ্যাম সো সরি, বয়েজ অ্যান্ড গার্লস। তোমরা বসে যাও।” আমরা সব যে যার জায়গায় বসে পড়লাম। এবার স্কুলের লেখাপড়ার মান পর্যালোচনা। বড় স্যার অর্থাৎ স্কুল ইন্সপেক্টর চেয়ারে আর হেড স্যার তার পাশে সিপাহীর মতো দাঁড়িয়ে। ক্লাসের বিভিন্ন বিষয়ের বই থেকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন, আমরা উত্তর দিচ্ছি। একেবারেই যে সব নির্ভুল উত্তর দিতে পেরেছিলাম সেটা বলবো না, তবে সকলের উত্তর পাঠ সন্তোষজনক হওয়ায় এবার কঠিন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হলো। ইন্সপেক্টর স্যার যে খুশি, সেটা তার চোখমুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল। উনি উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন “আচ্ছা এবার শেষ প্রশ্ন বলো ‘কুজ্ঝটিকা’ মানে কি?” আমরা সব চুপচাপ। পাসের থেকে হরি আমার কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিসিয়ে বললো, “বিহারী স্যার বাংলা জানলো কি করে?” আমি হরিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতেই খোট্টা স্যার আমাকে বলতে বললেন এর অর্থ তুমি বলো। হঠাৎ পাসের থেকে হরি বললো, “আমি বলবো স্যার”, বড় স্যার বললেন, “বলো”। হরি এদিকসেদিক তাকিয়ে আবারো জিজ্ঞেস করে, “বলবো স্যার”? এবার হেড স্যার হুকুম দিয়ে বলেন, “হরি বলো…”। সাথে সাথে হরির ঝটপট উত্তর ‘কুজ্ঝটিকা’ মানে হচ্ছে– “স্যার, চোদনা বনিয়া গেলাম।”

আজকাল পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের সংস্কৃতিজনদের এইসব মুষ্ক মার্কা আলাপচারিতা : ‘কোম্পানি থিয়েটার’, ‘গেরিলা থিয়েটার ও এর কৌশল’, ‘ইসলামী জলসা অথবা ওয়াজ মাহ্‌িফল ও একটি রাজনৈতিক থিয়েটার’, ‘নিজস্ব’ বা ‘দেশী’ বা ‘শুদ্ধ’ বা ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ তথা ‘নিজস্ব রূপের খোঁজে থিয়েটার’এইরকম অথবা এই রূপের সকল কথাবার্তা, আমার ছেলেবেলার বন্ধু হরিহরের ভাষায় বলছি; আপনাদের এইসব তত্ত্ব, কথা ও কর্মে, আমি, “চোদনা বনে যাচ্ছি।” ক্ষমা করবেন।

বিস্ময়কর চেখভ এখন আকাশের দিকে চেয়ে

একটা মেঘ তাঁর দিকে

একটা গ্র্যান্ড পিয়ানোর মতো তাকিয়ে।’

এইসবের মধ্যেই খুঁজে পাই আমার প্রিয় কবি নবারুণ ভট্টাচার্যের দারুণ কথা, “…রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতে গেলে পেচ্ছাপের গন্ধ পেতে হয়। সেটা আমি বানাইনি। লোকে মুতছে তাই পাচ্ছে।”

যাক আবার হাঁটতে শুরু করা যাক– ‘যুক্তি, তর্ক, গপ্পো’ নিয়ে। এই যে ভাগনার, ওর মত হচ্ছেশিল্পকে “সামাজিক পণ্য” হিসেবে গণ্য করা উচিত। আচ্ছা ব্যাপারটা কি? এই কথার অর্থের গভীরে যেতে না পারলে কিন্তু সমস্যাটা ধরা খুবই মুশকিল, আর তাই “সামাজিক পণ্য” এটার মধ্যে আমি কেবলই দেখতে পাই জনগণের সবচেয়ে শক্তিশালী চেতনার বিশ্বস্ত দর্পণের প্রতিচ্ছবি। আরেকটু খোলামেলাভাবে বলা যায় এইভাবে একটি শিল্পকর্মকে “জাতীয়তার সমস্ত সীমাবদ্ধতার বাইরে মুক্ত মানবতার চেতনাকে” ধারণ করা উচিত। আশাকরি বন্ধু হরিহরের গল্পের ফ্যালাসি বা প্রাসঙ্গিকতা পাঠক এখানে পেলেও পেতে পারেন। যাক এইসব ওজর অছিলা রেখে অন্য এক বাহাসের মধ্যে ঢুকে দেখি; “বিপ্লব”, “সমসাময়িক সমাজ”, “শিল্প প্রতিষ্ঠান”, এইসবের ব্যাখ্যা কি করে ভাগনার দাঁড় করালেন।

শুরুটা এইভাবে করি; একটি নিখুঁত শিল্পকর্ম হিসেবে নাটকের পুনর্জন্ম হতে পারে কেবলমাত্র বিপ্লব থেকেই এবং “প্রকৃত শিল্পমর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে শুধুমাত্রসামাজিক আন্দোলনের কাঁধে সওয়ার হওয়ার মাধ্যমেই।”

এটা আমার ধারণা যে ভাগনারও আমাদেরই মতো কোথাও যেয়ে সাংস্কৃতিক হতাশাবাদ এবং বিপ্লবের বিষণ্নতার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছিলেন, তবুও তাঁর ভাবনাটা তাকে সম্পূর্ণতা এবং কর্তৃত্ববাদের দিকে না নিলেও, ১৮৪৯ সালে এটা তাঁকে একটি বিশাল বিবৃতির দিকে চালিত করেছিল, আর সেটা হচ্ছে; “… মানবতার মহান বিপ্লব, যার সূচনা গ্রিক ট্র্যাজেডির চূর্ণবিচূর্ণনের মধ্যে, সেই বিপ্লবই মানবতাকে নতুনভাবে এবং আরো সুন্দরভাবে, মহানভাবে, সর্বজনীনভাবে তার গভীরতম অংশ থেকে জন্ম দিতে পারে।”

এই বর্ণনাপ্রাসঙ্গিক জায়গার থেকে আমাকে মনে করে নিতে হচ্ছে, একদিকে “ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশন (আইপিটিএ)” এবং এর পরবর্তীকালের থিয়েটার চর্চার বিপ্লবী ভূমিকার কথা, যেমন ঠিক একইভাবে অন্যদিকে আমাদের বর্তমান সময়কার বাংলা থিয়েটারের ছিটকে পড়ার দৃশ্যকাব্য ; যা ইতিমধ্যে কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক বলয়ের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এর বহু কারণের কারণএকটি সীমাবদ্ধ একমুখো (রাজনৈতিক) শিক্ষা। ফলে বতর্মান সময়কালের বাংলার থিয়েটার পূর্ববর্তী সময়ের বিদ্রোহের বাইরে নুয়ে পড়েছে। এখন এটা কেবলই একটা শক্তিহীন ঝড়, প্রাণহীন ক্রিয়ারই নিঃশব্দ যাত্রা: “এইরকম একটা অবস্থায় এর সবকিছুই নিরেট কঠিন, সব বায়বীয়, আর যা কিছু পবিত্র ও পূণ্য ছিল, সমস্তকিছুই এখন কলুষিত।”

আনাতোলি লুনাচারস্কি তাঁর “রেভোল্যুশন আ্যান্ড আর্ট” নিবন্ধটি লিখেছিলেন দুটো ধাপে, প্রথম অংশটি লিখেছিলেন ১৯২০ সালে একটি সংবাদপত্রের নিবন্ধ হিসেবে, এবং দ্বিতীয়টি লিখেছিলেন অক্টোবর বিপ্লবের পঞ্চম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে একটি সাক্ষাৎকার হিসেবে। এখানে বলতেই হয় নিবন্ধটি এমন একটি সময়ে তিনি লিখিছিলেন যখন রুশ বিপ্লবের তরতাজা শক্তিটা পুরোপুরি ধরা পড়েনি বা ঠিক বুঝে ওঠা যাচ্ছিল না, কিন্তু তার পরেও তাঁর এই প্রাথমিক পর্বের পরিভাষা এবং কর্মসূচিগুলো বিশেষ বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল বিপ্লবকে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজনে। প্রথমদিকে লুনাচারস্কি শিল্পকে ফর্মালিস্টিক বলে কঠোর সমালোচনা করতে যেয়ে যা বললেন তার সারমর্মটা অনেকটা এইরকম: “বিপ্লব ছাড়া শিল্প হচ্ছে নিছক একটি কিম্ভূতকিমাকার এবং বিমূর্ত তত্ত্বের সমাবেশ”। অন্যদিকে বিপ্লবের বিষয়ে তিনি বললেন,“বিপ্লব হচ্ছে অসাধারণ ঔদার্য এবং গভীরতার ভাবনার ভিতরে ঢুকে পড়া”। এই দুটো কথা ও ভাবনার ভেতরের যে বিষয়টি বোঝা যায় তা হচ্ছে শিল্পের ওপরে বিপ্লব এবং এর প্রভাব। এটাকে আবার এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায়; শিল্প হলো বিপ্লবের একটি মাধ্যম, কারণ এটা জনগণকে আন্দোলিত করতে পারে এবং বিপ্লবের নীতিগুলোকে যথাযথভাবে প্রকাশ করতে পারে। কথাগুলো আরো পরিষ্কার করা যায় তারই কথা ধরে– “বিপ্লব যদি শিল্পকে তার প্রাণ দিতে পারে, তাহলে বিপ্লবকে শিল্প দিতে পারবে তার ভাষা”।

অর্থাৎ লুনাচারস্কির এই নিবন্ধের ভিতরে যেটা পাওয়া যায় সেটা হচ্ছে, একটি ক্রান্তিকালীন সমাজের মধ্যে বিপ্লবী বিষয়বস্তুকে সঞ্চারিত করার প্রক্রিয়া এবং বিপ্লবকে উৎসাহিত করার জন্য শিল্পের প্রয়োজনীয়তা ও দায়বদ্ধতা। তিনি বলেছেন, আন্দোলনের জন্য রাষ্ট্রের প্রয়োজন হয় শিল্পের, কারণ রষ্ট্রের অন্য কাঠামোগুলোর ওপরেও এই কাঠামোটির প্রভাব রয়েছে, যেটাকে বলা যায় কোয়াসি সিন্থেটিকের আবরণ। এটা দর্শক এবং পাঠকদের অনুভূতিকে উত্তেজিত করে এবং তাদের ইচ্ছার ওপরে সরাসরি প্রভাব ফেলে। এটা, যেকোনো আন্দোলন বা বিপ্লবকে যেমন উত্তপ্ত করতে পারে তেমনি প্রতিফলন করাতে সক্ষম বিপ্লবের সবগুলো রঙ।

হেগেলের ধারায় কথার সুরে কথা বলতে যেয়ে নবারুণের কথাগুলো পঞ্চভূতের মতো চুপটি মেরে বসে আছে আমার মগজের সেরিব্রাল কর্ট্রেঙে: আমাদের প্রতিরোধের ঐতিহ্য আছে, ঘরানা আছে, কে নেই আমাদের সঙ্গে? আমাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ আছেন, প্রেমচাঁদ আছেন, কাজী নজরুল আছেন। আমরা তাঁদের তৈরি ঐতিহ্যের ওপরে দাঁড়িয়ে আছি। আজ যখন মহাজনী সভ্যতা সবকিছু গ্রাস করছে তখন আমি লেখক ও শিল্পী বন্ধুদের বলবো যে, আমাদের সৃজন যেন রাষ্ট্রের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে না পড়ে। জনতার পদধ্বনি যেন আমাদের কানে থাকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআকতার হোসাইনের কবিতা আত্মসমর্পণের আগে
পরবর্তী নিবন্ধরাউজানের খোন্দকারপাড়ায় আহমদ শাহ (রা.) এর ওরশ শরীফ