শিক্ষাদানের মহান ব্রত পালনের উদ্দেশ্যে যাঁরা নিয়োজিত, তাঁদের শিক্ষক বলা হয়ে থাকে। শিক্ষকতা কোনো পেশা নয়, এটা একটা ব্রত। মহৎ ও পুণ্যকর্ম করার উত্তম কাজটাই শিক্ষকরা করে থাকেন। সেজন্য শিক্ষকদের হতে হয় উত্তম মানুষও। শিক্ষক যেমন শিক্ষার্থীদের কাছে পূজনীয়, তেমনি শিক্ষার্থীরাও শিক্ষকের কাছে পূজনীয়। বিশেষ করে নিষ্পাপ শিশুশিক্ষার্থী অধিক পূজনীয়। শিক্ষার্থীদের নিয়েই শিক্ষকের জীবন আবর্তিত। যার শিক্ষার্থী শুন্য তিনি শিক্ষক নন। উপযুক্ত শিক্ষাদান পুণ্যকর্ম বলেই শিক্ষার্থীরা শিক্ষকের কাছে পূজনীয়। কারণ শিক্ষার্থী ছাড়া শিক্ষকের এই পুণ্যকর্ম করার সুযোগ নেই। ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের সন্তানকে আসল মানুষ বানানোর মহান দায়িত্ব শিক্ষকের। অকৃপণভাবে এই মহান দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে সহজেই সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপা লাভ করবেন একজন ভালো শিক্ষক।
যিনি শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ও নিবেদিত তিনি শিক্ষার্থীর সেবা করার মাধ্যমে আজীবন করতে পারেন সৃষ্টিকর্তার সেবা। একজন ভালো শিক্ষকের সবচেয়ে প্রিয় পাত্র শিক্ষার্থীরা। কেবল ভালো মেধার শিক্ষার্থীরা নয়, ক্লাসের সকল শিক্ষার্থীর প্রতিই শিক্ষকদের থাকতে হবে অগাধ ভালোবাসা। ভালোবেসেই শিক্ষক কাছে টেনে নেবেন শিক্ষার্থীদের। শিক্ষার্থীদের কল্যাণ কামনাই হবে শিক্ষকের প্রধানতম কাজ। শিক্ষার্থীর সফলতাকে নিজের সফলতা মনে করে সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হবেন শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের ব্যর্থতাকে নিজের ব্যর্থতা মনে করে মর্মাহত হবেন শিক্ষক। এর জন্য নিজেকে অপরাধীও ভাববেন একজন ভালো শিক্ষক। এভাবে শিক্ষার্থীর সবচেয়ে আপন ও কাছের মানুষ হয়ে উঠবেন একজন ভালো শিক্ষক। তিনি তাদের ভয়ের কারণ না হয়ে হবেন পরম শ্রদ্ধার পাত্র। ভালো শিক্ষকের দিকনির্দেশনায় সঠিক মানুষ হয়ে উঠবে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকের শিক্ষকতা এভাবেই সফলকাম হবে।
জানার এবং জানানোর ঐকান্তিক ইচ্ছা একজন ভালো শিক্ষকের গুণাবলীর মধ্যে অন্যতম। জ্ঞানার্জনে শিক্ষককে হতে হবে নিরলস। সমৃদ্ধ হতে হবে বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান। শিক্ষার সংজ্ঞা, শিক্ষার উদ্দেশ্য ও আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষাদান পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষকের জানা বেশি দরকার, শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি। শিক্ষক নিজেকে হতে হবে অত্যন্ত সৎ ও ন্যায়পরায়ণ। এ দুটোর দীক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে হবে শিক্ষার্থীদের। মিথ্যার আশ্রয় নেয়া অসুন্দর কাজ। এ অসুন্দর কাজ এবং কাজে ফাঁকি দেয়া থেকে বিরত থাকাও একটা কর্তব্য এ মহৎ পেশায়। সামাজিক মূল্যবোধে বলিয়ান হয়ে লোভ–লালসার উর্ধ্বে উঠে শিক্ষার্থী ও সমাজের কল্যাণে নিয়োজিত থাকতে হবে শিক্ষকদের। জাতীয়তাবোধ ও দেশপ্রেমে পরিপূর্ণ হতে হবে শিক্ষকদের। একজন শিক্ষক হবেন শালীন ও উত্তম ব্যবহারের অধিকারী। তিনি হবেন সৃষ্টিশীল, সৃজনশীল ও বাস্তববাদী। শিক্ষকের আয়ত্তে থাকবে শিক্ষাদানের মনস্তাত্ত্বিক জ্ঞান ও আধুনিক কলাকৌশল।
একজন ভালো শিক্ষককে হতে হবে শিক্ষার্থীর মন–মানসিকতা, যোগ্যতা– অযোগ্যতা, আগ্রহ–অনাগ্রহ বোঝার অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী। শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ দিয়ে, পুরস্কার দিয়ে, উৎসাহ দিয়ে, উদ্দীপনা দিয়ে প্রতিদিন বাড়িয়ে দিতে হবে সৎ সাহস ও কর্মোদ্যম। শিক্ষক নিজে স্বপ্ন দেখে, উত্তম স্বপ্ন দেখা শেখাতে হবে শিক্ষার্থীদের। স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়ার মন্ত্রও শেখাতে হবে শিক্ষককে। প্রাকৃতিক শিক্ষার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে শিক্ষকদের। প্রকৃতির একনিষ্ঠ ছাত্র হবেন শিক্ষক। সবাই ভালো ছাত্র হয় না, তবে সবাই ভালো মানুষ হতে পারে।
শিক্ষার লক্ষ্য হলো–ভালো মানুষ তৈরি করা। এ ভালো মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয় শিক্ষকদের। শিক্ষক নিজে ভালো মানুষ হবেন এবং শিক্ষার্থী অনুকরণ করে ভালো মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করবে। শিক্ষার্থীদের থেকে ভদ্রতা প্রত্যাশা করার আগে শিক্ষককে ভদ্র হতে হবে। শিক্ষার্থী সে যত ছোটোই হোক না কেনো, তারও সম্মানবোধ আছে, সেটা তাকে দিতে হবে। শিক্ষক–শিক্ষার্থী সম্পর্কের পেছনে কাজ করে ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, স্নেহ, শাসন। একজন ভালো শিক্ষককে পালন করতে হবে শিক্ষার্থীর অভিভাবকের ভূমিকা। মার্কিন দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী ডিইউ বলেছিলেন, ‘একজন শিক্ষক হবেন চালক ও পথপ্রদর্শক। তিনি গাড়ি চালিয়ে যাবেন, যে গাড়ির চালিকা শক্তির উৎস হলো শিক্ষার্থীরা।’ তাই উভয়ের মাঝে বন্ধুত্বপূর্ণ, নিবিড় ও সুষ্ঠু সম্পর্ক ছাড়া আজকের সুন্দর সৃজনশীল শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে।
লেখক: সিনিয়র সহকারী শিক্ষক, অংকুর সোসাইটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।