শিক্ষা হল দেশের তারুণ্য ও সমাজ মানসকে বাঞ্চিত পথে গড়ে তোলার অপরিহার্য হাতিয়ার। বিকৃত ও যে কোন ধরনের অসহিষ্ণু ও কুশিক্ষা সমাজকে কোন অবস্থাতেই সামনের দিকে নিয়ে যেতে পারে না। স্বাধীন দেশে পাকিস্তান আমলের প্রচলিত সাধারণ ও একমুখী শিক্ষার প্রাধান্য বেশিদিন অব্যাহত রাখা যায়নি। শিক্ষা যে সমাজ ও রাজনীতিকে মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্যাভিসারী প্রগতিমুখীন, উদার ও আধুনিক করে তোলার একমাত্র হাতিয়ার তা শাসকদলের আন্তরিক অনুধাবনের অনীহা ও একে গুরুত্বহীন বিবেচনা করার অমার্জনীয় উদাসীনতা পরবর্তী সামাজিক রাজনৈতিক বিপর্যয়ের প্রধান কারণ তা বার বার প্রমাণ হয়েছে। বঙ্গবন্ধু অনেকটা নিজ উদ্যোগে শিক্ষা নীতি প্রণয়নের জন্য ড. কুদরত–ই– খুদাকে দায়িত্ব দিয়ে শিক্ষা কমিশন গঠন করেন ও ’৭২ সালেই বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে বিবেচনার বাইরে রেখে প্রাইমারী শিক্ষাকে সরকারীকরণ করেন। কিন্তু সময় ক্ষেপণ না করে প্রয়োজন ছিল শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের সুপারিশ প্রদানের আগেই জরুরিভাবে প্রচলিত প্রধানত একমুখী সাধারণ শিক্ষাকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিশুর জন্য অবতৈনিক ও বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া এবং তা দৃঢ়তার সাথে বাস্তবায়িত করা। এতে আর্থিক সংশ্লিষ্টতাও খুব বেশি ছিল না। পরবর্তীতে দ্রুততার সাথে কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে অষ্টম শ্রেণিকে প্রাথমিক স্তর হিসাবে বিন্যাস করা যেত। দৃঢ় রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া শিক্ষার প্রগতিশীল পরিবর্তন কোন দেশে কোন কালে সম্ভব হয়নি। কেননা শিক্ষা, সমাজ ও রাজনীতির সাথে গভীরভাবে যুক্ত। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস, দেশপ্রেম, মানবিকতায় ঋদ্ধ একটি পাঠক্রম বাধ্যতামূলকভাবে প্রাথমিক স্তর তথা ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত কাঠার ও বাধ্যতামূলকভাবে অনুসরণ করা শুরু হলে ’৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো তা সহজে পাল্টে দিতে পারত না। এ কাজটি যে বিরাজিত পরিস্থিতিতে নানা কারণে জরুরি ও মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শবিরোধী ক্রমবর্ধমান জনমতকে সঠিক পথে প্রভাবিত করার কার্যকর উপায়, উঠতি তারুণ্যকে সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মান্ধ প্রতিক্রিয়ার কবল থেকে রক্ষা করার মোক্ষম হাতিয়ার তা বঙ্গবন্ধুর সাড়ে ৩ বছর সময়ে সরকারের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে ভাববার দূরদৃষ্টি সম্পন্ন কেউ ছিল না। একইভাবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস থেকে দেশি বিদেশি বিভিন্ন মহলের আশংকা সত্ত্বেও প্রতিক্রিয়াশীল সম্ভাব্য সামরিক অভ্যুত্থান প্রতিরোধ করার বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলার গুরুত্ব কেউ বুঝেনি। প্রসঙ্গতঃ যিনি বোঝার অনেক বিনিদ্র রাত যাপন করে যিনি মহান বিজয়কে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিলেন তাঁকে গুরুত্বহীন ও শেষ পর্যন্ত বের করে দিয়ে মোশতাকের বিজয়ের পথ পরিস্কার করে দেয়া হয়। কিন্তু মুস্কিল হলো শিক্ষার প্রগতিমুখী অভিমুখ যে ভবিষ্যত প্রজন্মকে আলোকিত ও অন্ধ সংস্কার থেকে মুক্ত করার এবং যুক্তিবাদী সমাজ মানস গড়ে তোলার একমাত্র পথ তা মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব সেদিন না বুঝলেও শত্রুপক্ষ ঠিকই বুঝেছিল।
’৭৫ পরবর্তী সময়ে জেনারেল জিয়া যে পথে দেশকে নিয়ে যাবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে ক্ষমতা নিয়েছেন ঠিক সে পথেই অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে নিষিদ্ধ করে, সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে সামরিক ফরমান বলে পাল্টে দিয়ে শুধু দেশের নাম কৌশলগত কারণে ঠিক রেখে মর্মগত দিক থেকে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তান তৈরির কাজটা সুচারুভাবে করেছেন– কোন ভুল করেননি তাঁর নিজের পথ চলায়। এজন্য প্রথমেই বেছে নেন শিক্ষাকে বহুধা বিভক্ত ও সাম্প্রদায়িকীকরণের কাজ। প্রথম পদক্ষেপেই বাতিল করে দেন মুক্তিযুদ্ধের সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও আদর্শ ভিত্তিক ১৯৭৪ সালে প্রদত্ত ড. কুদরত–ই খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট। এর পরপরই সাধারণ শিক্ষার সংকোচন ও মাদ্রাসা শিক্ষাকে বিস্তৃত করার সুদুর প্রসারী লক্ষে কাজ শুরু হয়। শুধু তাই নয় স্কুল ও কলেজ শিক্ষকদের শিক্ষাগত যোগ্যতা উপেক্ষা করে সাধারণ ও মাদ্রাসা শিক্ষার কাঠামোগত ও আর্থিক সাযুুজ্য আনয়নের পাশাপাশি পাঠ্যসূচী পরিবর্তনের মাধ্যমে শুরু হয় সাধারণ শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণ। এরশাদ আমলে এ প্রক্রিয়া আরো জোরদার হয়। এ সময়ে সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা ও ইংরেজি শিক্ষা এই তিনটি প্রধান ধারায় পুরো শিক্ষা ব্যবস্থা কার্যত বিভক্ত হয়ে যায়। এর মধ্যে রয়েছে আরো কিছু উপধারা। শুধু প্রাথমিক শিক্ষা ১৩ ভাগে বিন্যস্ত। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের কোন শিক্ষার্থী চলন বলন বা আচার গ্রামের হত দরিদ্র একজন মাদ্রাসা শিক্ষার্থীর আচারের সাথে পার্থক্য অনতিক্রম্য। তিন প্রধান ধারার শিক্ষার্থীদের জগত সম্পূর্ণ আলাদা। এভাবে মনে মননে সম্পূর্ণ বিভক্ত একটা দেশ কি পদ্মা সেতু আর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে কি যুক্ত করা যাবে?
বিগত ৪০ বছর ধরে শিক্ষার নামে এই কুশিক্ষার কারণে দেশের সমাজ মানস হয়ে পড়েছে সাম্প্রদায়িক বিভেদে, ‘আমরা ওরা’ তে চরমভাবে বিভক্ত। অর্ধশতাব্দী ধরে গণতন্ত্রহীনতার দীর্ঘ পরিবেশে শাসক গোষ্ঠীর প্রত্যক্ষ প্রশ্রয়ে শিক্ষার এই সাম্প্রদায়িক ধারা প্রচন্ড শক্তি অর্জন করেছে। এজন্য দেখি স্বঘোষিত অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের দল আওয়ামী লীগের বিগত টানা ১৫ বছরের শাসনামলে প্রায় প্রত্যেক বছর দেশের কোন না কোন স্থানে বা দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা ঘটে চলেছে যেখানে একটি ঘটনারও নিরপেক্ষ বিচার হয়নি ধর্মান্ধদের তোষণ নীতির কারণে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হয়েছে, কিন্তু সমাজে তাদের প্রতি সহানুভূতি বেড়েছে, কেননা তাদের অপরাজনীতি ও মূল্যবোধ সমাজে আধিপত্য করছে। এক ধরনের সাম্প্রদায়িক ঘৃণার ‘হেজিমনি’ তে সমাজ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। সম্প্রতি সাঈদীর মৃত্যুর পর ছাত্রলীগের কর্মীদের ব্যাপক সহানুভূতি প্রদর্শনের কারণে দেশব্যাপী অগনিত ছাত্রলীগ নেতাকর্মী বহিস্কারাদেশ আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে এ দেশে তারুণ্যের বিরাট একটি অংশ কি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করে নাকি বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ সংগ্রামের ফলে পরাজিত পাকিস্তানি দ্বিজাতি তত্ত্বে বিশ্বাস করে। সাম্প্রদায়িক সমাজ মানসের জোরেই সাংগঠনিক দুর্বলতা নিয়ে, ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকেও বিএনপি বিশাল জনসমর্থন নিয়ে সম্প্রতি ক্ষমতাসীনদের চ্যালেঞ্জ করছে। শিক্ষার প্রতিক্রিয়াশীলতা বন্ধ করে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী পথে শিক্ষাকে নিয়ে চলা, সংস্কৃতি চর্চার পরিবেশ ও ঐতিহ্য রক্ষার জন্য বিএনপি এরশাদের যত্নবান হবার প্রশ্নই ওঠে না এবং তাদের কাজও তা নয় বরং উল্টোটা– যা তারা যত্নের সাথে করেছে। শিক্ষা ও সুস্থ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাবল্যে যে দল প্রধানত বেনিফিসিয়ারী হয় সেই আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থেকে ওদের দাবী মেনে সাধারণ শিক্ষার পাঠক্রম পাল্টে দিয়েছে যা করার কথা ছিল বিএনপির। এ সময়ে শিক্ষা বাণিজ্য ও শিক্ষার প্রাইভেটেজেশন আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৪ সালে বিএনপির আমলে শুরু হয় উচ্চ শিক্ষার বিশেষ করে প্রকৌশল ও চিকিৎসা শিক্ষার প্রাইভেটেজেশন এই সরকারের ১৫ বছরের শাসনামলে দ্রুত বিস্তার লাভ করে। এই বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে গেছে। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ এই সব ব্যক্তিগত উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হলো এখন ব্যবসায়িক মুনাফার অন্যতম প্রধান উৎস। বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মালিকদের নিজস্ব সংগঠন রয়েছে। বস্তুত রাজনৈতিক বাণিজ্য ও শিক্ষা বাণিজ্য একাকার হয়ে গড়ে উঠেছে মুনাফা কেন্দ্রিক দুবৃত্তায়িত সমাজ।
দেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে অন্যতম প্রধান উপাদান হলো লোক সংস্কৃতি তথা গণ সম্পৃক্ত সংস্কৃতির ধারা। এই ধারা ছিল আমাদের দেশে অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও ঐতিহ্যশালী। আজ ধর্মান্ধরা এ সবের অসম্প্রদায়িক ও মানবিক আবেদনের কারণে এসব শিল্পীদের বিরুদ্ধে গ্রামে গ্রামে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, পারছেনা শুধু স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যাঁকে সমীহ করতেন সেই মরমিয়া শিল্পী ও সাধক লালনের আখড়া ভেঙে দিতে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাজ কি গ্রামীণ লোক শিল্পীদের উপর ধর্মান্ধদের ক্রমাগত হামলা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা। এই প্রতিক্রিয়াশীলতার অন্ধকারে নিমজ্জিত সমাজ মানস ও তারুণ্য তো দেশকে পাকিস্তান বানাবার জন্য মুখিয়ে আছে। সাংস্কৃতিক পুর্নজাগরণ সৃষ্টির কঠিন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়া, অসাম্প্রদায়িক সাধারণ শিক্ষার ব্যাপক প্রচার ও প্রসার ছাড়া তো ক্ষমতায় থেকে ক্রামগত এদের সাথে আপোষ করে চলতে হবে। ’৭২ সালেই যদি দেশকে রক্ষার, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ রক্ষার, সমাজ মানসের সাম্প্রদায়িকতা দূর করার একমাত্র উপায় হিসাবে শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি ও তা কার্যকর করা যেত তাহলে পরবর্তীতে গড়ে উঠা হেফাজত ও সাম্প্রদায়িক বিশাল সমাজ মানসের সাথে নীতিহীন আপোষে এবং লুটেরাদের সাথে সমন্বয় করে দেশ চালাতে হতো না। সম্প্রদায়িকতার শিকার অসহায় সংখ্যালঘু ও সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হতদরিদ্র মানুষ কান্নাভেজা চোখে সরকাররের উন্নয়ন দেখতে পায় না। তাদের চোখে ঝাপসা লাগে পদ্মা সেতু আর টানেল এবং বহু চর্চিত উন্নয়নের মডেল। উন্নয়ন বলতে বুঝি অসহায় সংখ্যালঘুর জীবনে স্বস্তি ও নিরাপত্তা,হত দরিদ্র মানুষের সামাজিক স্বাচ্ছন্দ্য। এই বোধে সমাজ ও শাসক শ্রেণি উজ্জ্বীবিত না হওয়া পর্যন্ত আজকের সংকটের অবসান হবে না। আজ দুঃখজনক হলেও সত্য পাশের দেশ গান্ধী–নেহেরুর ভারতে ক্ষমতাসীন চরম সাম্প্রদায়িক শক্তি মোদীর নেতৃত্বে বিগত ১০ বছর ধরে ভারতকে সেই দুর্বৃত্তায়িত পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ছকে এগিয়ে নিচ্ছে। জীবনানন্দের কথা প্রাসঙ্গিকভাবে মনে এসে যায়
“অদ্ভূত আঁধার এক নেমেছে পৃথিবীতে আজ / যারা অন্ধ তারা চোখে দ্যাখে বেশি / যাদের হৃদয়ে প্রেম নেই, করুণা নেই
মানুষের প্রতি ভালবাসা নেই / পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।”
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।