বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি উদ্বেগজনক পরিবর্তন স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তারা ক্রমশ বই পড়া কমাচ্ছে, জ্ঞান অর্জনের আগ্রহ হারাচ্ছে, আর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার শর্টকাট খুঁজে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে “গাইড–নির্ভর” মানসিকতা আরও বেশি প্রবল। বাজারে সহজলভ্য শর্টনোট, সাজেশন আর মুখস্থভিত্তিক গাইড তাদের দ্রুত পরীক্ষায় পাশ করাতে সাহায্য করলেও প্রকৃত জ্ঞান, বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও দক্ষতার বড় ঘাটতি থেকেই যায়।
একদিন বইয়ের দোকানে নিজের পছন্দের উপন্যাস কিনতে গিয়েছিলাম। কথায় কথায় দোকানি এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন– “এখন আর ছেলেমেয়েরা বই কিনতে আসে না। কে কোন গাইড পড়লে কমন পড়বে–সেই চিন্তাই তাদের সব।”
বইয়ের বাজার টিকে রাখা যে কতটা কঠিন হয়ে গেছে, তাঁর কণ্ঠেই সেটা বোঝা যাচ্ছিল। গল্প–উপন্যাস, সাহিত্য বা জ্ঞানবর্ধক বইয়ের প্রতি আগ্রহ যেন হারিয়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণভাবে। ওনার কথা শুনে মনটা হঠাৎ ভারী হয়ে গেল। মনে হলো–বইয়ের প্রতি মানুষের সেই আগ্রহ, সেই উষ্ণতা, যা একসময় আমাদের বড় করেছে, স্বপ্ন দেখিয়েছে–সব যেন ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে।
যেন একটা যুগ ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছে আমাদের চোখের সামনে, অথচ আমরা কিছুই করতে পারছি না। যদি এভাবেই চলতে থাকে, তবে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য আমরা কী রেখে যাব? বইয়ের গন্ধ, কাগজের স্পর্শ, পড়ার আনন্দ–সব কি একদিন গল্প হয়ে যাবে? সাময়িক বিনোদন আর দ্রুত আয়ের প্রলোভনও শিক্ষার্থীদের মনোযোগ সরিয়ে নিচ্ছে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, সামাজিক মাধ্যম, রিল–ভিডিও–এসব এখন তাদের সময়ের বড় অংশ দখল করে। অনেকেই মনে করেন-“ইংরেজি সামান্য জানি, কম্পিউটার কিছুটা জানি, সাজেশন মুখস্থ করলেই চলবে।” কিন্তু এই মানসিকতাই প্রকৃত শিক্ষা ও দক্ষতাকে পিছনে ঠেলে দেয়।
আজকের শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশের বিশ্বাস– “কম পড়ে বেশি নম্বর পাওয়া যায়।” কিন্তু বাস্তবতা হলো– জ্ঞান অর্জন কখনোই শর্টকাটে হয় না। প্রকৃত শিক্ষা আসে ধৈর্য, মনোযোগ, পরিশ্রম, অনুশীলন এবং বিশ্লেষণের মাধ্যমে। নম্বরই যদি মূল লক্ষ্য হয়, তাহলে বাস্তব দক্ষতা অর্জন অসম্ভব। শর্টনোট বা সাজেশন পরীক্ষায় পাস করাতে পারে, কিন্তু জীবনের প্রতিযোগিতায় এগুলো কোনো কাজে আসে না। মুখস্থ করে পাশ করা যায় ঠিকই, কিন্তু চাকরির বাজারে টিকে থাকতে হলে লাগে–বিশ্লেষণী ক্ষমতা সমস্যা সমাধান, সৃজনশীলতা, যোগাযোগ দক্ষতা, বাস্তব জ্ঞান–এসবই শর্টকাট শিক্ষায় তৈরি হয় না। এদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (অও) এখন শিক্ষা এবং কর্মজীবনের বড় অংশ দখল করছে। অও সহায়ক ঠিকই, কিন্তু অতিনির্ভরতা ক্ষতিকর। শিক্ষক বা ব্যক্তিগত জ্ঞানগঠনের যে অভিজ্ঞতা–তা অও কোনোদিনই অল্প সময়ে পূর্ণ দিতে পারে না। যদি শিক্ষার্থীরা নিজেরাই শেখার অভ্যাস হারিয়ে ফেলে, তাহলে ভবিষ্যতে প্রযুক্তির প্রতিযোগিতায় তারা আরও পিছিয়ে পড়বে। আজ শিক্ষার্থীরা এক গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। একদিকে সহজ পথ–সাজেশন, শর্টনোট, মুখস্থ আর প্রযুক্তি–নির্ভরতা। অন্যদিকে কঠিন পথ–বই পড়া, চিন্তা করা, অনুশীলন, দক্ষতা অর্জন। সহজ পথ সাময়িক সান্ত্বনা দেয়, কিন্তু ভবিষ্যৎ ফাঁকা করে দেয়। কঠিন পথই তাদের শক্ত ভিত্তি, আত্মবিশ্বাস এবং আন্তর্জাতিক মানের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সামর্থ্য তৈরি করে। শিক্ষার্থীদের এখনই বুঝতে হবে– পরীক্ষায় পাস হওয়া শিক্ষা নয়। দক্ষতা ছাড়া ডিগ্রি ভবিষ্যতের দরজা খুলে দিতে পারে না। প্রযুক্তি সাহায্য করবে, কিন্তু নিজের জ্ঞান, পরিশ্রম ও সক্ষমতাই দীর্ঘমেয়াদে মানুষের পরিচয় তৈরি করে। গভীর শিক্ষা, নিয়মিত পড়াশোনা, এবং কঠোর পরিশ্রমই ভবিষ্যতের একমাত্র শক্তি–এটাই আজকের শিক্ষার্থীদের মনে গেঁথে নিতে হবে।
লেখক: শিক্ষক, সংগঠক












