১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও প্রায় দুই-তিন লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে বাংলাদেশ নামক একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে বিজ্ঞানী ড. কুদরত-এ-খুদার নেতৃত্বে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেছিলেন। উক্ত কমিশন ১৯৭৪ সালে রিপোর্ট প্রদান করেছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এর কাল-রাত্রিতে জাতির মহান নেতা নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করায় ১৯৭২ সালে গঠিত শিক্ষা-কমিশন প্রণীত শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করা আর সম্ভব হয় নি। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শিক্ষা-কমিশন গঠিত হলেও তা আর আলোর মুখ দেখে নি।
অতঃপর বর্তমান শিক্ষাবান্ধব সরকারের নির্বাচনী ওয়াদা অনুযায়ী জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণীত হয় এবং এই শিক্ষানীতি-২০১০ তৎকালীন মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট হস্তান্তর করলে তিনি জনগণের মতামত গ্রহণের নির্দেশ দেন। এর ফলে ওয়েবসাইট সহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সহায়তায় বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের মতামত নিয়ে শিক্ষা-কমিশন শিক্ষানীতি-২০১০ চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। এ চূড়ান্ত শিক্ষানীতি -২০১০; ২৭ মে ২০১০ তারিখে মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদন করেন এবং মহান জাতীয় সংসদে ০৭ ডিসেম্বর ২০১০ তারিখে সর্বসম্মতভাবে অনুমোদিত হয় যা জাতির জন্য এক বিশাল প্রাপ্তি।
এই শিক্ষানীতি-২০১০ এ প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা, শিক্ষক নিয়োগ ও শিক্ষক এর পদোন্নতি, মাধ্যমিক শিক্ষা, বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা, উচ্চশিক্ষা, পরীক্ষা মূল্যায়ন, শিক্ষার্থী ভর্তি ও শিক্ষার্থীর কল্যাণ, শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, শিক্ষকদের মর্যাদা, শিক্ষকদের অধিকার, সুযোগ-সুবিধা ও দায়িত্ব, শিক্ষা প্রশাসন ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করা, মাধ্যমিক শিক্ষাকে নবম-দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত করা, চার বছরের স্নাতক ডিগ্রিকে প্রান্তিক ডিগ্রি গণ্য করা, সমন্বিত শিক্ষা আইন প্রণয়ন করা, স্থায়ী শিক্ষা-কমিশন গঠন করা, বেসরকারি শিক্ষক নিয়োগে কমিশন গঠন করা, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর, কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর, মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদফতর ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর স্থাপন করা, প্রত্যেক বিভাগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা স্থাপন করা এবং দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তির পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করা ছিল অন্যতম। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর প্রণীত এই শিক্ষানীতি আজ ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। শিক্ষানীতি না থাকলে একটি সঠিক শিক্ষাক্রম তৈরি করা সম্ভব নয়।
শিক্ষাক্রম হলো জাতির মূল প্রাণশক্তি। এ কারণে জাতির ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কোন মূল্যবোধে, কোন নৈতিকতায়, কোন দক্ষতায় সামনের দিকে এগিয়ে যাবে তা এই শিক্ষাক্রমে বর্ণিত থাকবে। তাই যুগের চাহিদা অনুযায়ী প্রণীত সঠিক শিক্ষাক্রম একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা ও গুণগত শিক্ষা বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। এখন কথা হলো- এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ কিভাবে ভূমিকা রাখবে। যেমন- প্রতিষ্ঠান প্রধানগণ; শিক্ষাক্রম সময়ে সময়ে পরিবর্তন হলে শিক্ষকদের অবহিত করা,বছরের শুরুতে একাডেমিক প্ল্যান তৈরি করে ডে বাই ডে বাস্তবায়ন করা, পাঠদান সংশ্লিষ্ট শিক্ষা উপকরণ তৈরি ও সংগ্রহ করে তার ব্যবহার নিশ্চিত করা, যুগের চাহিদা অনুযায়ী নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করে পাঠদান পরিচালনা করা, যোগ্য-মেধাবী শিক্ষক ও কৃতী শিক্ষার্থীদের পুরস্কার এর ব্যবস্থা করা, নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম মনিটরিং ও সুপারভিশন করা, শ্রেণি শিক্ষকদের উপর রাজনৈতিক চাপ প্রতিহত করা,পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করে তা শ্রেণি কক্ষে বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করা, নিজে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে শিক্ষকদেরকেও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তোলা,অভিভাবকদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা, নিয়মিত অভিভাবক সমাবেশ করা, শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং করে মাদকমুক্ত-জঙ্গিবাদমুক্ত করা, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে অসামপ্রদায়িক সমাজ গঠনে করণীয় বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া অন্যতম। অপরদিকে- শ্রেণি শিক্ষকগণ; শিক্ষাক্রম এর পরিবর্তন হলে নিজে অবগত হওয়া, শিক্ষাক্রম এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য জানা, শ্রেণি কক্ষের পরিবেশ এর প্রতি গুরুত্ব দিয়ে পাঠদান করা, পাঠদান এর বিষয়ে নতুন নতুন কৌশল উদ্ভাবন করা এবং তা আয়ত্ত করে শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে বৈচিত্র্য আনা, শিক্ষার্থীদের নিরপেক্ষভাবে মূল্যায়ন করে নিজেকে সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য করে তোলা,শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের বিষয়ে অবহিত করা, দুর্বল ও পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কার্যক্রমের বাইরে আলাদা সময় দেয়া, পাঠ পরিকল্পনা তৈরি করে তা পাঠদানে নিশ্চিত করা,নির্ধারিত সময়ে পাঠ্যসূচি শেষ করা, শিক্ষার্থীদের প্রতি আন্তরিক হয়ে শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা, সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশের জন্য অংশগ্রহণমূলক কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মানসিক শক্তির বিকাশ সাধন করা,সহ-পাঠক্রমিক বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশে সহায়তা করা ইত্যাদি। শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠান প্রধানদেরকে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের জন্য সকল স্টকহোল্ডারদের সহায়তা নেয়া প্রয়োজন এবং সর্বোপরি বলা যায়, সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলী বাস্তবায়নে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর ভূমিকাই মুখ্য।
পরিশেষে বলা যায়, প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এর নিজস্ব পদ্ধতি ও কৌশল থাকে। প্রত্যেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (সরকারি ও বেসরকারি) পরিচালনা কমিটির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠান এর নিজস্ব উদ্যোগ, শিক্ষক ও কর্মচারীদের প্রত্যক্ষ সম্পৃক্ততায় শ্রেণিকক্ষে বিষয়ভিত্তিক পাঠদান ও সহ-পাঠক্রমিক কার্যাবলী বাস্তবায়ন নিশ্চিত করণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা-ই পারে শিক্ষানীতির আংশিক বাস্তবায়ন।
লেখক : অধ্যক্ষ, কর্ণফুলী এ জে চৌধুরী কলেজ, চট্টগ্রাম ও সভাপতি বাংলাদেশ কলেজ শিক্ষক সমিতি (বাকশিস) পটিয়া-কর্ণফুলী উপজেলা শাখা