শান্তিপুরা শ্রী লঙ্কার সবচেয়ে উঁচু গ্রামে

বাবর আলী | সোমবার , ৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ৭:১২ পূর্বাহ্ণ

নুয়েরা এলিয়া নামক ছবির মতো শহর থেকে বেরিয়ে কিলোমিটার ছয়েক হাঁটলেই মুন প্লেইনস নামে সুন্দর একটা জায়গা। শ্রী লঙ্কার সবচেয়ে উঁচু দশটা পাহাড়ের মধ্যে নয়টাই এখান থেকে একসাথে দৃষ্টিগোচর হয়। ওই পাহাড় দেখার লোভেই যাওয়া। ওখানেই চোখ আটকাল একটি পাহাড়ের পাদদেশের ছোট্ট একটা গ্রামে। একেবারে ছবির মতো সাজানো। কেমন শান্তি শান্তি ভাব আছে জায়গাটায়। স্থানীয় একজন থেকে জিজ্ঞেস করে নাম জানলাম ওই গ্রামের নাম আসলেই শান্তিপুরা! শ্রী লঙ্কার ষষ্ঠ উচ্চতম পর্বত কিকিলিমানা এর গোড়ায় ছিটানো কিছু বাড়ি নিয়ে এর অবস্থান। অবশ্য গোড়া বলাটা উচিত হবে না, বলা উচিত ৭,৩৫০ ফুট উচ্চতার ষষ্ঠ উচ্চতম পাহাড়ের কাঁধে এই জনপদের অবস্থান। দিনের একটা বড়ো সময় এই গ্রামের গায়ে ঝুলে থাকে থোকা থোকা মেঘপুঞ্জ।

লাফিং লেপার্ড নামক হোস্টেলের জমে যাওয়া আড্ডা থেকে গাত্রোত্থান করতে কষ্টই হলো। হোস্টেলের এহেন নাম কেন কে জানে। চিতাবাঘকে কে কবে হাসতে দেখেছে! শ্বদন্ত বেরিয়ে থাকা ওই বিশাল হাঁকে আমার আর যা কিছু হোক, হাসি বলেই মনে হয়নি কখনো। গুগল ম্যাপের দেখানো পথে হাঁটতে শুরু করলাম। হোস্টেল থেকে দূরত্ব ৫ কিলোমিটারের খানিকটা বেশি। শ্রী লঙ্কার রাষ্ট্রপতির নুয়েরা এলিয়ার বাসভবনকে বামে রেখে চলা। এ৫ মহাসড়ক থেকে ‘শান্তিপুরা ২ কিলোমিটার’ লেখা সাইনবোর্ড থেকে রাস্তা বেঁকে গেল বামে। এখান থেকে টানা চড়াই ভাঙতে হবে। পাহাড়ি রাস্তার ধরন মেনে পথ এগিয়েছে খাদ ঘেঁষে ইংরেজি ‘ইউ’ আকৃতি নিয়ে। একের পর এক ছোটো ছোটো লুপ। কয়েকটা চড়াই ভাঙতেই পাহাড়ের গায়ে অতিকায় সব পাইন, আর পাথরের গায়ে ফার্ন। পাইনের পাতার ঝরে পড়া ঝুরিতে রাস্তা সয়লাব। আরো কিছুদূর উঠতেই ‘দ্য উইন্ড ক্যাসেল’ নামে সুন্দর একটা বাড়ি। আসলেই হাওয়ার সাম্রাজ্যে এই দুর্গের অবস্থান। বিপরীত পাশের পাহাড়ে থরে থরে সাজানো শান্তিপুরার শান্তির আবাসগুলো। বাড়িগুলোর মধ্য দিয়ে পথ করে নিয়ে নিচে নেমেছে একটা ছোট্ট ঝরনা। বেড়ে কিংবা দৈর্ঘ্যে ছোটো হলেও কী তার তর্জনগর্জন। কোনো পাথরকে ভিজিয়ে আর কাউকে এড়িয়ে নিচের ছড়ায় মিলিত হতে দুদ্দাড়ে নেমে পড়েছে সে। পাশেই ধাপে ধাপে সেজে নিচের জনপদে নেমে গিয়েছে বনসাই আকৃতির ঝোঁপালো চা গাছগুলো। কে যেন খাদের পাশ ঘেঁষে বাঁধাকপি লাগিয়েছে। কী সুন্দর রং সেই সবজির!

ছবির মতো এই সুন্দর গ্রামের ইতিহাস খুব বেশি বছরের নয়। নুয়েরা এলিয়ার সাবেক মেয়র উইলিয়াম ফার্নান্দো ১৯৬৩ সালে শহরের বাইরের দিকে জনপদ ছড়িয়ে দেবার তাগিদ থেকে এর পত্তন করেন। আরো একটা কারণ আছে। ভারতীয় তামিল অভিবাসী যারা মূলত চা বাগিচার শ্রমিক, তাদের হাতে জমি চলে যাওয়া ঠেকাতে এখানে সিংহলিদের এনে বসত গড়তে দেওয়া হয়! অথচ ছোট্ট এই দ্বীপদেশে সিংহলিতামিল নামক দুই জাতিসত্তার দ্বৈরথে কোনো অংশেই ঠাঁই মেলেনি ভারতীয় তামিলদের। সিংহলিদের সাথে শ্রী লঙ্কার তামিলদের আলোচনার যুদ্ধে বারবার উপেক্ষিত থেকেছে ভারতীয় তামিল বাগিচা শ্রমিকদের কন্ঠ। উনবিংশ শতাব্দীতে শ্রমিক হিসেবে দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল ভারতীয় এই তামিলদের। অবশ্য একই অবস্থা মুর মুসলিমদেরও। পৃথিবীর ইতিহাস তো মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠদের হাতে সংখ্যালঘুদের নিপীড়িত হওয়ারই ইতিহাস। জাতিগত বিভেদ আর অসন্তোষের ইতিহাস নিয়ে খোঁড়াখুঁড়ি আপাতত মূলতবি রেখে প্রকৃতিতে ফিরি!

পিচ করা রাস্তার দুই ধারে সুন্দর বাগানসমেত বাড়ি। উপর থেকে উতরাই পথে নেমে আসা গাড়ির শব্দ পাওয়া যায় না। সবাই নামে গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে। শব্দহীন যান্ত্রিক দানবের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় একদম পাশে চলে এলে। কলোনিয়াল ধাঁচে বানানো বাড়ি আছে এখানে বেশ কয়েকটা। ব্রিটিশপরিত্যক্ত দেশে এখনো পরিত্যাজ্য হয়ে যায়নি ওদের রেখে যাওয়া স্থাপত্য রীতি। নুয়েরা এলিয়াকে এখান থেকে দেখলে অন্য কোনো জগতের সাজানো শহর বলে ভ্রম হয়। শহরের হরেক কাঠামোর বাড়িঘরগুলো ডুবে আছে যেন নিবিড় পাহাড় আর ঘন সবুজ অরণ্যে। ঈশ্বর গ্রাম বানিয়েছেন, মানুষ বানিয়েছে শহরসেই অপ্তবাক্যটাও ভুল বলতে ইচ্ছে হয়। এই শহর নিশ্চয় ঈশ্বরের নিজ হাতে অতি যত্নে গড়া। শান্তিপুরার চূড়ার দিকে ফের চা বাগান। বস্তুত এই ছোট্ট গ্রাম চা বাগান দ্বারাই বেষ্টিত। বড়ো গাছ বলতে চা গাছকে ছায়া দান করা ছায়াতরুগুলোই। মেঘ ফুঁড়ে সূর্য খানিকটা আলো ফেলেছে চা বাগানের ছোট্ট একটা অংশের উপর। অপার্থিব সেই দৃশ্য এখনো চোখ বন্ধ করলেই যেন আমি দেখতে পারি! চোখে ধন্দ লাগে, স্বর্গ কি এখানেই? কল্পিত স্বর্গ না হোক, মর্ত্যের দু’দণ্ড শান্তি নিশ্চয় এখানেই!

মূলত এই জনপদ সবুজ চায়ের সবুজ ঝোপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছবির মতো গ্রাম। নিচে তাকালে নুয়েরা এলিয়া শহরের মধ্যখানের টুকরো জলাশয় ‘গ্রেগরি লেক’কে মোহনীয় মনে হয়। এক চিলতে আকাশ আর পেছনের পাহাড়গুলোর ছায়া ধারণ করে হাওয়ায় কাঁপছে তিরতির করে। চারপাশের গাঢ় সবুজের মাঝে কাঁচা সবুজের রং ধারণ করে আছে শহরের খেলার মাঠটিও। ঠিক পেছনেই হাকগালা পর্বতের খাড়া গাত্র। শান্তিপুরায় এসে দাঁড়ালে যে কারো পাখি হতে ইচ্ছে করবে! দুই ডানায় ভর করে ওই সুদূরে হারিয়ে যাবার একটা ইচ্ছে আমার মনেও জেগেছিল ক্ষণেকের জন্য। এই গ্রামে গৌতম বুদ্ধ আর ভগবান কার্তিক কাছাকাছি দূরত্বেই অধিষ্ঠিত। পূর্বের সনাতন ধর্মাবলম্বী বাগিচা শ্রমিক ভারতীয় তামিল আর পরেরদিকে আবাস গাড়া বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সিংহলি জনগোষ্ঠীর আলাদা দুই দেবতা।

শ্রী লঙ্কার সর্বোচ্চ পর্বত পিদুরুথালাগালাকে এখান থেকে অনবদ্য লাগে। অবশ্য একবার ক্ষণেকের জন্য দেখা দিয়েই জলভারাতুর মেঘের ফাঁকে মুখ লুকানোয় পর্বতের বদলে নিচের জঙ্গলটাই ভালোমতো দেখার সুযোগ মিলছে। বিশ্বের সবচেয়ে পবিত্রতম পর্বত অ্যাডামস পিকও এখান থেকে দৃশ্যমান। শ্রী লঙ্কার সাধারণ মানুষদের মতো শান্তিপুরার মানুষেরাও শান্ত, সমাহিত। কোথাও একটুকু হাঁকডাক নেই। এই গ্রামে শব্দ বলতে শুধুমাত্র কুকুরের ঘেউ ঘেউ। ঠান্ডার সাথে মানিয়ে নিতে এখানের কুকুরগুলো প্রকৃতির নিয়মানুযায়ীই বেশ রোমশ। একটার গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেই বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। অথচ শ্রী লঙ্কার সারমেয়রা এত সহজে বন্ধুত্ব করে না! অচেনা কাউকে দেখলে ঘেউ ঘেউ শব্দে আত্মারাম খাঁচাছাড়া করার জোগাড় করে ফেলে ওরা। অবশ্য ‘যেমন কুকুর, তেমন মুগুর’ তত্ত্ব অবলম্বন করে হাতে মুগুর তথা বাঁশের কঞ্চি রাখলে ভিন্ন ব্যাপার! উঁচু পর্বতের ছায়ায় থাকতে থাকতে কি এই কুকুরের হৃদয়ও বিশাল হয়ে গেছে?

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধননাইয়া ননাইয়া-গানের বগী ভাই