কবর থেকে তুলে আনা রক্তাক্ত ইতিহাসের বুকে দেশদ্রোহীদেরর বিরুদ্ধে যিনি প্রথম অনির্বাণের শিখা দাবানলের মতো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন লক্ষ তরুণদের বুকে তিনিই আমাদের জননী।
১৯৯২ সালের ১৯শে জানুয়ারি জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ১১০ বিশিষ্ট সদস্যের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করা হয়। তাঁর নেতৃত্বে গণ আদালতের মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের নর ঘাতকদের ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ১২ জন বিচারকদের সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতে গোলাম আযমের মৃত্যুদণ্ড ঘোষিত হয়। সে সময় তৎকালীন সরকার শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে জামিন অযোগ্য মামলা দায়ের করলেও তিনি দমে যাননি বরং আরো স্বাধীনতাকামী বিপ্লবীদের নিয়ে আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেন। ১৯৯৩ সালের ২৮ই মার্চ ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সমাবেশে পুলিশ বাহিনী নির্বিচারে হামলা চালায়। পুলিশের লাঠিচার্জে মারাত্মক আহত হন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। এর প্রতিবাদে শুরু হয় সারা দেশে ব্যাপক আন্দোলন। এমনকি বিদেশের মাটিতে ও বাঙালিরা আন্দোলন শুরু করে।
সেই দীর্ঘ আন্দোলনের আগুনের তীব্র দহন এসে ইতিহাসে পুনরাবৃত্তি ঘটেছে গণজাগরণ মঞ্চে। শাহবাগ আন্দোলনে তরুণদের মুষ্টিবদ্ধ হাত যখন আকাশ ছুঁয়ে চিৎকার করে বলে ‘ফাঁসি চাই ফাঁসি চাই, রাজাকারের ফাঁসি চাই’ আড়ালে তখন একজনের আদর্শই ছুঁয়ে গেছেন প্রতিটি প্রতিবাদী মানুষের রক্ত কণায়। তিনিই আমাদের মা, আমৃত্যু এক সংগ্রামী মহাপ্রাণ। আমাদের মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী। লক্ষ মুক্তিযোদ্ধার শহীদ জননী। তাঁর হার না মানা দীর্ঘ লড়াইয়ের সার্থকতা পেয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিতে। তাঁর সংগ্রামী আন্দোলন গণ– আদালত এখন জনতার স্রোতে মিশে গিয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে। বাঙালি জাতি কিছুটা হলেও কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। যিনি নিজেই তাঁর সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছেন, দেশের জন্য সন্তানকে কোরবানি দিতে যে মায়ের বুক একটুও কাঁপেনি, সন্তান হারানো শোককে শক্তিকে রূপান্তর করে মৃত্যুর আগপর্যন্ত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে অবিচল থেকেছেন শহীদ জননী।
কিন্তু শেষ সময়ে হার মানতে হলো ক্যান্সারের কাছে। মা চলে গেছেন, তাঁর গড়া গণ আন্দোলনে রাজাকারদের ফাঁসি হয়েছে কিন্তু শহীদ জননীর লড়াই এখনো শেষ হয়নি। আজও বাংলার বুকে সামপ্রদায়িক অশুভ শক্তি ৭১ পাকি চেতনাধারী মাথাচাড়া দিয়ে জেগে আছে। আজও তারা বাঙালি সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করার সুযোগের অপেক্ষায় আছে। তাই আমাদের শহীদ জননীর আদর্শ, দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, ইতিহাস এগুলো নিয়ে আরো বেশি চেতনায় ধারণ করতে হবে। একজন আমৃত্যু সংগ্রামী নারীর চিন্তা চেতনাকে সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। তবেই হবে শহীদ জননীর রেখে যাওয়া স্বপ্ন পূরণ দেশদ্রোহী মুক্ত একটি স্বাধীন বাংলাদেশ।