স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ অনুযায়ী দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের শপথ গ্রহণ বাধ্যতামূলক। আবার গেজেট প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যেই সরকারকে এই শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে। অতীতে নির্বাচিত মেয়রকে সরকার প্রধান বা প্রধানমন্ত্রী শপথ পড়িয়েছেন। সাধারণত নির্বাচন কমিশন গেজেট প্রকাশের পর স্থানীয় সরকার বিভাগ মেয়রের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান আয়োজনের উদ্যোগ নেয়।
এদিকে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে বিএনপির প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনকে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। কিন্তু গতকাল বুধবার শপথ গ্রহণের সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করা হয়নি। আবার আজ বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হচ্ছে চারদিনের সরকারি ছুটি। তাছাড়া সরকার পতনের পর স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ সংশোধন করে জারি করা অধ্যাদেশের আলোকে চসিকে প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এ অবস্থায় ডা. শাহাদাত হোসেন কোন প্রক্রিয়ায় এবং কবে শপথ নেবেন সেটা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। একইসঙ্গে শপথ নেয়ার পর তিনি কত দিন দায়িত্ব পালন করতে পারবেন বা তার মেয়াদ কতদিন সেটাও রয়েছে আলোচনায়।
আইনে কী আছে : স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ এর ৭ নম্বর ধারার ২ নম্বর উপধারায় মেয়রের শপথের বিষয়টি উল্লেখ আছে। এতে বলা আছে, ‘মেয়র বা কাউন্সিলরগণের নাম সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হওয়ার ত্রিশ দিনের মধ্যে সরকার বা তদ্কর্তৃক মনোনীত কর্তৃপক্ষ মেয়র ও সকল কাউন্সিলরকে শপথ গ্রহণ বা ঘোষণা প্রদানের ব্যবস্থা করবেন’। একই ধারার ১ নম্বর উপধারায় বলা আছে, ‘মেয়র বা কোনো কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত ব্যক্তি তার কার্যভার গ্রহণের পূর্বে নির্ধারিত পদ্ধতি ও সময়ের মধ্যে সরকার কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তির সম্মুখে শপথ গ্রহণ বা ঘোষণা প্রদান করবেন এবং শপথ বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষরদান করবেন’। অর্থাৎ স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ দায়িত্ব গ্রহণের আগে শপথ গ্রহণ বাধ্যতামূলক। আবার গেজেট প্রকাশের ৩০ দিনের মধ্যেই সরকারকে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে হবে।
জটিলতা কোথায় : সরকার পতনের পর গত ১৭ আগস্ট স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ সংশোধন করে একটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়। অধ্যাদেশে স্থানীয় সরকার আইনের ১৩ ও ২৫ নং ধারার পর আরো দুইটি ধারা সংযুক্ত করা হয়। যা ১৩ক ও ২৫ক ধারা হিসেবে গণ্য। সংযুক্ত ২৫ক ধারায় বিশেষ পরিস্থিতিতে কর্পোরেশনে প্রশাসক নিয়োগ ও কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতা দেয়া হয়। এতে বলা আছে– ‘এই আইনের অন্যান্য বিধানে কিংবা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, সরকার, বিশেষ পরিস্থিতিতে, অত্যাবশ্যক বিবেচনা করলে বা জনস্বার্থে, যে কোনো সিটি কর্পোরেশনে তার কার্যাবলী সম্পাদনের উদ্দেশ্যে, একজন উপযুক্ত ব্যক্তি বা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত উপযুক্ত কর্মকর্তাকে পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত প্রশাসক হিসাবে নিয়োগ প্রদান করতে পারবে’।
এছাড়া সংযুক্ত ১৩ক ধারায় বলা আছে– ‘আইনের অন্যান্য বিধানে কিংবা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যা কিছুই থাকুক না কেন, সরকার, বিশেষ পরিস্থিতিতে অত্যাবশ্যক বিবেচনা করলে বা জনস্বার্থে, সকল সিটি কর্পোরেশনের মেয়র বা কাউন্সিলরগণকে অপসারণ করতে পারবে’।
অধ্যাদেশ জারির একদিন পর ১৯ আগস্ট স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ এর ধারা ১৩ক প্রয়োগ করে চট্টগ্রামসহ দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশনের মেয়রদের স্ব স্ব পদ থেকে অপসারণ করা হয়। একইদিন একই আইনের ২৫ক–এর উপধারা (১) প্রয়োগ করে চট্টগ্রামসহ দেশের ১২ সিটি কর্পোরশনে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়।
তবে মেয়র অপসারণ এবং প্রশাসক নিয়োগের পর গত ১ অক্টোবর চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক খাইরুল আমিন ডা. শাহাদাতকে মেয়র ঘোষণা করে রায় দেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের রেজাউল করিম চৌধুরীর মেয়র নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করেন। পাশাপাশি ১০ দিনের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারির জন্য নির্বাচন কমিশন সচিবকে নির্দেশ দেন। এর আগে ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ডা. শাহাদাত ৯ জনকে বিবাদী করে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেন। এজাহারে তিনি নির্বাচন পরবর্তী ফলাফল সংক্রান্ত প্রকাশিত গেজেট (রেজাউল করিমকে মেয়র ঘোষণা করে) বেআইনি, অবৈধ ও ন্যায় নীতির পরিপন্থী বলে দাবি করেন।
এ অবস্থায় মেয়র অপসারণ ও প্রশাসক নিয়োগের পর ডা. শাহাদাত হোসেনের শপথ গ্রহণ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজাদীকে জানান, নির্বাচন কমিশন থেকে আনুষ্ঠানিক চিঠি পাওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে ড. শাহাদাত হোসেন বলেন, যেহেতু প্রজ্ঞাপন হয়ে গেছে আর কোনো জটিলতা নেই। আশা করছি আগামী সপ্তাহে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। যেহেতু রোববার পর্যন্ত বন্ধ তাই সোমবার শপথ গ্রহণ কবে হবে তার সিদ্ধান্ত হতে পারে।
স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, শাহাদাত হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন আদালত। আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত সরকার আপিল করেনি। এর মধ্যে নির্বাচন কমিশনও প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। তাই বলা যেতে পারে, মেয়র পদে বসার ক্ষেত্রে শাহাদাত হোসেনের তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই। এখন পর্যন্ত তার মেয়রের আসনে বসার অধিকার রয়েছে। তাই বলা যেতে পারে, সরকার যদি আর আপিল না করে, তাহলে শপথের মাধ্যমে মেয়রের দায়িত্ব নিতে পারবেন।
জানা গেছে, ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি চসিকের ষষ্ঠ পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। একই বছরের ৩১ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরীকে মেয়র ঘোষণা করে গেজেট জারি করেন। একই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন তিনি। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার জারি করা সংশোধিত প্রজ্ঞাপনে তার ফলাফল বাতিল করা হয়।
কতদিন দায়িত্ব পালন করতে পারবেন : স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ এর ৬ নম্বর ধারায় বলা আছে– ‘কর্পোরেশনের মেয়াদ হবে কর্পোরেশন গঠিত হওয়ার পর অনুষ্ঠিত প্রথম সভার তারিখ তারিখ থেকে পাঁচ বছর’। এদিকে চসিকের ষষ্ঠ পরিষদের প্রথম সভা হয়েছে ২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। ওই হিসেবে এ পর্ষদের মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ ছিল ২০২৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। আজকেরসহ ইতোমধ্যে ৩ বছর ৭ মাস ১৮ দিন পেরিয়েছে। বাকি আছে ১ বছর ৫ মাস ১২ দিন। অর্থাৎ চলতি মাসে শপথ নিতে পারলে দেড় বছরের কম সময় দায়িত্ব পালন করতে পারবেন ডা. শাহাদাত।
স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ এর ৩৪ নং ধারা অনুযায়ী, কর্পোরেশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববতী ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হয়। অর্থাৎ বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার চসিকের ৭ম পর্ষদের নির্বাচন আয়োজন করতে চাইলে ২০২৫ সালের ২২ আগস্ট থেকে ২০২৬ সালের ২২ ফেব্রয়ারির মধ্যে আয়োজন করতে পারবে। ওই নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী হতে চাইলে পদত্যাগ করতে হবে ডা. শাহাদাত হোসেনকে। তখন ১ বছর ৫ মাস ১২ দিনেরও কম সময় দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাবেন তিনি। তবে দায়িত্ব পেলে স্বল্প এ সময়ের মধ্যেই চট্টগ্রামকে ‘ক্লিন, গ্রিন এবং হেলদি সিটি’তে রূপান্তরে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করবেন বলে আজাদীকে জানিয়েছেন ডা. শাহাদাত হোসেন।