‘ফুল ফুটুক না ফুটুক/ আজ বসন্ত।’ প্রকৃতি আজ খুলে দিয়েছে দক্ষিণের দুয়ার। কবি নজরুলের ভাষায় ‘বসন্ত মুখর আজি/ দক্ষিণ সমীরণে মর্মর গুঞ্জনে/ বনে বনে বিহ্বল বাণী ওঠে বাজি’। তাই তো আজ উৎসব হবে নগরজুড়ে। আজ আবার ভালোবাসা দিবস। বসন্তের রঙে ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে ফাগুনের প্রথম দিনে উচ্ছ্বাসে মাতবেন সবাই। সেই উচ্ছ্বাসের ঢেউ আসবে বইমেলায়ও।
শতবর্ষী বৃক্ষরাজির ছায়ায় ঘেরা নগরের সিআরবি শিরীষতলায় চলছে অমর একুশে বইমেলা–২০২৪। আজ বইমেলার ষষ্ঠ দিন। মেলা প্রাঙ্গণের একশ গজ দূরত্বে সিআরবি সাত রাস্তার মোড়ে চলছে বসন্ত উৎসব। সেই উৎসবের ছোঁয়া পড়বে বইমেলায়ও। তাই অন্যদিনের চেয়েও আজ বইমেলায় পাঠক, লেখক ও দর্শনার্থীর পদচারণায় বেশি জমজমাট হবে বলে আশা প্রকাশকদের। তারা বলছেন, বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ ফুল। তবে যারা ফুল ভালোবাসেন তারা বইও ভালোবাসবেন। তাই প্রিয়জনকে কেবল ফুল নয়, উপহার দেবেন বইও। আজ বেচাকেনা বাকি দিনগুলোকেও ছাড়িয়ে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রকাশকরা।
গতকাল মঙ্গলবার ছিল বইমেলার পঞ্চম দিন। মেলার বাকি দিনগুলোর মতো এদিনও লোক সমাগম ছিল। এরপরও বিক্রি নিয়ে হতাশা প্রকাশ করেন প্রকাশকরা। তারা বলছেন, অনেকেই স্টলে এসে বই হাতে নেন। কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করে বইয়ের সঙ্গে ছবি বা সেলফি তুলে চলে যাচ্ছেন। প্রথম প্রকাশনের স্টলে গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে প্রকাশকদের এ দাবির সত্যতা পাওয়া গেছে। একই চিত্র দেখা গেছে বাতিঘর, শালিক প্রকাশন, প্রজ্ঞালোকসহ বেশ কয়েকটি প্রকাশনা স্টলেও।
প্রথমা প্রকাশনের সামনে কথা হয় ‘সাংবাদিকতায় মৃত্যুকূপের অভিযাত্রী’ গ্রন্থের লেখক মোস্তাক আহমদের সঙ্গে। তিনি আজাদীকে বলেন, প্রথম দিন মেলায় প্রচুর মানুষ ছিল। তাদের দেখে ভালো লেগেছে। ভেবেছি তারা সত্যিকারের পাঠক। পাঠকের আনাগোনা বেড়েছে দেখে খুশি হয়েছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে বেশ কয়েকটি স্টল ঘুরে এবং আজকেও (গতকাল) লক্ষ্য করলাম, অনেকে বই হাতে নিয়ে ছবি তুলছেন, সেলফি তুলছেন। এরপর বইটি রেখে চলে যাচ্ছেন। একই মানুষকে একাধিক স্টলে গিয়ে ছবি তুলতেও দেখি। এটা দুঃখজনক। এসব ফেইসবুকের কারণেই হচ্ছে। বেচাকেনা না হলে তো প্রকাশকরা ভবিষ্যতে মেলায় অংশ নিতে নিরুৎসাহিত হবেন।
চট্টগ্রাম সৃজনশীল প্রকাশক পরিষদের সভাপতি মো. সাহাব উদ্দীন হাসান বাবু আজাদীকে বলেন, ছবি তুলে চলে যাওয়ার বিষয়টি সত্য। এরপরও আমরা আশাবাদী। যেমন কাল (আজ) বসন্ত উৎসব ও ভালোবাসা দিবসে প্রচুর লোক আসবেন। লক্ষাধিক লোকের সমাবেশ ঘটবে। এর মধ্যে ১০ পার্সেন্টও যদি বই কিনে তাহলে বেচাকেনা তো প্রচুর হবে। বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস ঘিরে যারা মেলায় আসবেন তারা হয়তো ফুলকে প্রাধান্য দেবেন। কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, যারা ফুল ভালোবাসবে তারা বইও ভালোবাসবে। কাজেই প্রিয়জনকে কেবল ফুল নয় বইও উপহার দেবেন।
গল্পকার রাজীব রাহুল আজাদীকে বলেন, আগামীকাল (আজ) বসন্ত উৎসব। সিআরবি এলাকায় বসন্ত উৎসবের আয়োজন আছে। তাই আশা করছি এদিন লোকসমাগম হবে এবং সেখানে কিছু পাঠক থাকবেন। ফলে বেচাকেনা বাড়তে পারে। প্রকাশকদের মুখে হাসি ফুটবে আশা করছি।
নন্দন বইঘরের সঞ্জয় সূত্রধর আজাদীকে জানান, বসন্ত উৎসবকে কেন্দ্র করে আলাদা প্রস্তুতি আছে তাদের। শালিক প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী আখতারুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, বেচাকেনা খুব খারাপ অবস্থা। বসন্ত উৎসবের দিন বাড়তে পারে।
নতুন বইয়ের খবর : ‘বাংলাদেশ থেকে ভারত, কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান, রাশিয়া হয়ে ইউক্রেনে পৌঁছতে সময় লেগেছে দেড় বছর। স্লোভাকিয়ায় ঢুকে বন্দি হয় ওরা। তাদের ফেরত পাঠানো হয় ইউক্রেনে। সেখানে ছয় মাস ধরে বন্দি। প্রতিদিন এক ঘণ্টা আলো, তেইশ ঘণ্টা অন্ধকার। আছে কিছু স্মৃতি, নিজেকে হারিয়ে ফেলার ভয় আর একটু স্বপ্ন। ইতালি যেতে হলে তাদেরকে পেরুতে হবে স্লোভাকিয়া ও অস্ট্রিয়া। সীমান্তের একটি রেখা অনেক কিছু পাল্টে দেয়। জীবন ও মৃত্যু, স্বপ্ন ও সম্ভাবনার পথ নির্ধারণ করে দেয়। মানুষ এভাবে কেন যেতে চায়?’ এর উত্তর মিলবে কথাসাহিত্যিক জাহেদ মোতালেবের ‘জয়নালের ইতালিযাত্রা’ উপন্যাসে। বইমেলা উপলক্ষে চন্দ্রবিন্দু থেকে প্রকাশিত বইটি পাঠকের মন জয় করেছে। জাহেদ মোতালেব বলেন, চার–পাঁচ বছর ধরে লিখেছিলাম উপন্যাস ‘জয়নালের ইতালিযাত্রা’।
এছাড়া মেলায় আসা নতুন গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে, কবি ওমর কায়সারের কাব্যগ্রন্থ ‘লাচুংয়ের রাত’, বিভা ইন্দুর ‘বাঘার বাহাদুরি’, শেখ বিবি কাউছারের ‘ভাবনার খেরোখাতা’। শিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, ধর্ম ও সুফিবাদ এবং মনীষীদের জীবনের দৃষ্টান্তের সমন্বয় ঘটেছে প্রবন্ধের এই বইটিতে।
ওমর কায়সারের ‘লাচুংয়ের রাত’ নিয়ে কবি আহমেদ মুনিরের মূল্যায়ন হচ্ছে, কবিতা মূলত এক পরিভ্রমণ। পাঠক তার কাছে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে অলক্ষ্যেই সেই পরিভ্রমণ শুরু হয়ে যায়। এই ভ্রমণ পাঠকের নিজস্ব অনুভূতির নানা তলকে যেমন চিনিয়ে দেয়, তেমনি তার সামনে আরও অচেনা সব অনুভবের ভূমি জাগিয়ে তোলে। কিন্তু কোনো কোনো কবিতা মানুষের চেনা–অচেনা অনুভূতির বিশ্বে যেমন পাঠককে ছুটিয়ে নিয়ে চলে, একই সঙ্গে বাস্তব দুনিয়ার রূপবৈচিত্র্যের জগতেও নিয়ে যায়। ‘লাচুংয়ের রাত’ কাব্যগ্রন্থ পাঠককে সেই অভিজ্ঞতার সামনেই দাঁড় করিয়ে দেবে। এটি একই সঙ্গে নিটোল এক ভ্রমণ কাহিনি আবার জীবনের নানা টুকরো ছবির এক কোলাজ। শব্দের বরফকুচি সরিয়ে পাঠককে এই কাব্যের জগতে প্রবেশ করতে হবে। কবিতার এক গিরিসংকুল পথ দিয়ে হেঁটে যেতে হবে। যেখানে বরফের ওপর জমাট বেঁধে আছে কতকালের কথার ফুলেরা। যেখানে শত নদী স্তব্ধ হয়ে আছে কেবল পাঠকের আলতো স্পর্শের অপেক্ষায়।
মেলামঞ্চে কবিতা উৎসব : গতকাল মেলামঞ্চে ছিল কবিতা উৎসব। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন কবি, সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক আবুল মোমেন। তিনি বলেন, সকল সুন্দরের শ্রেষ্ঠ সুন্দর হলো কবিতা। কবিতা মানুষকে সৌন্দর্যের পথে নিয়ে যায়। কবিতার ভেতর দিয়ে মানব জাতির বিবর্তনের ইতিহাস জানা যায়। যে কোনো অনন্য সৃজনের স্রষ্টা মাত্রই একেকজন শ্রেষ্ঠ কবি। কবি উপাধিটি সমাজের কীর্তিমান মানুষদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জনের স্বীকৃতি।
আবৃত্তিশিল্পী রাশেদ হাসানের সভাপতিত্বে প্রধান আলোচক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সাবেক সভাপতি ও সিনেট সদস্য প্রফেসর ড. সুকান্ত ভট্টাচার্য, কাউন্সিলর নাজমুল হক ডিউক ও কবি ফাউজুল কবির। আলোচনা সভা শেষে কবিরা তাঁদের স্বরচিত কবিতা এবং আবৃত্তিশিল্পীরা অমর একুশের বিভিন্ন কবিতার মনোমুগ্ধকর আবৃত্তি পরিবেশন করেন।