লোকসাহিত্য গবেষক মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী

মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

ইসমাইল জসীম | বুধবার , ২৩ নভেম্বর, ২০২২ at ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ

লোকসাহিত্য ও অবলুপ্ত পুথি সংগ্রহ কর্মে হাতেগুনা যে কজনের নাম আমরা জানি মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী তাদের একজন। দিনরাত যিনি নিজেকে সংগ্রহ ও গবেষণা কর্মে ন্যাস্ত রেখেছেন।

তিনি জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ব্যয় করেছেন গবেষণায়। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে কর্মময় জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি কখনোই বিচ্যুত হননি পুথি ও লোকসাহিত্য গবেষণা থেকে। কী কর্মজীবন, কী ব্যক্তিজীবন তিনি ছিলেন আপদমস্তক একজন লোকসাহিত্য গবেষক। অনেক শ্রমের বিনিময়ে যা কিছু তিনি সংগ্রহ বা সংরক্ষণ করেছেন তা তিনি আগলে রেখেছেন নিজ সন্তানের মতো।

ইসহাক চৌধুরী সম্পর্কে বলতে গেলে যে কথাটি বলতে হয়, তিনি ছিলেন পার্থিব জীবনে নির্মোহ, নির্লোভ, নিরহংকারী, সদালাপী ব্যক্তিত্ব। ইতিহাস ঐতিহ্যে তিনি ছিলেন একজন চলন্ত উইকিপিডিয়া। তিনি যেমন ছিলেন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ, তেমনি ছিলেন ঐতিহ্যের ধারক। চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছিলো তাঁর পদচারণা।

সাতকানিয়া থেকে ফটিকছড়ি। কড়লডেঙ্গা পাহাড় থেকে চন্দ্রনাথ পাহাড়, ভলুয়ার দিঘি থেকে মনুমিয়ার দিঘি প্রতিটি বিষয় ছিলো তাঁর নখদর্পণে। প্রাচীন স্থাপনা, হারানো ঐতিহ্য, লুপ্ত সংস্কৃতি এসব বিষয়গুলোকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার প্রাণান্ত চেষ্টা করেছেন তিনি। বিশিষ্ট ভাষা বিজ্ঞানী ড. মনিরুজ্জামান ইসহাক চৌধুরী সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি ছিলেন নীরব সাধক, নিভৃত গবেষক, শান্ত, ধীর, অপ্রকাশী স্বভাব এবং নির্লোভ মানুষ। সম্মান পাওয়ার জন্য আদৌ প্রত্যাশী হতেন না। প্রচুর মূল্যবান কাজ থাকা সত্ত্বেও খুব সাধারণভাবে থাকতেন, তাঁকে দেখে বোঝা যেত না তিনি কত নিবিষ্ট গবেষক, সে কথা কাউকে বলারও প্রয়োজন মনে করতেন না; যাকে বলা চলে লো-প্রোফাইলে থাকা, তিনি সে ভাবেই থাকতেন বা চলতেন।.. যে কোনও তথ্যের জন্য তিনি হতেন তাৎক্ষণিক রেফারেন্স-বুক, বিশেষত মধ্যযুগ বা লোকসাহিত্য কিংবা লোকজ কবি বা সাহিত্য এবং প্রাচীন বা লোকধর্মী কোনও শব্দ সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর অধিকার ছিল ঈর্ষণীয়। স্থানীয় অনেক লোক-কবিকেও তিনি যথার্থ চিহ্নিত করে গেছেন। আস্কর আলী পণ্ডিতকে তিনি না হলে এভাবে তাঁর মূল্যায়ন হতো কি না সন্দেহ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (রেয়ার সেকশান) বিভাগটি তাঁর তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা হয়েছিল’।

মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী একাধারে একজন লেখক, গবেষক। লেখক হিসেবে তাঁর কোনও প্রকাশিত গ্রন্থ না থাকলেও পাঁচ শতাধিক প্রকাশিত প্রবন্ধ রয়েছে তাঁর। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় গবেষক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে সারাদেশে খ্যাতি থাকলেও তাঁর কোনও বই প্রকাশিত হয়নি। তাই তিনি একজন লেখক হিসেবে রয়েছেন সবার অগোচরে। প্রাচীন পুথি, নবাবিষ্কৃত পুথি পরিচিতি, প্রাক আধুনিক যুগের অপরিচিত-অখ্যাত কবি সাহিত্যিক, সুফি সাধক, চট্টগ্রামের লুপ্তপ্রায় লোক সংস্কৃতি, লোকজ ছড়া, খেলাধুলা, হারিয়ে যাওয়া মৃৎশিল্প, ঐতিহাসিক স্থান, প্রাচীন স্থাপনা, প্রাচীন ঐতিহ্য এসব কিছুই ধরা পড়েছে তাঁর কলমের ডগায়। তিনি শুধু লেখক ছিলেন তা নন, তিনি ছিলেন একজন অনুসন্ধিৎসু গবেষক। তাঁর গবেষণা কর্ম ছিলো খুবই অথেন্টিক। তাঁর গবেষণা কর্ম বাংলাদেশের বিদগ্ধ পণ্ডিদদের দ্বারা স্বীকৃত। তিনি কোনও কিছুকে নিয়ে লিখতে গেলে সরজমিনে তদন্ত বা অনুসন্ধান না করে কলম ধরতেন না। বাংলা সাহিত্যের পণ্ডিত মহলে লোকসাহিত্যের শেষ গবেষক হিসেবে খ্যাত হয়ে আছেন মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী।

ইসহাক চৌধুরী ১৯৫২ সালের ৩০ শে জুন পটিয়া থানার দক্ষিণ হুলাইন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা পুথি গবেষক ও সংগ্রাহক আবদুস সাত্তার চৌধুরী, মাতা ছবিলা খাতুন। শিক্ষক পিতার হাতেই তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় স্থানীয় লড়িহরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এরপর হাবিলাসদ্বীপ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় হয়ে বোয়ালখালী কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমানে সরকারি) থেকে এসএসসি, হুলাইন ছালেহ নুর কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। তাঁর পিতা ছিলেন তখনকার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাচীন পুথি বিভাগের বিবলিও গ্রাফার। ছাত্রাবস্থায় পিতার কাজের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়ে তিনিও নেমে পড়েন প্রাচীন পুথি সংগ্রহের কাজে। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি ইতিহাস ও লোকসাহিত্যের অলিতে গলিতে চষে বেরিয়েছেন নির্ভীকতায়। তিনি আমৃত্যু নিজেকে ব্যাপৃত রেখেছেন সংগ্রহ ও গবেষণা কাজে। দীর্ঘ চার দশক লোকসাহিত্য নিয়ে গবেষণায় তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। লোকসাহিত্যের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ইসহাক চৌধুরীকে আমরা দেখি একজন বৌদ্ধিক আলোকিত ভালো মানুষ হিসেবে।

তিনি কর্মজীবনের শুরুতে ১৯৭৯ সালে হাটহাজারী লালিয়ারহাট সিনিয়র মাদ্রাসায় প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও তিনি ধারণ করেন সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে। গবেষণা ও লোকসাহিত্যের প্রতি সৃষ্টি হয় প্রবল আগ্রহ। পিতার মৃত্যুর পর ১৯৮২ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুষ্প্রাপ্য বিভাগে বিবলিও গ্রাফার হিসেবে যোগদেন। সাত্তার চৌধুরীর একনিষ্ট প্রচেষ্টায় গঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুষ্প্রাপ্য শাখায় পিতার স্থালভিষিক্ত হয়ে পিতাঁর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করেন। তিনি প্রাচীন পুথি পাণ্ডুলিপি ছাড়াও বহু পুরাকীর্তি সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয়কে সমৃদ্ধ করেছেন।

তাঁর সংগ্রহের মধ্যে ফতেয়াবাদস্থ ফকির তাকিয়া থেকে প্রাপ্ত (তাঁর আবিষ্কৃত) সম্রাট আওরঙ্গজেবের নামাঙ্কিত একটি মধ্যযুগীয় শিলালিপি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ পর্যন্ত দু’হাজারের অধিক পুথির পাণ্ডুলিপি তিনি সংগ্রহ করেছেন। তিনি বাংলা ভাষা ভিন্ন দ্বিভাষী পুথিও সংগ্রহ করেছেন। এ দ্বিভাষী পুথির সংখ্যা প্রায় পাঁচশত। এগুলোর মধ্যে কিছু কিছু এখনও বিভিন্ন নামী ব্যক্তিদের কাছেই জমা পড়ে আছে। এসব প্রাচীন ও দুষ্প্রাপ্য পুথি পাণ্ডুলিপি ও দলিল দস্তাবেজ স্বীকৃত কোনো প্রতিষ্ঠান না হলেও তাঁর পিতা বিশিষ্ট পুথিবিশারদ আব্দুস সাত্তার চৌধুরীর নামানুসারে সাত্তার চৌধুরী পুথিশালায় সংরক্ষিত রয়েছে। প্রসঙ্গত এ পুথিশালায় পরিদর্শন করেছেন, গবেষণা করেছেন দেশ বিদেশের প্রখ্যাত ফোকলোর গবেষকগণ। তিনি নিজ প্রচেষ্টায় তাঁর সংগৃহীত এসব প্রাচীন দুস্প্রাপ্য পুথি পাণ্ডুুলিপি, দলিল-দস্তাবেজ, দুর্লভ মুদ্রা ও গ্রন্থ সাময়িকী সহ আরো অনেক দুর্লভ সামগ্রী’র প্রদর্শনীয় আয়োজন করেছেন বেশ ক’বার। একজন ফোকলোরিস্ট হিসেবেও দেশে তাঁর বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী সংগৃহীত পবিত্র কোরআনের পাণ্ডুলিপি প্রায় অর্ধশতাধিক। যার মধ্যে সর্বপ্রাচীন ১০৯৫ হিজরী ও ১০৯৪ হিজরী সনের মোগল যুগের। ১৯৭৬ সালে হাটহাজারীর ফতেয়াবাদস্থ ফকিরতাকিয়া থেকে ফার্সি হরফে সম্রাট আওরঙ্গজেবের নামঙ্কিত একটি প্রাচীন শিলালিপি আবিষ্কার করেন। যা তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জাদুঘরে সংরক্ষণ ও গবেষণার জন্য উপহার দেন।

তাঁর কর্মের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৯৯ সালে মাসিক তরজুমান ‘লেখক সম্মাননা’, ২০১৮ সালে পটিয়া ক্লাব মিলনাায়তনে সাহিত্যবিশারদ স্মৃতি সংসদ কর্তৃক ‘সাহিত্যবিশারদ স্বর্ণপদক’, ২০১৯ সালে জেলা শিল্পকলা একাডেমি, চট্টগ্রাম লোক সংস্কৃতিতে জেলা শিল্পকলা একাডেমি সম্মাননা-২০১৭, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৩ সালে পটিয়াস্থ সৃজনশীল সাহিত্যগোষ্ঠী মালঞ্চ’র প্রদত্ত লেখক সম্মাননা ও সংবর্ধনা। ২০০৭ সালে ‘প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম সাহিত্য একাডেমি, বাংলাদেশ’ লেখক সম্মাননা সহ বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মাননার মাধ্যমে সম্মানীত হয়েছেন। জীবনের অনেক অসমাপ্ত রেখে ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ২৩ নভেম্বর মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের অমর সাধক, গবেষক মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরী মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।

লেখক: শিশুসাহিত্যিক, সাংবাদিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআকাশ ফুরিয়ে যায়
পরবর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে