লোককবি রাধারমণ দত্তের দর্শন ও গান

ইকবাল হায়দার | সোমবার , ২১ এপ্রিল, ২০২৫ at ৬:১৯ পূর্বাহ্ণ

সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার আতুয়াজান পরগনার কেশবপুর গ্রামে ১২৪১ বঙ্গাব্দের বৈশাখ থেকে পৌষ যে কোনো মাসের পাঁচ তারিখ, ইংরেজি ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে রাধারমণ দত্ত জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম রাধামাধব দত্ত ও মাতার নাম সুবর্ণা দেবী। রাধামাধব দত্ত বাংলা ও সংস্কৃত ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। রাধারমণ দত্ত ছিলেন রাধামাধব দত্তের কনিষ্ট পুত্র।

বাউল কবি রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ, রাধা কিসব দত্ত, সাধক কবি রাধারমণ দত্ত, বাউল সাধক রাধারমণ, বাউল কবি রাধারমণ, বৈষ্ণব কবি রাধারমণ দত্ত, মরমী কবি রাধারমণ, তত্ত্ব সাহিত্যের কবি রাধারমণ দত্ত, কবি রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ, মরমী সাধক রাধারমণ,সাধক বাউল রাধারমণ, লোক কবি রাধারমণ দত্ত, রাধারমণ দত্ত পুরকায়স্থ, যে কোন অভিধায়ে বা বিশেষণেই সকল বিশিষ্ট লেখক, গবেষক, সাহিত্যিক, সম্পাদক, লোকসংগীত সংগ্রাহক, তাত্ত্বিক, প্রাবন্ধিক, সংগীতকার, জীবনীকার ও ফোকলোর সংগ্রাহকবৃন্দ রাধারমণকে ডাকুক না কেন রাধারমণকে সিলেটের সর্বত্র বাউল কবি বলেই জানে। যা তাঁর জীবনাচরণ ব্যাখ্যায় দৃষ্ট হয়।

রাধারমণ কৈশোর থেকেই তত্ত্বজিজ্ঞাসু ছিলেন। ঈশ্বর লাভের পদ্ধতি জানার জন্য তিনি বিভিন্ন সাধকের উপদেশ পালন করেছেন। শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব বিভিন্ন মতবাদ অধ্যয়ন করেও তার প্রশ্নের উত্তর তিনি খুঁজে পাননি। অবশেষে মৌলভীবাজারের নিকটবর্তী ঢেউপাশা গ্রামের সাধক রঘুনাথ গোস্বামীর সান্নিধ্যে এসে রাধারমণের তৃষিত হৃদয় শীতল হয়। তিনি তাঁর কাছে সহজিয়া পদ্ধতি সাধনায় প্রবৃত্ত হন যাতে কৃষ্ণ প্রেমে বিভোর রাধারমণের হৃদয় কন্দরের শুষ্ক সুপ্ত প্রেমনির্ঝরিনী পরিপূর্ণ ও জাগ্রত হয়ে ওঠে। তাই বিষয় বাসনা ত্যাগ করে তিনি বাড়ির অদূরে নলুয়ার হাওরের পাশে একটি আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেখানেই সাধনা করতে থাকেন। ধ্যানমগ্নতার মধ্যেই তিনি গীত রচনা করতেন। ভক্তবৃন্দ তা স্মৃতিতে ধারণ করে রাখতেন। ১৩২২ বঙ্গাব্দের ২৬ কার্তিক শুক্রবার রাধারমণ দত্ত ইহধাম ত্যাগ করেন। তাঁর দেহ ভস্মীভূত না করে বৈষ্ণব মতে সমাহিত করা হয়।

সিলেট থেকে প্রকাশিত মাসিক সমীকরণ (সেপ্টেম্বরনভেম্বর ১৯৯১)-বাউল কবি রাধারমণ ‘নামের একটি লেখায় উল্লেখ আছে,’ প্রকৃতপক্ষে রাধারমণ ছিলেন বৈষ্ণব সহজিয়া ’। চৈতন্যদেবের সমকালে স্বরূপ দমোদররায় রামানন্দচৈতন্য প্রবর্তিত রাগাত্মিকা ভক্তিধর্মের সাধ্যসাধনতত্ত্ব সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান লাভ করেছিলেন। তাঁর তিরোধানের পর বৌদ্ধ, শাক্ত, শৈব ধর্মের বুড়ি ছুঁয়ে ছুঁয়ে বৈষ্ণব দেহবাদী সহজিয়া ধর্ম প্রবর্তিত হয়। সহজিয়া ধর্মে সমন্বয় ঘটেছে শাক্ত আচারের সংগে বৈষ্ণব ও সহজিয়া বৌদ্ধ প্রভাবিত তত্ত্বের। এ সকল তত্ত্বের সমাহারে আনুষ্ঠানিক মিলনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা ঘটে সহজিয়া বৈষ্ণব মতবাদের।

বৈষ্ণব সহজিয়া মতবাদের একজন পণ্ডিত ড. শশীভূষণ দাসগুপ্ত উল্লেখ করেছেন যে, প্রত্যেক নরনারীর দৈহিক রূপের মধ্যেই তাহাদের স্বরূপ লুকায়িত আছে। নররূপে নর, স্বরূপে কৃষ্ণ, তেমনি নারীরূপে নারী, স্বরূপে রাধা’।

অন্যজন গোপীনাথ কবিরাজ, (ভূমিকা চৈতন্যোত্তর চারিটি সহজিয়া পুথি, পরিতোষ দাস) বলেন, ‘সহজ মানুষ হইবার সাধনা দুরূহ। সামান্য মানুষ সর্বত্র আছে। কিন্তু সহজ মানুষ চৌদ্দ ভুবনের কোথাও নাই, তাদের গড়িয়া নিতে হয়। তাহা হয় রাগানুরাগ ভজনে। এই ভজনের একটি ক্রম বর্তমান। এই ক্রমের প্রথমটি প্রবর্ত অবস্থা। প্রবর্ত অবস্থায় প্রথমে নামকে আশ্রয় করিয়া সাধনা চলে। তখন গুরুর আজ্ঞা পালন এবং অকৈতব কৃষ্ণ প্রেম, সাধুসংগ করিয়া চলিতে হয়, দ্বিতীয় অবস্থা সাধক অবস্থা। এ সময় আশ্রয়ভাব। তৃতীয় অবস্থা সিদ্ধ অবস্থা। ইহার দুটি আশ্রয়; একটি প্রেম, অপরটি রস। প্রবর্ত অবস্থায় ইন্দ্রিয় সংযম ও সৌচাদি আচরণপূর্বক গুরুর নিকট হইতে নাম প্রাপ্ত হইয়া নাম এবং নামীয় অভেদকল্পনাপূর্বক তাহা অনুক্ষণ জপ করিতে করিতে অন্তর ও দেহের কলুষ নিবারিত হয় ও সাত্ত্বিক বিকারাধির উদয় হইয়া থাকে। সাধক অবস্থায় ভাবই আশ্রয়। এই অবস্থায় কামজয় একান্ত আবশ্যক। যখন কাম নিজের বশীভূত তখন নিজের ভাব অনুসারে নায়িকা গ্রহণ করিতে হয়। সাধক অবস্থায় নিজেকে প্রকৃতি মনে করিতে হয়। কিন্তু সিদ্ধাবস্থায় নিজের প্রকৃতি ভাব সম্পন্ন হইয়া যায়, ফলে প্রেমসাধনায় অগ্রসর হইবার পথ খুলিয়া যায়’।

রাধারমণের গানে সহজিয়া বৈষ্ণব মতবাদসম্পর্কে যে সকল লক্ষণের কথা বলা হয়েছে তার সবই আছে। রাধারমণের গান বিশ্লেষণ করলে তার সহজিয়া ভাবের রসমূর্তি সহজেই ধরা পড়ে। সহজিয়া বৈষ্ণব ধর্মই ছিল রাধারমনের জীবনদর্শন।

বঙ্গদেশের প্রচলিত লোকসংগীত গীত হলেও হাটে, ঘাটে, মাঠে, নৌকার মাঝির কণ্ঠে, সাধারণ মানুষের লোক উৎসবে যাঁর গান সর্বত্র গীত হয় তিনি রাধারমণ। এই সুবাদে রাধারমনের অবিসংবাদিত পরিচয় তিনি লোককবি।

মানুষ মোহিত হয়ে শোনে

ভ্রমর কইও গিয়া

শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনলে

অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে ভ্রমর কইও গিয়া।

আমাদের লোকসংস্কৃতির একটি অংশ তাঁর গান। রাধারমণের গীতিকাব্যে তার নামাংকিত হলেও নিঃসেন্দহে লোকসাহিত্যের অন্তর্গত এবং রাধারমণ সার্থক লোককবি।

সাধক কবি রাধারমণ তাঁর বেশিরভাগ গানেই রাধাকৃষ্ণের বিরহ যন্ত্রণার ভাবের রূপটি ফুটিয়ে তুলেছেন, শ্রীকৃষ্ণের জীবন ও তার লীলা, মানুষের হাসি কান্না, আনন্দ বেদনা, প্রেম বিরহ সকল ভাবকেই প্রকাশ করেছে। শ্রীমতি রাধারাণীর সাথে কৃষ্ণের ভাব বিনিময় ও প্রেমের লীলাটি ছিল অন্যতম। কাব্যে, সাহিত্যে, সংগীতে, নাট্যে, রাধা কৃষ্ণের এই প্রেম, বিরহ, রাগ, অনুরাগ প্রকাশিত হয়েছে যুগে যুগে। যেহেতু ধামাইলে কৃষ্ণলীলাই গীত হয় তাইধামাইল বলতে রাধারমণের গানকেই বোঝায়। ধামাইল নৃত্যে রাধারমণের গানই গীত হয়।

রাধারমণের গান ধামাইল নৃত্যকে উজ্জীবিত ও সঞ্জীবিত করে বাংলা লোক নৃত্যে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ‘ধামালী’ শব্দ থেকে ধামাইল শব্দের উৎপত্তি। ধামালী শব্দের অর্থ অঙ্গভঙ্গী করে নাচ। ধামালী থেকে অপনিহিত শব্দ ধামাইল। ‘ধামাইল’ বৃহত্তর সিলেট এবং আসামের বরাক উপত্যকার প্রচলিত প্রসিদ্ধ আন্‌চলিক নৃত্যগীত। যে কোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান বিশেষ করে বিয়ের উৎসবে এ গানের প্রচলন মাত্রাধিক। মেয়েরা দুহাতে তালি

বাজিয়ে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে সমবেত কণ্ঠে এ গান পরিবেশন করে থাকেন।

গ্রামে বিবাহ, উপনয়ন, অন্নপ্রাশন, সাধভক্ষণ, দুর্গাপূজা, মনসাপুজা, সূর্যব্রত, ইত্যাদি অনুষ্ঠান ধামাইল ছাড়া সম্পন্ন হয় না। ধামাইল কৃষ্ণলীলায় গীত হয়।

সকল ধামাইল গানের শেষ অংশের সঙ্গে ‘ভাইবে রাধারমণ বলেকথাটি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

যেমন, ‘ভাইবে রাধারমণ বলে শোনরে কালিয়া

নিভা ছিল মনের আগুন

কে দিলাই জ্বালাইয়া রে

ভ্রমর কইও গিয়া।।

বা

জলের ঘাটে দেইখ্যা আইলাম

কি সুন্দর এক শ্যামরায়

এগো শ্যামরায় ভ্রমরায়

ঘুইরা ঘুইরা মধু খায়।

বা

আমার বন্ধু দয়াময়

তোমারে দেখিবার মনে লয়

তোমারে না দেখলে রাধার

জীবন কেমনে রয়।

ইত্যাদি অসংখ্য ধামাইল গানে প্রধানত কৃষ্ণ প্রেমের মধুর লীলাই গীত হয়েছে। সিলটি পঁচান্নব্বই শতাংশ গানই রাধারমণের রচিত। ধামাইল নৃত্যেও রাধারমণের গানই গীত হয়। বিভিন্ন লোকাচারের অঙ্গ এই ধামাইল গান। তার গানের লোকপ্রিয়তা প্রধানত ধামাইল নৃত্যের সংগীতে। যা মুসলমান সমাজের মধ্যে সমান জনপ্রিয়।

লোককবিদের মধ্যে একটু ভিন্ন রাধারমণ দত্ত। অন্য কোনো কবি বৈষ্ণব পদ রচনা করেন নি। বৈষ্ণব দর্শনের গভীর তত্ত্ব রাধারমণের গানে পাওয়া যায়। যেমন তার লেখায় পাওয়া যায়, কৃষ্ণ সুখে দেহ রাখা যে কঠিন কাজ। পার্থিব জগতের ঊর্ধ্বে নিত্য লোকের পরমাত্মা শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে জীবাত্মার মিলন ঘটানোই বৈষ্ণবীয় সাধনার মূল কথা। সেই সহজিয়া পথেই যাত্রা করেছিলেন রাধারমণ।

বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বিরহ, বেদনা, ধর্ম, ভাবনাকে অসাধারণ করে গানে গানে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। রাধারমণ ছিলেন গভীর প্রেমের কবি। ভাবে বিভোর হয়ে নিজের মনে গান গেয়েছেন। তার গানের কথা ও সুর খুবই মধুর। তাঁর গানের গীতভাণ্ডার বৈচিত্র্যময়। তিনি ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার ও কণ্ঠশিল্পী। তিনি মানুষের মাঝে ঈশ্বরের প্রতি প্রেমের নতুন ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে অমর হয়ে আছেন। তিনি তাঁর রহস্যাবৃত আলোকিত ক্ষমতার বলে তার সৃষ্টিকে রেখে গেছেন বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক, সংগীতশিল্পী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার গ্রীষ্মের মুগ্ধতা
পরবর্তী নিবন্ধগাজা হত্যাকাণ্ড : মূল হত্যাকারীদের আড়াল করার নতুন প্রচেষ্টা