‘লেখাটাকে আনন্দের বিষয় করে নিতে হবে’

রাশেদ রউফ | মঙ্গলবার , ৩ জুন, ২০২৫ at ১০:৫০ পূর্বাহ্ণ

সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’।

কেউ কেউ কবি নয়, সকলেই কবি’।

কবিতার কথা’য় জীবনানন্দ দাশ অনেক বিষয়ের অবতারণা করেছেন। এর বাইরে জীবনানন্দের যে কথাটি মানুষের মুখে মুখে ফেরে, সেটি হলো ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’। কবিতা লিখলেই কবি হওয়া যায় নাএমন মত পোষণ করেন তাঁর মতো অনেকেই।

অন্যদিকে, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেছেন, ‘কেউ কেউ কবি নয়, সকলেই কবি।’ তিনি তাঁর ‘কবিতার ক্লাশ’এ লিখেছেন : ‘কবিতা লিখবার জন্যে আলাদা রকমের মানুষ হবার দরকার নেই। রামা শ্যামা যদু মধু প্রত্যেকেই (ইচ্ছে করলে এবং কায়দাগুলোকে একটু খেটেখুটে রপ্ত করে নিলে) ছন্দ ঠিক রেখে, লাইনের পর লাইন মিলিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতে পারে। তার জন্যে, বলাই বাহুল্য, কিছু জিনিস চাই, এবং কিছু জিনিস চাই না। আগে বলি কী কী চাই না ১. কবি হবার জন্যে লম্বালম্বা চুল রাখবার দরকার নেই। ওটা হিপি হবার শর্ত হতে পারে, কিন্তু কবি হবার শর্ত নয়। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, চুল খুব ছোটো করে ছেঁটেও কিংবা মাথা একেবারে ন্যাড়া করে ফেলেও কবিতা লেখা যায়। চুলের সঙ্গে বিদ্যুতের সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে, কবিতার নেই। ২. সর্বক্ষণ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকবার দরকার নেই। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, মাটির দিকে তাকিয়েও কবিতা লেখা যায়। সবচাইতে ভালো হয়, যদি অন্য কোনও দিকে না তাকিয়ে শুধু খাতার দিকে চোখ রাখেন। ৩. কখন চাঁদ উঠবে, কিংবা মলয় সমীর বইবে, তার প্রতীক্ষায় থাকবার দরকার নেই। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, অমাবস্যার রাত্রেও কবিতা লেখা যায়, এবং মলয় সমীরের বদলে ফ্যানের হাওয়ায় কবিতা লিখলে তাতে মহাভারত অশুদ্ধ হয় না। ৪. ঢোলাহাতা পাঞ্জাবি পরবার দরকার নেই। পরীক্ষা করে দেখা গেছে, স্যানডো গেঞ্জি গায়ে দিয়েও, কিংবা একেবারে আদুর গায়েও, কবিতা লেখা সম্ভব। এইবার বলি, কবিতা লিখতে হলে কী কী চাই। বিশেষকিছু চাই না। দরকার শুধু ১. কিছু কাগজ (লাইনটানা হলেও চলে, নাহলেও চলে)। ২) একটি কলম (যেকোনও সস্তা কলম হলেও চলবে) অথবা একটি পেনসিল এবং. কিছু সময়। কিন্তু এতসব কথা আমি বলছি কেন? কবিতার কৌশলগুলিকে সর্বজনের হাতের মুঠোয় এনে নাদিয়ে কি আমার তৃপ্তি নেই? সত্যিই নেই। ইংরেজিতে ‘পোয়েট্রি ফর দি কমন ম্যান’ বলে একটা কথা আছে। আমার ইচ্ছে, কমন ম্যানদেরও আমি পোয়্‌ট বানিয়ে ছাড়ব। পরশুরামের কথা মনে পড়ছে। তাঁর প্রতিজ্ঞা ছিল, পৃথিবীকে একেবারে নিঃক্ষত্রিয় করে ছাড়বেন। কিন্ত, নাপারবার হেতুটা যাই হোক, কাজটা তিনি পারতেপারতেও পারেননি। বিশ্বসংসারকে যাঁরা নিষ্কবি করে ছাড়তে চান (অনেকেই চান), তাঁরাও সম্ভবত শেষ পর্যন্ত পেরে উঠবেন না।’

লেখক হওয়া মূলত সাধনার ব্যাপার। তাতে নিষ্ঠা থাকতে হবে, করতে হবে চর্চা। সবার আগে লেখালেখির জন্য থাকতে হয় পর্যাপ্ত প্রস্তুতি। প্রখ্যাত লেখক স্টিফেন কিং লেখালেখির জন্য উৎসাহ দিয়ে নতুনদের বলেছেন, ‘প্রাথমিকভাবে নিজের জন্য লেখো। লেখাটাকে আনন্দের বিষয় করে নিতে হবে। যা ভালো লাগে, তাই নিয়ে লেখো। নিজের ওপর কোনো জিনিশ জোর করে চাপিয়ে দেবে না যা থেকে বিরক্তি উৎপন্ন হয়।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘শব্দ ও বাক্যের মাধ্যমে তোমার ধারণাগুলো পাঠকের মনে সঞ্চারিত করো। লেখার সময় কোন্‌ ধরনের পাঠকের জন্য লিখছ, তা মাথায় রাখো, আর তোমার ধারণাগুলো তাদের উপযোগী করে প্রকাশ করো। লেখালেখিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করো। লেখাকে করতে হবে ধ্যানজ্ঞান। একমাত্র সাধনা। দায়সারা কাজ অকাম্য। লেখালেখির বিষয়ে যে যত সিরিয়াস, সে তত সফল।’

লেখার ইস্কুল’ প্রবন্ধে বুদ্ধদেব বসুও লেখালেখির জন্য প্রস্তুতির কথা বলেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘…প্রতিভাবান চিত্রকরও আর্ট স্কুলে হাত পাকিয়ে থাকলে লজ্জাবোধ করেন না, সংগীতের স্কুলেও সাংগীতিকের উপকৃত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু লেখার কোনো ইশকুল নেই। যে লোক একখানা সাধারণ চিঠিও লিখতে পারে না, সেও মনে করতে পারে যে লেখক হওয়ার যোগ্যতা তার আছে। যেহেতু আমি বর্ণমালার সঙ্গে পরিচিত, ইচ্ছে করলেই আমি লেখক হতে পারি। কিন্তু ইচ্ছে করলেই লেখক হওয়া যায় না, লিখতেও শিখতে হয়।’ বুদ্ধদেব বসু শুধু লেখেননি, লিখতে শিখিয়েছেনও। তিনি একজন নিষ্ঠাবান ঋষির মতোই সাহিত্যে ধ্যানমগ্ন ছিলেন আমৃত্যু। তিনি এটাও বলেছেন, জীবনকে দেখতে শেখাই লেখকের প্রধান দায়িত্ব।

.

সৃজনশীল লেখালেখি বিষয়ক এক অভাবনীয় কর্মশালা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম গত ২৬ মে, হালিশহর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজে। স্কুলকলেজ পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের জন্য এমন কর্মশালা এর আগে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আয়োজন করেছে কিনা আমার জানা নেই। ‘এসো শব্দের কুঁড়ি দিয়ে গল্পের মালা বানাই’ শীর্ষক এই কর্মশালায় আমার সঙ্গে ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সায়মা আলম।

তথ্য প্রযুক্তির সহজলভ্যতা ও নানা প্রলোভনে আজকালকার কিশোররা তাদের সৃজনশীলতাকে ভুলতে বসেছে। এ অবস্থায় হালিশহর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের মননশীলতা ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আয়োজন করা হয় এই কর্মশালার। প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ লে. কর্নেল মোঃ গোলাম মোর্শেদ, পিএসসি’র সভাপতিত্বে উক্ত কর্মশালায় দুই পর্বে ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম এবং ৯ম থেকে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে। প্রতিষ্ঠানের উপাধ্যক্ষ সাইফুল ইসলাম বুলবুল, সহকারী প্রধান শিক্ষিকা ডালিয়া বড়ুয়া, কর্মশালা কমিটির সমন্বয়ক অধ্যাপক গোলাম মোস্তফা ও কমিটির অন্যান্য সদস্য এতে উপস্থিত ছিলেন।

শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীল লেখার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি ও কৌশল নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আমরা তাদের মেধা আর সপ্রতিভ বুদ্ধিবৃত্তির প্রশংসা না করে পারি না। প্রায় প্রতিটি শিক্ষার্থী ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।

আমি সবসময় নতুনদের উৎসাহিত করি এইভাবে যে, তুমিও পারবে। শুরুটা করে দেখো, তখন তোমাকে নিয়ে যাবে তোমার গন্তব্যে। যারা গল্প প্রবন্ধ লিখতে চায়, তাদের লেখালেখির অনুশীলনের শুরুটা হতে পারে মুক্তগদ্য লেখার মাধ্যমে। যেমনটি মানুষ ডায়েরি লেখে। আজ দিনটা কীভাবে কাটালে, কী কী করলে, কোথায় গেলে, কী বিষয়টি তোমার ভালো লাগলো, কোন্‌ দিকটা তোমার মনে বিষাদরেখা এঁকে দিলো, সব ধীরে ধীরে লিখে ফেলো। দেখবে লেখার উপকরণ পেয়ে গেছো। লেখার সময় পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করার চেষ্টা করবে। তাতে তোমার বর্ণনার দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।

কর্মশালায় এক শিক্ষার্থী প্রশ্ন করেছিলোআমি লিখতে চাই, কিন্তু লেখার বিষয় কী হতে পারে, তা মাথায় আসে না। আসলে যে কোনো বিষয়ে লেখা যায়। কিন্তু প্রথম প্রথম লেখার বিষয়বস্তু সহজ হলে ভালো। যেমন মাকে নিয়ে লেখা যায়। বাবাকে নিয়ে লেখা যায়। কোনো উপলক্ষ্যের দরকার নেই। এরপর ধীরে ধীরে দেখা যাবে নানা বিষয় তোমার কাছে এসে ভিড় করছে। লেখাটি লিখে তোমার বন্ধুকে দাও পড়তে। সে হতে পারে তোমার লেখার প্রথম পাঠক।

আর যারা ছড়া কবিতা লিখতে চায়, তাদের জন্য পরামর্শ হলোবেশি বেশি ছড়া কবিতার বই পড়তে হবে। যত বেশি ছড়া আর কবিতা পড়বে, তত বেশি সমৃদ্ধ হবে। তোমার ভেতরে তৈরি হবে কবিতা লেখার আগ্রহ। ছন্দ আয়ত্তে আসবে। সুর আসবে মাথায়। আরেকটু বড় হলে ছন্দের বই পড়ে আরো বেশি পোক্ত হওয়া যাবে। আপাতত আমি বলবো শুধু পড়া। পড়াই হতে পারে লেখক হওয়ার প্রথম সোপান। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বলেন, ‘কবিতার মধ্যে তিনটি জিনিস থাকা চাই। কাব্যগুণ, ছন্দ, মিল। বিনা ডিমে যেমন ওমলেট হয় না, তেমনই কাব্যগুণ না থাকলে কবিতা হয় না। তার প্রমাণ হিসেবে আসুন, আমার সেই মাসতুতো ভাইয়ের ছোটোছেলের লেখা চারটে লাইন শোনাই: সূর্য ব্যাটা বুর্জোয়া যে, দুর্যোধনের ভাই। গর্জনে তার তূর্য বাজে, তর্জনে ভয় পাই। বলা বাহুল্য, এটা কবিতা হয়নি। তার কারণ, ছন্দ আর মিলের দিকটা ঠিকঠাক আছে বটে, কিন্তু কাব্যগুণ এখানে আদপেই নেই। এবং কাব্যগুণ নাথাকায় দেখা যাচ্ছে ব্যাপারটা নেহাতই বাক্যের ব্যায়াম হয়ে উঠেছে। এবারে মিলের কথায় আসা যাক। মিল নারেখে যে কবিতা লেখা যায় না, তা অবশ্য নয়, তবু যে আমি মিলের উপর এত জোর দিচ্ছি তার কারণ:

. প্রথমেই যদি আপনি মিলছাড়া কবিতা লিখতে শুরু করেন, তাহলে অনেকেই সন্দেহ করবে যে, মিলএ সুবিধে হয়নি বলেই আপনি অমিলের লাইনে এসেছেন। সেটা খুব অপমানের ব্যাপার। ২. মিল জিনিসটাকে প্রথম অবস্থায় বেশ ভালো করে দখল করা চাই। তবেই সেটাকে ছেড়ে দিয়েও পরে ভালো কবিতা লেখা সম্ভব হবে। ব্যাকরণ বস্তুটাকে প্রথমে বেশ ভালো করে মান্য করা চাই, তবেই পরে সেটাকে দরকারমতো অমান্য করা যায়। ঠিক তেমনি, পরে যাতে মিলের বেড়া ভাঙা সহজ হয়, তারই জন্যে প্রথম দিকে মিলটাকে বেশ আচ্ছা করে রপ্ত করতে হবে। ছন্দ কিন্তু সবসময়ই চাই। আগেও চাই, পরেও চাই।’

লেখককর্মশালার গুরুত্ব অনেক। যদিও অনেকে বলবেন, লেখালেখি শেখানোর জিনিস নয়। লেখা আসে স্বপ্রণোদিত হয়ে, প্রশিক্ষণ দিয়ে লেখক তৈরি হয় না। আমি মনে করি, শেখার কোনো বিকল্প নেই। এ ধরনের কর্মশালায় নিজের ভেতরে তৈরি হওয়া কিছু জিজ্ঞাসার উত্তর মেলে; লেখার অনুভূতিকে উসকে দেয়। প্রচুর নামীদামি লেখকের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়, গুরুত্বপূর্ণ বইয়ের খোঁজ মেলে। ভাষাজ্ঞান, ছন্দ অন্ত্যমিল প্রভৃতি বিষয়ে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। সর্বোপরি ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিতে দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে। এজন্য বাংলা একাডেমিসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো লেখালেখির কর্মশালার আয়োজন করে থাকে। তাই এধরনের কর্মশালাকে আমরা অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করি।

লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;

ফেলো (নম্বর৪২২), বাংলা একাডেমি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভোগ নয় ত্যাগেই আনন্দ : প্রসঙ্গ- কোরবানীর ঈদ
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজারে গরু কিনে ফেরার পথে ছুরিকাঘাতে কিশোর নিহত