নুরুল আলম আতিকের কাজ বরাবরই ন্যারেটিভ। প্রথম চলচ্চিত্র ডুব সাঁতারে এই বৈশিষ্ট্য আমরা দেখেছি। দেখেছি বিভিন্ন টিভি নাটকে। ২০০৩ সালে যে ছবির চিত্রনাট্যের জন্যে তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান, আবু সাইয়িদ পরিচালিত সেই ‘কিত্তন খোলা’ ছবিতেও তার ন্যারেটিভিটির প্রচুর নিদর্শন আমরা দেখেছি। দ্বিতীয় ছবি লাল মোরগের ঝুঁটিতে আমরা আবার তা দেখলাম এবং আবারও ভালো লাগলো। একটি সত্য ঘটনাকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে আতিক মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অনুষঙ্গকে এমনভাবে তাঁর কাহিনী ও চিত্রনাট্যে বিন্যাস করেছেন যা মর্মস্পর্শী হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বছরে আতিকের চলচ্চিত্রার্ঘ্য আমাদের মুক্তিসংগ্রামকে বিস্তৃতভাবে আবার আমাদের চোখের সামনে নিয়ে এলো।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপকতা বিশাল। কেবল সামরিক দিক নয়, এই জনযুদ্ধের ছিল অনেকরকম রাজনৈতিক ও সামাজিক স্তর। আতিক তার এই ছবিতে সামরিক দিককে নেপথ্যে রেখে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশেষ করে সামাজিক দিকটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন। এই ধরনের প্রয়োগ আমরা ইতোপূর্বে আমাদের কয়েকটি ছবিতে দেখেছি যার কয়েকটি বেশ সফল প্রয়োগ। তবে লাল মোরগের ঝুঁটিতে তা এককেন্দ্রিক নয়। পক্ষের বিপক্ষের বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে থেকে অনেকগুলি স্তরে মুক্তিযুদ্ধকে এ ছবিতে ধরা হয়েছে। পরিচালকের পরিমিতিবোধ প্রশংসনীয়। অযথা কোনো অধ্যায়কে দীর্ঘ করেননি। তেমনি যুদ্ধের লড়াইয়ের দৃশ্য দেখানোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত সংযমের পরিচয় দিয়েছেন পরিচালক। এ ধরনের কোনো দৃশ্যই পরিচালক চিত্রনাট্যে রাখেননি, যা সচরাচর বেশি থাকে এ-ধরনের ছবিতে এবং প্রায়শই তা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে অসমর্থ হয়। যে কোনো যুদ্ধের সামরিক দিকটা হয় এক রৈখিক। কিন্তু সে যুদ্ধের নেপথ্যে থাকে শত শত ঘটনা। পরিচালক এই দিকে জোর দিয়েছেন। অনেক ঘটনার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে তার কাহিনী ও চিত্রনাট্য। এজন্য প্রচুর ডিটেলসের ব্যবহার রয়েছে ছবিতে। যা চিত্রনাট্যকে গতিশীলতা এনে দিয়েছে। আতিকের চিত্রনাট্যের প্রশংসা আমরা শুরুতে করেছি। এ-ছবির চিত্রনাট্যও যথেষ্ট ছিলেটান, তরতর এগিয়ে চলে এবং এক্ষেত্রে যোগ্য সঙ্গত করেছেন সম্পাদক সামির আহমেদ।
তবে চিত্রগ্রহণ সে তুলনায় সাদামাটা। ছবিটি সাদা কালোতে তোলা। সুযোগ ছিল অনেক টোনাল মন্তাজের। পরিচালককে আবারও ধন্যবাদ বিশেষ কোনো দৃশ্য বা দৃশ্যাবলিকে রঙিন না করার জন্য। ছবির সংলাপও যথেষ্ট স্বাভাবিক এবং স্বচ্ছন্দ। সংগীতের পরিমিত ব্যবহার প্রশংসনীয় হলেও আরো ভালো হওয়ার সুযোগ ছিল। ছবিতে কয়েকটি দৃশ্যে ভায়োলেন্সের অবকাশ ছিল, পরিচালক মুনশিয়ানার সঙ্গে তা পরিহার করেছেন।
লাল মোরগের ঝুঁটি ছবির আরেকটি বিশেষ গুণ টাইপেজের ক্ষেত্রে সংযম। অভিনয় শিল্পী নির্বাচন, ডিটেলস নির্মাণ, ইত্যাদি ক্ষেত্রে তিনি প্রচলিত টাইপেজ গুলো বর্জন করেছেন। বিশেষ করে দুই পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা, রাজাকার এসব চরিত্রের অভিনেতাদের কাস্টিং ও তাদের সংযমী অভিনয়ের ক্ষেত্রে। পুরো ছবির অভিনয়াংশ খুবই সাবলীল যা আমাদের ছবিতে প্রায়ই পাওয়া যায় না। নবীন-প্রবীণ সবাই সমান লয়ে অভিনয় করেছেন। তবে আহমেদ রুবেল, লায়লা হাসান, শিল্পী সরকার অপু, শাহজাহান সম্রাট, দিলরুবা দোয়েল, ভাবনা ও ইলোরা গওহরের কথা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
তবে ছবিটি দেখতে দেখতে কিছু প্রশ্ন মনে জাগে, যেহেতু ১৯৭১-এর যুদ্ধ নানাদিক থেকে দেখার হৃদয়বিদারক সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য দুটোই হয়েছিল। প্রথমত, আগস্ট মাস পর্যন্ত কোনো হিন্দু পরিবার অবাঙালি অধ্যুষিত কোনো শহরে এভাবে সপরিবারে বাস করা এটা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় না। তারপর কোনো হিন্দু যুবকের পক্ষে দূরবর্তী বা নিকটবর্তী কোনো শহরে এসময় চাকুরি করা এবং স্ত্রীকে দেখতে আসা এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। কোনো হিন্দু সদ্য বিধবার সিঁথির সিঁদুর বাড়িতে মোছা হয় না। তাছাড়া মা কখনো মেয়ের সিঁদুর মুছতে পারেন না। এটা শ্মশানে কোনো বিধবা রমণীকে দিয়ে করাতে হয়। এক্ষেত্রে যেহেতু এটা সম্ভব নয়, তাই দৃশ্যটা না দেখালে ক্ষতি ছিল না, কারণ পরের দৃশ্যে নদীতে লাশ ভাসার সংলাপটি আমরা শুনতে পাই। পুরো আগস্ট মাসে ভরা বরষায় মেঘ বা বৃষ্টির দেখা নেই, অথচ নভেম্বরে তুমুল বৃষ্টি-এটা মানতে একটু কষ্ট হয়। ১৯৭১ সালের বরষায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়েছিল। এ-নিয়ে অনেক গল্পও লেখা হয়েছে। কয়েকটি ছবিতেও এর দৃশ্যায়ন লক্ষণীয়। ছবিতে দু’বার দুটি বাড়িতে দু’টি ছবির পোস্টার দেখতে পাওয়া যায়। জীবন থেকে নেয়া ও চকোরী। চকোরীর পোস্টারটি ঐ বাড়ির পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে গেলেও জীবন থেকে নেয়ার পোস্টারটি আরোপিত মনে হয়েছে এস্টাবলিশমেন্টের অভাবে। ঐ বাড়ির যুবকটিকে সচেতন মনে হলেও সেটা তেমন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। দুয়েকটা সংলাপের প্রয়োজন অনুভূত হয় এক্ষেত্রে। সময় বোঝানোর জন্যেও পোস্টার দুটির প্রয়োজন নেই।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অনেক ঘটনা আজও অজানা রয়ে গেছে। তেমনি একটি অধ্যায় সৈয়দপুর বিমান বন্দরের রানওয়ে নির্মাণ পর্ব। ব্রিটিশ আমলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ বিমান বাহিনী এই বিমানপোতটি নির্মাণ করে। যুদ্ধশেষে এটি পরিত্যক্ত হয়। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বিমানপোতটি পুনর্ব্যবহারের উদ্যোগ নেয় উত্তরবঙ্গে সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহের সুবিধার্থে। সৈয়দপুরের নিরীহ বাঙালিদের অমানুষিক পরিশ্রমের মাধ্যমে তারা বিমানপোতের রানওয়ে পুনর্নির্মাণ করার পর তাদের হত্যা করে। কেবল তাই নয় এই বিমানপোতের মাধ্যমে তারা যেসব সামরিক সরঞ্জাম সেখানে নিয়ে যায় তা উত্তরবঙ্গের গণহত্যায় ব্যবহৃত হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর এই বিমানপোতটিকে বিমান বন্দরে রূপান্তর করা হয়, যেটি আজ উত্তরবঙ্গের প্রধান বিমান বন্দর। বাংলাদেশের এই গুরুত্বপূর্ণ বিমানবন্দরটি সে সময়ের অসহায় বাঙালিদের নিরন্ন পরিশ্রমের ফসল যার জন্যে তারা শাহাদাত বরণ করেছিলেন।
অজানা এই অধ্যায় লাল মোরগের ঝুঁটি চলচ্চিত্রের ভরকেন্দ্র, যাকে কেন্দ্র করে এ-ছবির কাহিনীরেখা পরিচালকের নিজের ভাবনায় বিভিন্ন শাখায় মর্মস্পর্শীভাবে পল্লবিত। নুরুল আলম আতিককে সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ তিনি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই কাজটি করেছেন শিল্পী ও শিল্পের দায়বদ্ধতা থেকে পরম নিষ্ঠায়। জানিয়েছেন আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের অজানা এই অধ্যায়কে যার সন্ধান তিনি পান বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফের কাছে। ছবির প্রযোজক মাতিয়াবানু শুকু, যিনি নিজেও একজন সফল নাট্যনির্মাতা, সুন্দর এই উদ্যোগে অংশীদার হওয়ার জন্য তাকে অভিনন্দন। ধন্যবাদ বাংলাদেশ সরকারকে যথাযথ ক্ষেত্রে অনুদান প্রদানের মাধ্যমে শৈল্পিক সহযোগিতার জন্য।
অজানা এই অধ্যায় লাল মোরগের ঝুঁটি চলচ্চিত্রের ভরকেন্দ্র, যাকে কেন্দ্র করে এ-ছবির কাহিনীরেখা পরিচালকের নিজের ভাবনায় বিভিন্ন শাখায় মর্মস্পর্শীভাবে পল্লবিত। নুরুল আলম আতিককে সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ তিনি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই কাজটি করেছেন শিল্পী ও শিল্পের দায়বদ্ধতা থেকে
পরম নিষ্ঠায়।