লাভ বা ক্ষতি কতটুকু!

শিশুর হাতে মোবাইল ফোন :

ডা: মাহমুদ এ চৌধুরী আরজু | বৃহস্পতিবার , ৩ জুলাই, ২০২৫ at ৫:১৮ পূর্বাহ্ণ

কানাডার টরেন্টো শহরে এক বাঙ্গালী পাড়া খ্যাত স্কারপোরোতে একদিন বিকালে পার্কে হাঁটার সময় এক বাঙ্গালী সিলেটি যুবকের সাথে পরিচিত হই। সাথে তার ২ বছরের ছেলে। ছেলেটি Pram -এ (বাচ্চাদের গাড়িতে) বসে আছে। তাকিয়ে দেখলাম মনোযোগ সহকারে মোবাইল দেখছে। আমি যুবককে বললাম “বাচ্চাকে এই বয়সে মোবাইল দিয়েছো কেন?” উত্তরে সে বলল “মোবাইল না দিলে বিরক্ত করে, মোবাইল দেখিয়ে খাওয়াতে হয়”। মা-বাবা ডাকে কিনা জিজ্ঞাসা করলে, সে হতাশার সুরে বলে “সে কোন কথা বলে না, শুধু শব্দ করে”। এটাকে ইংরেজীতে বলে “ Sounds more than words ”.

দুঃখ পেলাম, বর্তমানে কানাডায় বাংলাদেশ থেকে বহুলোক পরিবার নিয়ে চলে এসেছে, কিন্তু এখানে এসে মানবেতর জীবন যাপন করছে। চাকুরী নেই, আবাসনের সমস্যা। শিশুদের মোবাইল দেখিয়ে খাওয়ানো বা নানা রকম গেইমস দেখিয়ে বশে আনিয়ে খাবার খাওয়ানো যেন বাংলাদেশী মায়েদের একটি অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই চিত্র বাংলাদেশের সকল পরিবারের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। আমি বিগত ৩০ বছর যাবত চট্টগ্রামে প্র্যাকটিস করছি। এখানকার বেশীরভাগ পুরুষ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কাজ করছেন। তারা ওখান থেকে নামী-দামী ব্রান্ডের মোবাইল পাঠায় আর মা একা থাকে বলে বাড়ির নানাবিধ কাজের জন্য ছেলে মেয়েকে মোবাইল দেখিয়ে সংসারের কাজ করতে থাকে।

এবার মোবাইল ব্যবহারের সম্পর্কে কিছু লিখছি। ইংরেজীতে এটাকে Screen time বলে। এক বাক্যে এর অর্থ হচ্ছে- শিশুরা দিনের কতটা সময় ধরে মোবাইল, স্মার্ট ফোন, ট্যাব, কম্পিউটার বা টেলিভিশন দেখে। গবেষণায় দেখা গেছে যে, শিশুরা দিনের প্রায় ৭-৮ ঘন্টা বিনোদনের জন্য মোবাইল দেখে। মোবাইল ব্যবহার কয়েক ধরনের হয়ে থাকে। যেমন-

১। চধংংরাব (নিস্ক্রীয়ভাবে): যখন শিশুরা শুধু মোবাইল দেখে কিন্তু কোন রকম মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখায় না।

২। অপঃরাব (সক্রিয়): যখন শিশুরা কোন শিক্ষণীয় এ্যাপস ব্যবহার করে বা কোন সৃজনশীল কর্মকান্ডে নিজেকে ব্যস্ত রাখে।

৩। ওহঃবৎধপঃরাব (পারস্পরিকভাবে সক্রিয়): এক্ষেত্রে ফোন ভিডিও কল বা পড়াশুনা আদান প্রদান করা, যেটা করোনাকালীন সময়ে স্কুল-কলেজ গুলোতে এভাবে ক্লাস পরিচালিত হত।

মোবাইল ব্যবহারের ক্ষেত্রে ইন্ডিয়ান একাডেমি অব পেডিয়েট্রিক এর পরামর্শ মত ২ বছর বয়স পর্যন্ত কোন শিশুকে মোবাইল বা অন্যান্য ডিভাইস দেওয়া যাবেনা। ২-৫ বছর পর্যন্ত কেবল মাত্র ১ ঘন্টা সময় মা-বাবা ও গৃহপরিচালিকার তত্ত্বাবধানে মোবাইল দেওয়া যেতে পারে। ৫ বছরের অধিক শিশুদের তাও সীমিত সময়ের জন্য মোবাইল ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া যেতে পারে। যাতে করে শিশুর শারীরিক কার্যক্রম, ঘুম এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় অভ্যাসে ব্যাঘাত না ঘটে। যেমন কোন কোন শিশু ঘুম থেকে উঠেই দাঁত ব্রাশ না করে, নাস্তা না করে মোবাইল দেখা শুরু করে। এটা অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।

মাত্রাতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারে কি সমস্যা হতে পারে-

প্রথমত- শারিরীক সমস্যা: মোবাইল ব্যবহারের কারণে শিশুর কায়িক পরিশ্রম কমে যায়, কেবল বসে থাকে এতে ওজন বেড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। অতিরিক্ত মোবাইল দেখার কারণে চোখের সমস্যা দেখা দিতে পারে। মোবাইল ফোন থেকে নীল রশ্মি বের হয় যা ঘুমের সমস্যা করে। এছাড়া দীর্ঘক্ষণ ধরে একই অবস্থায় বসে থাকে বলে ঘাঁড়, কাঁধ ও মেরুদন্ডে ব্যথা হতে পারে।

দ্বিতীয়ত- আচরণগত ও বুদ্ধিমত্তার ঘাটতি হয়। কথা বলার সমস্যা হয়। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, দীর্ঘক্ষণ ধরে মোবাইল ব্যবহার করা শিশুদের মধ্যে অটিজম হওয়ার সম্ভাবনা ২০ ভাগ বেশি। এছাড়া শিশুর সামাজিকতা লোপ পায়। একা একা থাকতে পছন্দ করে।

তৃতীয়ত- মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা: এ সমস্ত শিশুর মানসিক অস্থিরতা বা উদ্বেগ বেড়ে যায়। অনেক সময় বিষণ্নতায় ভুগে। এছাড়া উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়ের মধ্যে অত্যাধিক মোবাইল ব্যবহারের ফলে যৌন উত্তেজক ছবি দেখে এবং নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মে জড়িয়ে পড়ে। অবশ্য মোবাইল ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তাও আছে। যদি এটা শিক্ষণীয় উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করা যায়। নির্ধারিত এ্যাপস দক্ষতা উন্নয়নের সহায়ক হতে পারে। ভিডিও কলের মাধ্যমে পরিবারের যোগাযোগ রক্ষা করা যায় এবং সামাজিক বন্ধন আরো দৃঢ় হয়। বিশেষ করে বাংলাদেশের অনেক বাবা বিদেশে কর্মরত আছেন। তবে একটি সুনির্দিষ্ট সীমার মধ্যে শিক্ষা ও সৃজনশীল কর্মক্ষেত্রে এ মোবাইল যেন যথাযথ ব্যবহার হয়।

এছাড়া শিশুদের কিছু আচরণগত সমস্যা হলেও মা-বাবা তাদেরকে মোবাইল দিয়ে শান্ত রাখতে চায়। অটিষ্টিক শিশুরা কথা বলতে পারে না, সামাজিক নয়। একা থাকতে ভালোবাসে কিংবা মায়ের আচলের সাথে সবসময় লেগে থাকে। এতে করে মাকে কোন কাজ করতে দেয় না। তাই মা বাধ্য হয়ে মোবাইল দিয়ে তাকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করে। ফলশ্রুতিতে সে মোবাইলে আসক্ত হয়। অটিজমের নানা উপসর্গগুলো আরও প্রকট হয়। একজন অতিচঞ্চল শিশুকে বশে আনার জন্য মোবাইল দেয়া হলে সে ঐ মোবাইলে নানা এ্যাপস ব্যবহার করে নানাবিধ গেইমসের মাধ্যমে অসামাজিক দৃশ্য দেখতে পাবে। এক্ষেত্রে এসব শিশুর জন্য অকুপেশনাল থেরাপির প্রয়োজন। তাকে মোবাইল ব্যবহারের পরিবর্তে দীর্ঘক্ষণ মেয়াদি উৎসাহ ব্যাঞ্জক কাজে নিয়োজিত রাখতে হবে। এক কথায় বলা যায় অটিজম শিশুর জন্য মোবাইল ব্যবহার এক রকম “হারাম”। তাকে বিভিন্ন ধরনের থেরাপির মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে সুস্থ করতে হবে। প্রয়োজনে স্বল্প মাত্রায় ঔষধ দেয়া যেতে পারে।

অতএব শিশুদের মোবাইল দেয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। একটি সুন্দর উৎফুল্ল শিশুর জন্য দরকার সুস্থ, অফুরন্ত, আনন্দঘন পরিবেশ। যেখানে সবাই হাসিমুখে থাকবে। সুষম খাদ্য খাবে। জাঙ্ক ফুডে আসক্ত হবে না। সাথীদের নিয়ে খেলা করবে। গান বা কবিতার রাইমস পড়বে। এ শিশুদের মাঝে আগামী বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে। এজন্য পরিবারের মা-বাবা, ভাই-বোন, স্কুল-মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষিকা, সমাজ সচেতন জনসাধারণকে একসাথে আওয়াজ তুলতে হবে যে “শিশুদের মোবাইল দেয়া নিরাপদ নয়”। প্রয়োজনে সভা, সেমিনার বা পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে এ স্লোগানকে বহুলভাবে প্রচার করতে হবে। তাহলে আগামীর বাংলাদেশ সার্থক হবে।

লেখক : পরিচালক, অটিজম ও শিশু বিকাশ কেন্দ্র, চট্টগ্রাম মা শিশু ও জেনারেল হাসপাতাল।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনাসিম আলী খান : গানে, সুরে নিবিষ্ট এক সংগীতশিল্পী
পরবর্তী নিবন্ধ৩২ চলচ্চিত্র পাচ্ছে ৯ কোটি টাকা সরকারি অনুদান