অবশেষে হয়ে গেল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন! গত বছর মার্চ শেষ সপ্তাহের নির্বাচন ভয়াল কভিড-১৯ ছোবল ঝুলিয়ে দেয়। হবে কী হবে না, কভিড-১৯ হামলা কতদিন থাকবে, এনিয়ে শুরু হয় প্রচুর জল্পনা কল্পনা, গুঞ্জন। অস্বস্তিতে পড়ে প্রার্থীরা। সদ্য সাবেক মেয়র আ জ ম নাছিরের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে গুন্জন, গুজব আরো বেশি ডালপালা ছড়ায়। শেষ মুহূর্তে ভাগ্য খুলে যায়, নগর আওয়ামী লীগ নেতা খোরশেদ আলম সুজনের। নিয়োগ পান ৬ মাসের নগর প্রশাসক হিসাবে। তাঁর ৬ মাসের মেয়াদ শেষ হয়েছে। পরপরই নব নির্বচিত মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী দায়িত্ব নেবেন। সুজন সাহেবের সাফল্য বা রেজাউল সাহেবের নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে মিডিয়া চর্চা প্রচুর। তাই নাজুক বিষয়টা নিয়ে কোন মন্তব্য নেই। হবে, উপযুক্ত সময়ে। আমার বিষয় পুরোই অন্য ঘরানার।
অনেকে হয়তো ভুলে গেছেন। তবুও বিষয়টা চর্চা ও আলোচনা জরুরি। জানেন নিশ্চয়ই, ‘গ্লোবাল নলেজ ইনডেঙ (জিকেআই)’ এর সূচকে জ্ঞান-মনীষা-মেধা চর্চায় বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশগুলোর তলায়! এমনকী নেপাল, ভুটানও আমাদের অনেক উপরে। গত বছর ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সূচকটি প্রকাশিত হয়। সূচকে শীর্ষস্থানে আছে ইউরোপের একমাত্র শান্তির দেশ সুইজারল্যান্ড।
এই সূচক বাংলাদেশের বিভিন্ন মিডিয়ায় ফলাও করে প্রকাশও হয়। কিন্তু প্রতিক্রিয়া খুবই কম হয়েছে। এমনকী এমন লজ্জাজনক অবনমন ভুলে যেতেও দেরি হয়নি। মজার ব্যাপার, সূচকের নমুনা জরিপ কতটুকু প্রামাণ্য এবং বিশ্বাসযোগ্য এ নিয়েও কেউ প্রশ্নও তোলেনি। প্রতিষ্ঠান এমনকী সরকারি বা বিরোধী দলও চুপ! কিন্তু বাংলাদেশ নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইতি বা নেতিবাচক কোন জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ হলে কিছু সংস্থা, সরকারি ও বিরোধী দল বাজপাখির মত ঝাপিয়ে পড়ে। পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল বাদ প্রতিবাদ হয়। অসংখ্য টিভি চ্যানেল টক’শো নামের শব্দবাজিতে কান ঝালাপালা করে দেয় বেশ কিছুদিন। কিন্তু এতবড় অপমানটি চুপচাপ সবাই হজম করে ফেলেন কী করে! এতে পরিস্কার সূচকটি মোটামুটি নিখুঁত। না হলে সবাই চুপ থাকে কোন আক্কেলে?
বাংলাদেশে গাধা নেই, থাকলেও চিড়িয়াখানায়। এখন কী ধরে নেব, দেশে চারপেয়ে গাধা না থাকলেও ঘরে ঘরে দ্বিপদী গাধার ভয়ঙ্কর বংশ বিস্তার চলছে? স্বাভাবিক নিয়মে নিজেও এই গোত্রের একজন। এখন চলছে, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের মাসব্যাপী আয়োজন। সরকারি, বেসরকারি দুপর্যায়েই। গণমাধ্যমের পাশাপাশি অন্তর্জাল জুড়েও ভাষার গুণগান, বিশাল মাতম! বইমেলা, গ্রন্থমেলা, উৎসব আরও কতো কী! যদিও করোনার ঠেলা-ধাক্কায় অনেক নির্ধারিত সূচি মার্চে পিছু হঠেছে। তো, ধরে নেব কী, বার্ষিক মিলাদ, ওরশ, ধর্মীয় বা নানা দিবসের মত মাতৃভাষা দিবসও মাসব্যাপী রুটিন মাতম কেবল! মেয়াদ শেষে গুটিয়ে যাবে রুটিন। অবশ্য এসব রুটিন সূচির গায়ে জড়িয়ে থাকে বিশাল বেনিয়া স্বার্থ!
সূচকটা কী রাজনীতি দূষণের বিষ ফল, নাকি বুদ্ধিবৃত্তিক দীনতার মোটা দাগের শব ব্যবচ্ছেদ? মন্তব্য করার যোগ্যতা নেই। সত্যি সত্যি কী মেধা, মনন, বুদ্ধিবৃত্তি, জ্ঞান চর্চায় আমরা ভূটান নেপাল, পাকিস্তান থেকেও পিছিয়ে আছি! যদি এমন হয়, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ বা বাংলা ভাষার মর্যাদার সুরক্ষা দেয়া কীভাবে সম্ভব? কখনোই সম্ভব না। বাস্তবে হচ্ছেও তাই। “যেমনে পার চামচা হও, ভাঁড়-বাটপার হও, জ্ঞান মনন থেকে যত পার দূরে সরে থাক”! এটাই বোধহয় আমাদের চর্চিত নীতি!
মানলাম, মেধাহীন ফাঁপা রাজনীতি লোভ আর ভোগ আবর্জনার চাষ দিচ্ছে, তাই একপাশে সরিয়ে রাখছি। কিন্তু সুশীল বলয়েতো অসংখ্য গুণীর বিচরণ। তাঁরা অনেকে দেশ-বিদেশের বিদ্যার বিশাল সনদ, বড় পদ, পদবী, পদক, খেতাবধারীও বটে। কিন্তু সুবচন সুনামির ঝড়ো বাতাস ছাড়া তাঁরা জাতিকে কী দিচ্ছেন, নিয়ে যাচ্ছেনইবা কোথায়? শব্দের ঝড়ো হাওয়ায় তো সুবোধ উড়েই যাচ্ছে। প্রথমে তার পোশাক গেছে, এখন আব্রুও শেষ! আমাদের বোধের জানালা আর খুলবে কবে? টানা লোভ, ভোগের রসদ যোগাতে দলীয় লেজুড়বৃত্তির আঁটায় আর কতোদিন আটকে থাকবে সুশীলরা! নাকি উচ্চ ফলনশীল দ্বিপদী গাধার ফলন বাড়ানোই হচ্ছে, আমাদের জাতীয় অগ্রাধিকার?
চট্টগ্রামের মত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ইতিহাস, কৃষ্টির পবিত্র ভূমি যেন এভাবে মেধা, জ্ঞান, মনন, প্রজ্ঞার ক্ষয়রোগে খাবি না খায়, নতুন সিটি মেয়র গুরুত্ব দিয়ে তা বিবেচনায় নেবেন বলে আশা করতেই পারি।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট