লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের বিরোধ আরো বেড়েছে

বিডব্লিউটিসিসির নির্বাহী পরিচালককে অপসারণ করে রুমে তালা দিল এক পক্ষ হুমকির মুখে পণ্য হ্যান্ডলিংসহ দেশব্যাপী সরবরাহ নেটওয়ার্ক

হাসান আকবর | রবিবার , ২৩ নভেম্বর, ২০২৫ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ রুটে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত লাইটারেজ জাহাজ মালিকদের বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। সংস্থার কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের জের ধরে এই বিরোধ আরো বেড়েছে। যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেলের (বিডব্লিউটিসিসি) কার্যক্রমে। জাহাজ মালিকদের এক পক্ষ সংস্থার নির্বাহী পরিচালককে অপসারণ করে রুমে তালা লাগিয়ে দিয়েছে। ওই নির্বাহী পরিচালক বিডব্লিউটিসিসিকে ব্যবহার করে কয়েকজন জাহাজ মালিকের দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করে দিলে তিনি তোপের মুখে পড়েন।

অপরদিকে জাহাজ মালিকদের একটি অংশ বিডব্লিউটিসিসির নতুন আহ্বায়ক নির্বাচিত করে ঢিমেতালে কার্যক্রম অব্যাহত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছেন। সবকিছু মিলে জাহাজ মালিকদের বিরোধে আমদানি বাণিজ্যের প্রবেশদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য হ্যান্ডলিংসহ দেশব্যাপী সরবরাহ নেটওয়ার্কে হুমকির মুখে ফেলছে বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন।

জানা যায়, বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমদানিকৃত বছরে ১০ কোটি টনের বেশি পণ্য হ্যান্ডলিং হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। এর মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্যসহ অন্তত ৫ কোটি টন পণ্য হ্যান্ডলিং করা হয় বহির্নোঙরে। বিশ্বের নানা দেশ থেকে লাখ লাখ টন পণ্য নিয়ে আসা বড় বড় মাদার ভ্যাসেলগুলো বন্দরের জেটিতে ভিড়তে পারে না। এসব বড় জাহাজ থেকে পণ্যগুলো বহির্নোঙরে লাইটারেজ জাহাজে খালাস করা হয়। মাদার ভ্যাসেলের ক্রেনের সাথে গ্র্যাভ ব্যবহার করে লাখ লাখ টন পণ্য নামানো হয় লাইটারেজ জাহাজে। একেকটি মাদার ভ্যাসেলে একসাথে তিনচারটি লাইটারেজ জাহাজে পণ্য খালাস করার সুবিধা থাকে। মাদার ভ্যাসেল থেকে নামানো পণ্য কর্ণফুলী নদীর ষোলটি ঘাটের পাশাপাশি দেশের ৩০টির বেশি গন্তব্যে প্রেরণ করা হয়। এর বাইরে চট্টগ্রাম থেকেও দেশের নানা গন্তব্যে লাখ লাখ টন পণ্য পরিবাহিত হয়। অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন সেক্টরের নির্দিষ্ট রুট অনুসরণ করে লাইটারেজ জাহাজগুলো পণ্য পরিবহন করে। অভ্যন্তরীণ পণ্য সরবরাহ নেটওয়ার্ক প্রায় পুরোপুরি এই সেক্টরের ওপর নির্ভরশীল। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত লাইটারেজ জাহাজগুলোর সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করে বিডব্লিউটিসিসি।

কিন্তু নানা বিরোধে এই সেক্টরে বিশৃঙ্খল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের জাহাজ মালিকদের বিরোধ, দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া পাওয়া পরিশোধ না করা, মেয়াদ শেষে জোরপূর্বক চেয়ার দখল করে রাখা, চুক্তি ও নীতিমালার তোয়াক্কা না করে শত শত জাহাজ বিভিন্ন ফ্যাক্টরিকে ভাড়া দিয়ে রাখা, কোটি কোটি টাকা আত্মসাতসহ নানা কারণে স্থবিরতার মুখে পড়েছে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন খাত।

নৌবাণিজ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশনাও উপেক্ষিত হচ্ছে। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে দফায় দফায় বৈঠক এবং নানাভাবে উদ্যোগ নিয়ে একটি বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছিল। ‘নৌপরিবহন অধিদপ্তর হইতে অনুমতিপ্রাপ্ত লাইটার জাহাজের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরসমূহে পণ্য পরিবহন নীতিমালা২০২৪’ শীর্ষক নীতিমালা প্রণয়ন করে সরকার প্রজ্ঞাপনও জারি করে।

উক্ত নীতিমালায় বিডব্লিউটিসিসির আওতায় থেকে লাইটারেজ জাহাজসমূহ কিভাবে পরিচালিত হবে তা নিয়ে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরসমূহ ও তৎসংলগ্ন এলাকা হতে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে স্বচ্ছ প্রক্রিয়া, নির্বিঘ্ন ও সুশৃঙ্খলভাবে পণ্য পরিবহন করার স্বার্থে সরকার এই নীতিমালা প্রণয়ন করল। লাইটার জাহাজগুলোকে সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার মাধ্যমে লাইটার জাহাজ শিল্প এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের একটি সমন্বিত নীতিমালার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করে লাইটার জাহাজ দ্বারা পণ্য পরিবহন সম্পর্কিত যেকোনো বিষয়ে সকল অংশীজনের স্বার্থ রক্ষা করার স্বার্থেই নীতিমালাটি প্রণয়ন করা হয় উল্লেখ করে বলা হয়, সুষম ও স্বচ্ছ ক্ষেত্র প্রস্তুতপূর্বক জবাবদিহিমূলকভাবে লাইটার জাহাজ পরিচালনার পাশাপাশি স্বল্পতম সময়ে লাইটার জাহাজ বরাদ্দের মাধ্যমে বাংলাদেশের জলসীমায় আগত মাদার ভ্যাসেল থেকে দ্রুত পণ্য খালাসের মাধ্যমে দেশের সমুদ্র বন্দরসমূহের সুনাম অক্ষুণ্ন রেখে জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখা এবং খাদ্যপণ্য, সিমেন্ট ক্লিংকার, সারসহ সকল আমদানিরপ্তানি পণ্য যথাসময়ে সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানোর মাধ্যমে সুষম সরবরাহে সহায়তা করতে দেশের সকল সমুদ্র বন্দর, সমুদ্র উপকূলীয় নদী বন্দর ও নদীর উভয় তীরে অবস্থিত সকল প্রকার জেটি, বহির্নোঙরে আগত মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য পরিবহন কাজে নিয়োজিত লাইটার জাহাজের ক্ষেত্রে এই নীতিমালা প্রযোজ্য হবে।

কিন্তু নীতিমালা বাস্তবায়ন হয়নি। লাইটারেজ জাহাজ সেক্টরে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। বিডব্লিউটিসিসিতে ঢাকার দুটি এবং চট্টগ্রামের একটি সংগঠন থাকলেও কার্যত ঢাকার সংগঠনগুলোর সাথে চট্টগ্রামের সংগঠনটির যোগাযোগ নেই। বিডব্লিউটিসিসিতে কনভেনর হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী আবু সাঈদ ৩০ জুন পর্যন্ত দায়িত্বে থাকার কথা। এই ব্যাপারে চুক্তিপত্রও হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে মেয়াদ শেষ হলেও তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় অচলাবস্থা প্রকট হয়। এর মাধে বিডব্লিউটিসিসির নির্বাহী পরিচালক মেজর (অব.) জিএম খান বেশ কয়েকজন নেতার কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করে দেন। এতে জাহাজ মালিকদের মাঝে হতাশার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে জাহাজ মালিকদের একটি বড় অংশ নিজেরা সভা করে আবু সাঈদের স্থলে আইভোয়াকের প্রেসিডেন্ট হাজী শফিক আহমেদকে বিডব্লিউটিসিসির কনভেনর নির্বাচিত করে দায়িত্ব দেন। কিন্তু জাহাজ মালিকদের বিরোধের কারণে সংস্থার কার্যক্রমে গতি আসেনি।

জাহাজ মালিকদের এই বিরোধের মাঝে সাবেক কনভেনর আবু সাঈদকে বাদ দিয়ে হাজী শফিক আহমেদকে কনভেনর করার কয়েকদিন পর আবু সাঈদ চিঠি দিয়ে নির্বাহী পরিচালক জিএম খানকে চাকরি থেকে অপসারণ করেন। বিডব্লিউটিসিসি কার্যালয়ে তার কক্ষে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এদিকে জিএম খান এক চিঠিতে আবু সাঈদের এই ধরনের অপসারণের ক্ষমতা নেই বলে লিখিতভাবে জানিয়ে দেন।

সবকিছু মিলে বিশৃঙ্খলায় পড়েছে অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন খাত। সরকারের পক্ষ থেকে জরুরিভাবে পদক্ষেপ না নিলে এই বিরোধ দেশের পণ্য সরবরাহ নেটওয়ার্কে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন।

বিডব্লিউটিসিসির কনভেনর হাজী শফিক আহমেদ গতকাল আজাদীকে জানান, চুক্তি অনুযায়ী জাহাজ মালিকেরা আমাকে কনভেনরের দায়িত্ব দিয়েছেন। সংস্থার কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে। আমি এখন এসব দুর্নীতি রোধের পাশাপাশি জাহাজ মালিকদের স্বার্থ রক্ষায় কাজ শুরু করেছি। বেশ কিছু সমস্যা আছে। আমরা সবাই মিলে ক্রমান্বয়ে এসব সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছি।

সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মেজর (অব.) জিএম খান আজাদীকে বলেন, আমাকে অপসারণের একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু যখন তিনি চিঠিতে স্বাক্ষর করেছেন তার অন্তত দুদিন আগে নতুন কনভেনর দায়িত্ব নিয়েছেন। সুতরাং আমাকে অপসারণ করার চিঠিটি গুরুত্বহীন। এটি আমি আবু সাঈদ সাহেবকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি। গুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরটিকে দুর্নীতিমুক্ত করলে শুধু জাহাজ মালিক বা আমদানিকারক নন, দেশের সাধারণ মানুষও উপকৃত হবেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশাহ আমানতে ৭ লাখ টাকার সিগারেট ও আমদানি নিষিদ্ধ ক্রিম জব্দ
পরবর্তী নিবন্ধকারাগারে মন্ত্রীরা আমার কাছে যেতেন : বাবর