লর্ডসকে বলা হয় ক্রিকেটের মক্কা। আর আমার মতো যারা ক্রিকেট পাগল তাদের জন্য লর্ডস ভ্রমণের সুযোগতো স্বপ্ন ছোঁয়ার মতো। তাই এবার লন্ডন সফরে এসে প্রথম সুযোগে লর্ডস ক্রিকেট মাঠ দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলাম আমার বড় ছেলের কাছে। পিতার আবদার কি ফেলে দেয়া যায়? সাথে সাথে অনলাইনে লর্ডস পরিদর্শনের টিকেট কিনে ফেললো। ২০ জুলাই, ২০২৫ তারিখে সকাল–সকাল রেইনহাম বাসা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। আমি আর আমার ছেলে সাজিদ। ছোটবেলা থেকে টিভিতে যে মাঠের খেলা দেখে মুগ্ধ হতাম, তা আজ নিজ চোখে দেখতে পাবো এ ভাবনায় মন হয়ে উঠলো উৎফুল্ল।
লর্ডস স্টেডিয়ামটি লন্ডনের ওয়ালিংটনের সেন্ট জনস উড এলাকায়। টিউব ট্রেনের ডিস্ট্রিক ও জুবিলি লাইন ধরে সেন্ট জনস উড স্টেশন পর্যন্ত গিয়ে হেঁটে পৌঁছে যাই লর্ডসে। এছাড়া অন্যান্য জায়গা থেকেও জুবিলি, বার্কলো ও মেট্রোপলিটন লাইনে বেকার স্ট্রিট স্টেশন ও ওয়ারউইক এভিনিউ স্টেশন হয়ে এবং অনেকগুলো বাস রুটে এখানে আসা যায়। তবে সবচেয়ে কাছের স্টেশন হচ্ছে সেন্ট জনস্ উড। স্টেশন থেকে মিনিট সাতেক হেঁটে নর্থ গেইটে পৌঁছে গেলাম। সেখানে উপস্থিত একজনকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন আমাদের গ্রেস গেইটে যেতে হবে। এটি লর্ডস মাঠের প্রধান প্রবেশ পথ। ইংল্যান্ডের কিংবদন্তি ক্রিকেটার ডব্লিউ জি গ্রেসের নামে এই গেইটের নামকরণ করা হয়েছে। এখানে রয়েছে তাঁর একটি আইকনিক ব্রোঞ্জ মূর্তি। এটিসহ লর্ডসে প্রবেশের জন্য ৬টি গেইট রয়েছে। এরমধ্যে একটি শুধু এমসিসি সদস্যদের জন্য সংরক্ষিত। লর্ডসের এমসিসি ক্লাবের সদস্য পদ পাওয়া খুবই সম্মানের।
এমসিসির সদস্য পদ প্রাপ্ত হলে কিছু সুবিধা রয়েছে। পূর্ণ সদস্যরা বিনামূল্যে যে কোন ক্রিকেট ম্যাচে অতিথি আনতে পারবেন এবং ক্লাবের সকল ইভেন্ট ও মিটিং এ অংশ নেয়ার সুযোগ পাবেন। বাংলাদেশের কোন সদস্যের নাম গাইড জানাতে না পারলেও ভারত ও পাকিস্তানের অনেক প্রাক্তন ক্রিকেটার এমসিসি ক্লাবের সদস্যপদ নিয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শচীন টেন্ডুলকার, রাহুল দ্রাবিড়, ইনজামামুল হক, শহীদ আফ্রিদি ও ওয়াসিম আকরাম।
নির্ধারিত সময়ের ৫ মিনিট পূর্বে আমরা গ্রেস গেইটে পৌঁছে গেলাম। সেখানে আমাদের অভ্যর্থনা জানানো হলো এবং একটি পরিচয় পত্র গলায় ঝুলিয়ে দেয়ার জন্য দিল। কিছুক্ষণ পর আমাদের গাইড এসে আমাদের ভিতরে নিয়ে গেলো। আমাদের গ্রুপে ছিল প্রায় ২০জন। অধিকাংশই ভারতীয়। প্রথমে আমাদের গন্তব্য লর্ডস মিউজিয়ামে। বর্তমান লর্ডস স্টেডিয়াম ১৮১৪ সালে থমাস লর্ড প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমান অবস্থান হচ্ছে লর্ডসের তৃতীয় সংস্করণ। ১৭৮৭ সালে ডরমেট স্কয়ারে এটি প্রথম তৈরী করা হয়। ২৩ বছর এখানে থাকার পর মাঠের মালিক ভাড়া বৃদ্ধি করতে থাকেন এবং তিনি মাঠটি নিজের জন্য ব্যবহার করতে চান। ফলে থমাস লর্ড নতুন জমি খুঁজতে থাকেন এবং ১৮১১ সালে রিজেন্টস পার্কের দক্ষিণে মিডলসেক্স পার্কে নতুন করে স্টেডিয়াম স্থাপন করেন। কিন্তু বৃটিশ সরকার মাঠের ভিতর দিয়ে রিজেন্টস খাল তৈরী করার পরিকল্পনা নেয় এবং মাঠের মাঝখান দিয়ে খাল কাটা হয়। ফলে খেলার অনুপযুক্ত হওয়ায় মাত্র তিন বছর পর বর্তমান সেন্ট জনস উডে ১৮১৪ সালে নতুন করে এই স্টেডিয়াম তৈরী করা হয়। মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাব এখন লর্ডস স্টেডিয়ামের মালিক।
এই মিউজিয়ামে ক্রিকেট ইতিহাসের অনেক মূল্যবান সামগ্রী সংরক্ষিত রয়েছে। প্রথমে দেখলাম আসল এ্যাসেজ পাত্র। যা সিরামিকের ছোট একট বয়ম। টেরাকোটা দিয়ে ছোট একটি মূর্তি। বলা হলো এরমধ্যে আছে কাঠের বেইল পোড়ানো ছাই। এসময় গাইড এখানে এ্যাসেজ সিরিজের মজার ইতিহাস জানিয়ে বললেন ১৯৮২ সালে ইংল্যান্ডের মাঠিতে ওভাল স্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়া প্রথমবার ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ডকে হারায়। ক্রিকেটের জনক ইংল্যান্ডের জন্য এটি ছিল বিশাল অপমানের। সেই পরাজয়ের পর ইংল্যান্ডের ‘দি স্পোটিংস টাইম’ পত্রিকা মজা করে লিখলো ইংরেজ ক্রিকেটের মৃত্যু হয়েছে। তার দেহ দাহ করে ছাই অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর এই রসিকতা থেকে দি এ্যাসেজ শব্দের উৎপত্তি। এই ট্রফি কখনো সিরিজ জয়ের আনুষ্ঠানিক পুরস্কার ছিল না। আসল এ্যাসেজ সিরিজে দেয়া হয় একটি বড় ট্রফি। মিউজিয়ামে দেখতে পেলাম বিশ্বের সবচেয়ে পুুরোনো ক্রিকেট আর গ্লাভসের সাথে। এছাড়া মিউজিয়ামে আরো উল্লেখযোগ্য হচ্ছে (১) প্রথম পুরুষ ও মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপ। (২) ডন ব্রাডমান, শেন ওয়ার্ন ও ডব্লিউ জি গ্রেসের মতো খ্যাতিমান পুরানো ক্রিকেট ক্রিকেটারদের অনেক স্মরণীয় জার্সি, ব্যাট, বল (৩) ১৯৩৬ সালে ক্রিকেট বলের আঘাতে নিহত চড়ুই পাখির মমি (৪) সৌরভ গাঙ্গুলিসহ অনেক খ্যাতিমান খেলোয়াড়ের পোশাক (৫) পুরানো আমলের স্কোর শিট, (৬) উইজডনসহ বিভিন্ন বইয়ের বিরল সংস্করণ এবং সাম্প্রতিক জসপ্রিত বুমরা ও কে এল রাহুলের খেলাধুলার সরঞ্জাম। দেখতে দেখতে মনে হলো আমি ফিরে গেছি ক্রিকেটের অন্য জগতে।
মিউজিয়াম দেখার পর আমাদের একে একে নিয়ে যাওয়া হলো ঐতিহাসিক প্যাভেলিয়ন, গ্যালারি, ড্রেসিং রুম, মিডিয়া সেন্টারে। স্টেডিয়ামের দুটি ড্রেসিং রুম রয়েছে। একটি সফরকারী দল ও অন্যটি ইংল্যান্ড দলের জন্য। তবে দুটি বিদেশী দলের মধ্যে খেলা হলে ইংল্যান্ড দলের ড্রেসিং রুম যেকোন একটি দলকে ব্যবহারের জন্য দেয়া হয়। বিদেশী দলের ড্রেসিং রুমে রয়েছে বিদেশী দলসমূহের খেলোয়াড়দের ‘অনার বোর্ড’। এই ‘অনার বোডের্’ নাম তোলা ক্রিকেট খেলোয়াড়দের জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক। লর্ডস ‘অনার বোর্ড’ বিশ্ব ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠত্বের চিহ্ন।
লর্ডস মাঠে যারা শতরান করেন কিংবা এক ইনিংসে ৫ উইকেট অথবা দুই ইনিংস মিলে দশ উইকেট লাভ করেন, তাদের নাম অনার বোর্ডে লিপিবদ্ধ করা হয়।
প্লেয়ার লাউঞ্জে বসে নিজেকে অনেক ভাগ্যমান মনে হলো। এখানে কিছুক্ষণ থাকার পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো মাঠের বিভিন্ন গেইট, প্যাভিলিয়ন, গ্যালারী, ড্রেসিং রুম ও মিডিয়া সেন্টারে। ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত প্যাভিলিয়নের যে স্থান থেকে খেলোয়াড়রা মাঠে নামেন ও খেলা দেখেন তা দেখানো হলো।
এরপর গেলাম মিডিয়া সেন্টারে। ১৯৯৯ সালে নির্মিত মিডিয়া সেন্টারটি আধুনিক আর্কিটেচারের নমুনা এটি এলুমিনিয়ামের গঠিত ও দেখতে ভাসমান নৌকার মতো দেখায়। এখানে সাংবাদিকদের ল্যাপটপসহ নানা সুবিধা রয়েছে। তবে আমাদের কমেন্ট্রি বক্সে যাবার সুযোগ দিল না। গ্যালারীতে বসে মাঠের দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হলাম। ভ্রমণের শেষ পর্যায়ে লর্ডসের সবুজ মাঠের দিকে আবার তাকালাম, নিজেকে ভাগ্যবান মনে হলো, নিজ চোখে দেখলাম সেই মাঠ, যে মাঠে কিংবদন্তি ক্রিকেটাররা তাঁদের স্মরণীয় ম্যাচ খেলেছেন। যে মাঠ ক্রিকেট ইতিহাসের জীবন্ত অধ্যায়। ক্রিকেটের প্রতি আমার ভালোবাসা এখানে এসে চূড়ান্ত হলো। মাঠ থেকে বেরিয়ে দোকান থেকে কিছু স্মারক কিনে লর্ডস সফরকে স্মৃতিতে চিরস্মরণীয় করে রাখলাম।
লেখক : ক্রীড়া বিশ্লেষক।