লজ্জাবতী বানর : আবাসবিহীন ‘পরিবেশের বন্ধু’

সমির মল্লিক, খাগড়াছড়ি | শনিবার , ২৪ মে, ২০২৫ at ৬:৪৭ পূর্বাহ্ণ

লজ্জাবতী বানর ক্ষুদ্র বানর প্রজাতির প্রাণী। মন্থরগতিসম্পন্ন হলেও ফুলের পরাগায়ন ও বীজের বিস্তারণে প্রাণীটি গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা ফল যতটা না খায় তার চেয়ে বেশি বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর পোকা খায়। এতে ইকো সিস্টেমের উপকার করে তারা পরিবেশের বন্ধু হয়ে উঠেছে।

এভাবেই প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যেতে বসা লজ্জাবতী বানরের উপকারিতার কথা তুলে ধরেছেন ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার পিএইচডি ফেলো হাসান আল রাজী। একইসঙ্গে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে লজ্জাবতী বানর সংরক্ষণ ও গবেষণায় কাজ করছেন।

এই প্রাণী গবেষক বলেন, ফুলের মধু, গাছের পোকার পাশাপাশি লজ্জাবতী বানর জিকা, বহেরা এ জাতীয় গাছের থকথকে জেলির মতো আঠা খায়। সেসব যদি না পায় তখন তারা খাদ্য সংকটে পড়ে। তাই আমাদের উচিত প্রাকৃতিক বন পুনরুজ্জীবিত করা। তাহলে এ ধরনের বিপন্ন প্রাণীরা খাবার পাবে। লজ্জাবতী বানরকে ইংরেজিতে বেঙ্গল স্লো লরিস বা নর্থান স্লো লরিস বলে। প্রাণিটি চৎরসধঃবং বর্গের অন্তর্গত খড়ৎরফধব গোত্রের সদস্য। এর বৈজ্ঞানিক নাম ঘুপঃরপবনঁং নবহমধষবহংরং। আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ বা আইইউসিএনের লাল তালিকায় লজ্জাবতী বানরকে রাখা হয়েছে ‘বিপন্ন’ ক্যাটাগরিতে। এর মানে হল, এই প্রাণীর প্রজাতি প্রকৃতিতে বিলুপ্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে সামপ্রতিক সময়ে খাগড়াছড়িতে এ প্রজাতির কয়েকটি প্রাণী উদ্ধারের ঘটনা ঘটে। গত ১৩ এপ্রিল খাগড়াছড়িতে সদর উপজেলার গঞ্জপাড়া থেকে লজ্জাবতী বানর উদ্ধার করে বন বিভাগ। খাগড়াছড়ির বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. ফরিদ মিঞা বলেন, গঞ্জপাড়ায় বিদ্যুতের তারে ঝুলন্ত অবস্থায় লজ্জাবতী বানরটি পাওয়া যায়। স্থানীয়রা বন বিভাগকে খবর দিলে খাগড়াছড়ি সদর রেঞ্জের বনকর্মীরা বানরটি উদ্ধার করে রেঞ্জ কার্যালয়ে নিয়ে আসে। দুই দিন ধরে পরিচর্যা করে বানরটিকে স্বাভাবিক অবস্থায় আনার পরে আলুটিলা সংরক্ষিত বনে প্রাণীটি অবমুক্ত করা হয়। ২০ এপ্রিল ভাইবোনছড়া এলাকা থেকে আরেকটি লজ্জাবতী বানর উদ্ধার করা হয়। দ্রুত উদ্ধার পাওয়ায় প্রাণীটির জীবন সুরক্ষিত হয়। পরে সেটিও আলুটিলা সংরক্ষিত বনে অবমুক্ত করা হয়। বন্যপ্রাণী সুরক্ষায় জেলার রামগড়সহ বিভিন্ন উপজেলায় একাধিক সচেতনতামূলক সভা করেছেন বলেও জানান এই বন কর্মকর্তা।

বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ফরিদ মিঞা বলেন, লজ্জাবতী বানরের মাথাসহ দেহ ৩৩ সেমি লম্বা এবং ওজন প্রায় ১ কেজি ২০০ গ্রাম। এ বানরের দেহ হালকা বাদামি থেকে ধূসর রঙের ছোট নরম পশম দ্বারা আবৃত। এদের মাথা গোলাকৃতি, বাদামি রঙের বলয়যুক্ত পেঁচার মতো চোখ, পশমের মধ্যে প্রায় ঢেকে থাকা খাটো লেজ এবং মাথার ওপর থেকে পিঠ পর্যন্ত লম্বা বাদামি দাগ দেখতে পাওয়া যায়।

বেঙ্গল লজ্জাবতী বানর মূলত বাংলাদেশ, ভারত, ভূটান, কম্বোডিয়া, চিন, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনামে পাওয়া যায়। বাংলাদেশে এদের দেখা মেলে পাহাড়ি চিরসবুজ বনে। এরা মূলত নিশাচর প্রাণি; দিনে চলাচল করে না। এ প্রজাতির বানর গাছের উঁচু শাখায় থাকতে পছন্দ করে। তাদের খাদ্যতালিকায় রয়েছে গাছের কচি পাতা, মুকুল, গাছের আঠা, ছোট ছোট পোকামাকড়, সন্ধিপদ প্রাণী, ছোট পাখি এবং বিভিন্ন প্রাণীর ডিম।

খাগড়াছড়ির পরিবেশবাদী সংগঠন পিটাছড়া বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা মাহফুজ রাসেল বলেন, ২০১৭ সাল থেকে আমরা লজ্জাবতী বানর সংরক্ষণের কাজ করছি। এছাড়া জার্মানভিত্তিক একটি সংগঠনের উদ্যোগে লজ্জাবতী বানরের উপর পিটাছড়ায় গবেষণা কার্যক্রম চলছে। তাদের উপযোগী বাস্তুসংস্থান তৈরির চেষ্টা চলছে। আমাদের ১৩ একরের বেশি সংরক্ষিত এলাকায় ৭ থেকে ৮টির মতো লজ্জাবতী বানরের দেখা পাই। আমরা দেখেছি তার পোকার পাশাপাশি তারা ৭৮ প্রজাতির গাছের কষ খায়। এখন বনে সেরকম গাছ বেশি নেই। যেখানে বন ছিল সেখানে হয়তো বসতি হয়ে গেছে।

গবেষক হাসান আল রাজি লজ্জাবতী বানর সংরক্ষণে প্রাকৃতিক বন পুনরুজ্জীবিতকরণের উপর জোর দিয়ে বলেন, “পার্বত্য এলাকায় লজ্জাবতী বানরের বিস্তৃতিতে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। পার্বত্য এলাকায় বনগুলো ছড়ানো ছিটানো কিছুটা বিচ্ছিন্ন। দেখা যাচ্ছে মানবসৃষ্ট কারণে বনগুলো বিভক্ত হয়ে গেছে। ছোট ছোট বনগুলোতে মাঝে মাঝে লজ্জাবতী বানর দেখা যাচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৩ হাজার ২৮০ কিমি সাগর পাড়ি দিয়ে কচ্ছপ গেল শ্রীলঙ্কায়
পরবর্তী নিবন্ধমীরসরাইয়ে চাহিদার বেশি প্রস্তুত কোরবানির পশু