‘দিদি আমি কি খাব’ তোমার এই কথা আজও আমার কানে ভাসে। লক্ষ্মী নামের মেয়েটি আমার বাসায় সারাদিন থাকতো, আমাকে সাংসারিক কাজে সাহায্য করতো। লক্ষ্মী প্রায়ই আসতো না–বলতো দিদি আমার অসুখ ছিল তাই গতকাল আসতে পারিনি। মাস শেষ হবার আগেই টাকা চাইতো, বলতো ‘দিদি আমি কি খাব?’ এরমধ্যেই দেখি ও পরপর কয়েকদিন এলো না–আমি প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকি– আজ বুঝি আসবে–না আজও এলো না! এরমধ্যেই খবর পেলাম – এই কয়েকদিন অসুখে ভোগে লক্ষ্মী মারা গেছে। আজ তার দাহ হবে। কথাটি শোনামাত্র আমার চোখের অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সঠিক সময়ে জানতে পারলে লক্ষ্মী হয়তোবা বেঁচে যেতো। ‘চিকিৎসার অভাবে আমার লক্ষ্মী মারা গেছে।’ নিজকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল। কেন আমি বস্তিতে লোক পাঠালাম না। আমার মন খারাপ দেখে সবাই বলল– ছাদে চলেন তাহলে লক্ষ্মীর দাহ দেখতে পারবেন। কারণ শ্মশানঘাট আমাদের বাসার ছাদে উঠলেই দেখা যায় -কিন্তু আমাদের ছাদে উঠার সিঁড়ি নাই, টেবিল চেয়ারের সাহায্যে আমাকে কষ্ট করে উঠালো। ছাদে উঠে দেখি ধোঁয়ায় পুরো আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে। আমার মনের অবস্থা বুঝে ওরা আমাকে ছাদ থেকে নামিয়ে আনলো। আমি শুধু কাঁদছিলাম আর কানে যেন শুনছিলাম লক্ষ্মীর সেই কন্ঠস্বর –‘দিদি আপনি সাহায্য না করলে আমি কি খাবো।’ চিন্তা করলাম লক্ষ্মীকে আর কোনদিন ফিরে পাবো না কিন্তু আমার ওর জন্য কিছু করার দরকার তখন মনে পড়লো -ও একদিন বলেছিলো দুটি ছেলেমেয়ে আছে তার। আমি লক্ষ্মীর বাড়ীতে লোক পাঠালাম। কিন্তু ওর ঘর চিনতে পারছিলো না ওরা। শেষে অনেক কষ্ট করে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে লক্ষ্মীর বাড়িতে গেলো ওরা এবং আমার পক্ষ থেকে লক্ষ্মীর বাচ্চাদের দাওয়াত দিয়ে আসলো। নির্দিষ্ট দিনে বাচ্চা দু’টি এলো আমার কাছে। আমি সাথে সাথে ওদেরকে আমার কাছে টেনে নিলাম আদর করলাম। বাচ্চাদুটি লক্ষ্মীর মতোই সুন্দর হয়েছে। ফ্যালফ্যাল করে অসহায়ভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিল –আমি মনে মনে ভাবছিলাম বাচ্চাদুটির কি হবে? ওদের বাবাও নেই মাও নেই। আমি ওদেরকে ভালোভাবে আপ্যায়ন করলাম। ওদেরকে নতুন কাপড় উপহার দিলাম। ছেলে-মেয়ের অভিভাবকের হাতে ওদের জন্য কিছু সাহায্য দিলাম। চেয়ে দেখি বাচ্চাদুটির চোখ হতে পানি বেয়ে পড়ছে। পরে আরেকদিন লোক পাঠালাম ছেলে-মেয়ে দুটিকে নিয়ে আসার জন্য কিন্তু ওদেরকে পাওয়া যায়নি। ওরা অন্য কোথাও চলে গেছে। আজও আমি যেন কানে শুনতে পাই-‘দিদি’ বলে লক্ষী আমায় ডাকছে -ফিরে দেখি কেউ নেই। আজ এতবছর পরেও তোমায় আমি ভুলতে পারছি না লক্ষ্মী।