প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের ঊর্ধ্বমুখী সংক্রমণ ঠেকাতে ৫ এপ্রিল ২০২১ সোমবার সকাল ৬টা হতে সারাদেশে ‘লকডাউন’ ঘোষণা করেছে সরকার। সরকার ১১ দফা নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। প্রজ্ঞাপনের নির্দেশগুলোতে দেখা যায় যে, এগুলোর লক্ষ্য প্রধানত শহর ও নগরের মানুষ। কিন্তু ১৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠীই তো গ্রাম মফস্বলে বসবাস করেন। গ্রামাঞ্চলে সর্বাধিক থেকে সমাগম ঘটে হাটে বাজারে। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সব কাঁচা বাজার খোলা থাকবে। তাহলে গ্রামীণ হাটবাজারও কি খোলা থাকবে? সেগুলোতে সংক্রমণ ছড়ানোর ঝুঁকি মোকাবেলায় কোন নির্দেশনা দেখা যায়নি।
গত বছর করোনার বিস্তার ঠেকানোর জন্য নেয়া দেশব্যাপী টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি ও লকডাউন থেকে প্রাপ্তি বলতে গেলে শূন্য। করোনা মহামারীর শুরুতেই গোটা বিশ্ব বলতে গেলে থমকে দাঁড়িয়েছে। মানুষের মৃত্যুর মিছিলে স্তব্ধ পুরো মানবতা। এ মহামারীতে উন্নত বিশ্ব এবং বিশ্বের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সবচাইতে বেশি। করোনা ভাইরাস উন্নত বিশ্বকে যেভাবে তছনছ করে দিয়েছে, সে দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আমাদের দেশ এবং দেশের মানুষ অনেক অনেক ভালো অবস্থায় রয়েছে। উন্নত বিশ্বের সংক্রমণের পরিমাণ আমাদের চাইতে কয়েকগুণ বেশি। তাদের আধুনিক চলাচল ব্যবস্থা ও সুযোগ সুবিধার দিকে নজর দিলে দেখা যাবে সেখানকার অধিবাসী ১০০% লোক স্বাস্থ্য সচেতন। আর আমাদের দেশে রোগ, শোক, ব্যাধি, মহামারী নিত্য লেগেই রয়েছে। যে আকারে বিশ্ব আক্রান্ত হয়েছে সেভাবে যদি আমাদের দেশের লোক আক্রান্ত হতো তবে লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যু এবং লাশের মিছিল লেগে যেতো। পরম করুণাময়ের কাছে হাজারো শুকরিয়া। আমাদের দেশে সেভাবে লোক আক্রান্ত হয়নি। এর কারণ বিশ্লেষণ করার জন্য বিশেষজ্ঞ হতে হবে না। আমার প্রায়শ উন্নত বিশ্বে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। সেখানের লোকেরা আমাদেরকে অসভ্য, আনকালচার, অসচেতন মানুষ হিসেবে হেয় দৃষ্টিতে দেখে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের লোকেরা স্বাস্থ্য সচেতন না হলেও তাদের মাঝে রোধ প্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই ভালো। যার কারণে করোনায় আক্রান্ত হলেও অস্বাভাবিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি। যতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তাঁরা হলেন সমাজের উঁচুতলার মানুষ। সাধারণ বস্তিবাসী, শ্রমিক, মজুর, রিকশাওয়ালা – এদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হওয়ার কারণে করোনা এ পর্যায়ে ক্ষতি করতে পারেনি। এটি সৃষ্টিকর্তার বড় রহমত।
করোনা মোকাবেলায় সরকার ঘোষিত নিয়মনীতি এবং জীবন জীবিকার প্রয়োজনে বেঁচে থাকার প্রয়োজনে এদেরকে ঘরে বসে রাখতে না পারলেও মৃত্যুর হার ছিল অন্য দেশের তুলনায় কম। যার কারণে সরকার করোনা মোকাবেলায় বলতে গেলে সফলতা পেয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘করোনাভাইরাসের ২য় আক্রমণের ভয়াবহ এবং সংক্রমণ ঠেকানোর জন্য সুচিন্তিত পদক্ষেপ এবং দেশের অর্থনীতিকে সচল রেখেই করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে। এজন্য সকলকে মাস্ক পরা বাধ্য করে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে অভিযান পরিচালনা ও গণসচেতনতা বাড়ানো, চিকিৎসা ব্যবস্থা ঠিক করা এবং প্রতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন সুবিধা বাড়ানো সহ বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। উন্নত বিশ্ব যে ব্যবস্থা নিয়েছে আমাদের দেশ সে ব্যবস্থা নেওয়া কোন ভাবেই সঠিক হবে না। আমাদের দেশের আর্থ সামাজিক অবস্থানকে দৃষ্টিতে রেখে দেশীয় চিন্তা চেতনাকে সামনে রেখে করোনাকে মোকাবেলা করতে হবে।
আমাদের দেশের শ্রমিকেরা সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করে। সন্ধ্যার কাজ শেষে মালিকের কাজ থেকে টাকা নিয়ে চাল, ডাল ও সব্জি কিনে ঘরে ফিরে। একদিন কাজ বন্ধ থাকলে পরদিন চলতে তাঁদের কতইনা কষ্ট হয়।
দিনমজুরদের কাছে সময়ের চেয়ে টাকার মূল্যই বেশি। গ্রাম থেকে শহরে রিঙাওয়ালাদের কথা কেউ কি ভেবেছে? শহরের চেয়ে গ্রামের দিনমজুরদের কাজের তেমন পার্থক্য না থাকলেও খাওয়া দাওয়া, ভরণপোষণের ক্ষেত্রে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। শহরে সবকিছুই কিনতে হয়। কিন্তু গ্রামের মানুষ নিজের জমি বা অন্যের জমিতে ফসল চাষাবাদ করে সংসার কোনমতেই ঠিকিয়ে রাখেন।
গ্রামের কৃষকেরা মাটি কেটে, মাছ ধরে, অন্যের জমিতে চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেকে ভ্যানগাড়িতে করে অলিতে গলিতে সব্জি বিক্রি করে। ভিক্ষুকদের কথা আর কিইবা বলবো। অনেকের মুখে শোনা যায়, ‘কিসের লকডাউন, মরলে মরে যাব’, খাইতে পাইলে কেউ কি মৃত্যু কামনা করে?
লকডাউন হলো কিছু মহলবিশেষের সুখের দিন। লকডাউনে অফিস আদালত বন্ধ থাকবে বাসায় বসে পরিবারকে নিয়ে আনন্দে সময় কাটাবে। কিন্তু সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষ ও দিনমজুরদের কি হবে? তাদের সন্তানতো খাবারের জন্য বাবার মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকবে। আর মধ্যবিত্তরা সব দিকেই সমস্যা। তাদেরকে কেউ সাহায্যও করে না আবার আয় রোজগারও নেই।
সুতরাং করোনাভাইরাস গতবারের চেয়েও ভয়াবহ আকারে আসলেও আমাদের ন্যায় গরিব দেশের নিম্ন আয়ের ও মধ্যম আয়ের মানুষদের কথা চিন্তা করে তাদেরকে কিভাবে বাঁচানো যায়, দেশের অর্থনীতিকে কিভাবে ঠিকিয়ে রাখা যায় সেভাবে চিন্তা করে লকডাউন বা বিধিনিষেধ দিতে হবে। দেশের শিল্প-কারখানা কাজ কর্ম স্বাস্থ্য সচেতনতা বজায় রেখে সচল রাখতে হবে। এবারের যে ১১টি নির্দেশনা সরকার দিয়েছে আমি তার সাথে একমত পোষণ করছি। দেশের সবচেয়ে করুণ অবস্থা হলো চিকিৎসা ব্যবস্থা দেশের মানুষকে চিকিৎসা সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে নজরদারি বাড়াতে হবে। দেশের মানুষ যেন চিকিৎসা সহায়তা পায় সেদিকে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। কবির ভাষায় বলছি, ‘বিপদে মোরে রক্ষা করো, এ নহে মোর প্রার্থনা। বিপদকে যেন করতে পারি জয়’।
বর্তমান সময়ে করোনার এ ভয়াবহ পরিস্থিতিকে সামাল দেয়ার জন্য লকডাউন শেষ সমাধান নয়। আমাদের দেশের নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষদের কথা বিবেচনায় রাখতে হবে প্রথম। সমাজের উঁচুতলার মানুষের খাবারের অভাব নেই। তারা মাসের পর মাস, বছরের পর বছর বসে থাকলেও তাদের সংসার চলবে। শুধুমাত্র তাদের কথা বিবেচনায় রেখে যদি ‘লকডাউন’ কার্যকর করা হয় তবে দেশের ১৭ কোটি মানুষ বিপর্যস্ত হবে। বিপর্যস্ত হবে দেশের অর্থনীতি। সকল পর্যায়ের মানুষের স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা সঠিকভাবে নিশ্চিত করে করোনাকে মোকাবেলা করা সম্ভব।
আমার মতে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে যতটুকু সম্ভব দেশকে সচল রেখে করোনা মোকাবেলার পরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন। তবেই দেশ, মানুষ ও দেশের অর্থনীতি সবই ঠিক থাকবে বলে আমি মনে করি।
সাম্প্রতিক জনস্বার্থে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা প্রয়োজন যাতে কোন সিদ্ধান্তের ফলে বিভ্রান্তি ও নতুন নতুন সমস্যার উদ্ভব না ঘটে। জনজীবনে যেন দুর্ভোগ না বাড়ে। সামাজিক ও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং কোভিড রোগীদের চিকিৎসা ক্ষেত্রে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা আরো সহজ ও উন্নত করার মধ্য দিয়ে, ভয়াবহ মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবিলায় সবাইকে সচেতন হতেই হবে। অতীতের ন্যায় এবারও আমরা করোনা মোকাবিলায় সফল হবো।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদক-শিল্পশৈলী