রোহিঙ্গা সমস্যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মোকাবেলা করা প্রয়োজন

তরুণ কান্তি বড়ুয়া | বৃহস্পতিবার , ২৩ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৬:৫৩ পূর্বাহ্ণ

রোহিঙ্গা শব্দটা সম্ভবত আরাকান রাজ্যের শব্দ যা রাখাঙ্গা বা রোসাঙ্গা শব্দ থেকে উদ্ভূত পারে। আরাকানের আদি মুসলিমরা রোসাঙ্গের বাসিন্দা ছিল যা ঐতিহাসিক ভাবে বৃটিশ সাম্রাজ্যের অভ্যুদয়ের পূর্বে নথিভুক্ত ছিল। রোহিঙ্গারা মূলত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে বসবাস করে আসছে। আনুমানিক ১.৪ মিলিয়ন রোহিঙ্গা মিয়ানমারে বসবাস করতো। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আসলেও ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে রোহিঙ্গা গনহত্যার পূর্বে প্রায় ৭ লক্ষ ৪০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা জীবন রক্ষার তাগিদে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল। সাংবাদিক ও মানবাধিকার ব্যক্তিবর্গের মতে বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের নামের মধ্যে রোহিঙ্গাদের অন্যতম একটি হিসেবে বর্ণনা করেছে।

১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে তাদেরকে সেদেশের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়। তাদের চলাফেরার স্বাধীনতা, রাষ্ট্রীয় শিক্ষায় প্রবেশাধিকার এবং সিভিল সার্ভিসের চাকরিতেও তাদের জন্য বিধিনিষেধ আরোপিত ছিল। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্যমান আইনি পরিস্থিতিকে অনেকটা বর্ণবাদ প্রথার সাথে তুলনা করা যায়। কয়েক দশক আগে থেকে রোহিঙ্গাদের ব্যাপক হারে বাস্তুচ্যুতিতে নোবেল বিজয়ী বিশপ ডেসমণ্ড টুটুসহ অনেক মানবতাবাদী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা তাদের বিরুদ্ধে আনীত অপরাধ তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক বিচার আদালতকে গনহত্যার তদন্তে নেতৃত্ব দেয়।

রোহিঙ্গারা দাবি করে তারা পশ্চিম মিয়ানমারের আদিবাসী এবং তাদের ওপর আরব, মুগল এবং পর্তুগিজদের সহস্রাব্দের ঐতিহ্যগত প্রভাব রয়েছে। সম্প্রদায়টির দাবি মতে প্রাক্‌ ঔপনিবেশিক আরাকান এবং ঔপনিবেশিক লোকদের বংশানুক্রমিক ধারায় রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে বসবাস করে আসছিল। ঐতিহাসিক তথ্য মতে অঞ্চলটি দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে একটি স্বাধীন রাজ্য ছিল। পক্ষান্তরে মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম থেকে আসা বৃটিশ ঔপনিবেশিক এবং উত্তর ঔপনিবেশিক অভিবাসী হিসেবে বিবেচনা করে। উপরন্তু মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দেয় না এবং সম্প্রদায়টিকে বাঙালি হিসেবেই বিবেচনা করে। সামগ্রিক ভাবে ২০১৬২০১৮সালে সামরিক দমন পীড়নের মুখোমুখি হয়ে বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আগস্ট ২০১৭ থেকে আনুমানিক ৬,২৫,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থী মিয়ানমারের রাখাইন সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।

মূলত ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ থেকে রোহিঙ্গা শরনার্থী উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে বসবাস করা শুরু করে। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী আনুমানিক ৩,০০,০০০ ,০০,০০০ এর বেশি শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছে। অধিকাংশ শরণার্থী টেকনাফ কক্সবাজার হাইওয়ে বরাবর অবস্থিত নাফ নদীর, বাংলাদেশ মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায়, সমান্তরালে বাস করে। এ মুহূর্তে কক্সবাজারে সবমিলিয়ে ২২ লক্ষ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তাছাড়া ভারতে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, ফলে তারাও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে উত্থাপিত প্রতিবেদন মতে জানা যায় বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে জনসংখ্যার উপচে পড়া ভিড় তার পরিকাঠামোয় চাপ সৃষ্টি করেছিলো। শরণার্থী পরিষেবা, যেমন, শিক্ষা,খাদ্য, পরিস্কার পানীয় জল এবং সঠিক স্যানিটেশনের অভাব হেতু বিভিন্ন রোগ ব্যাধির ঝুঁকি ছিল। ২৫ আগস্ট ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে ‘নিধন কার্যক্রম’ শুরু হলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে ২৪০০০ এর বেশি রোহিঙ্গা নিহত হয়েছিল। অনুমান করা হয়েছিল যে কমপক্ষে ১৮০০০ মুসলিম মহিলা ধর্ষণের শিকার হয়েছিল। ১,১৬,০০০রোহিঙ্গাকে মারধর করা হয়েছিল এবং ৩৬ হাজার রোহিঙ্গাকে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। আসলে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের একটি মুসলিম সংখ্যালঘু জাতি যাদেরকে মিয়ানমার সরকার এবং স্থানীয় জনগণ বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী আখ্যায়িত করে। মিয়ানমার তাদের নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করেছে যদিও বিশ্ব ইতিহাসে তাদেরকে বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাচারিত সংখ্যালঘু হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে। রোহিঙ্গা আগমনের অপ্রতিরোধ্য স্রোত বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক পরিবেশের ওপর মারাত্মক হুমকি হয়ে বিরাজ করছে। বেশিরভাগ শরণার্থীরা কঙবাজার এবং এর আশেপাশে অবস্থিত পর্যটন শিল্পের ওপর নির্ভরশীল উপকূলীয় তীরবর্তী এলাকায় বাস করে। শরনার্থীদের অবাধ অস্বাস্থ্যকর অবস্থানে এলাকাটির পর্যটন প্রত্যাশাও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় ধরে দেশের ভূখণ্ডে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ নিরুৎসাহিত করলেও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাদের আগমন ও অবস্থান ঠেকানো যাচ্ছে না। লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থী অনিবন্ধিত ভাবে বাংলাদেশে বসবাস করছে। ফলে তাদের একাংশ স্থানীয় প্রশাসনকে ফাঁকি দিয়ে নানান অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। বাস্তুচ্যুত অনেক রোহিঙ্গারা ফেনসিডিল, ইয়াবা ও মাদকদ্রব্য পাচারের মতো অপরাধমূলক কাজের সাথে জড়িয়ে পড়ছে। কিছু সংখ্যক অসাধু ব্যক্তিবর্গের আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে বাংলাদেশের এন আই ডি, পাসপোর্ট বানিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। কেউ কেউ ধরা পড়ে বিদেশের মাটিতে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করে চলেছে। অনেক ক্ষেত্রে তাদের একাংশ দেশের ভিতর নানান অসামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ছে। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে এদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোতে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের ন্যূনতম সুযোগ সৃষ্টি করে তাদেরকে স্বাস্থ্যসম্মত ভাবে বসবাসের সুযোগ করে দিতে হবে। তাদের অবস্থান, জীবনযাত্রায় সার্বক্ষণিক স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন যাতে এসব বাস্তুহারা শরণার্থীরা লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে বিপথগামী নাহয়। তাদের সাথে সহাবস্থানে সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টিতে স্থানীয় জনগণকে যথার্থভাবে সচেতন থাকতে হবে। মিয়ানমারের শরনার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও মিয়ানমারের সামরিক সরকার বিষয়টিকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলেছে। এমনেষ্টি ইন্টারন্যাশনাল ডিসেম্বর ২০১৬ এর এক প্রতিবেদনে বলেছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ধর্ষণ, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং রোহিঙ্গাদের বসতবাড়ি দখলের অশুভ তৎপরতা নীরবে তত্ত্বাবধান করছে।

সাম্প্রতিক কালে বাংলাদেশ সংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সামরিক বাহিনীর বড় একটি সদরদপ্তর দখলের দাবি করেছে বিদ্রোহী আরাকান আর্মি। উত্তর রাখাইনে অভিযানের সময় আরাকান আর্মি রোহিঙ্গাদের টার্গেট করেছিল। এর জের ধরে লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে হয়। রাখাইন রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে আরাকান আর্মির তৎপরতা ছিল এবং সেখানেই অধিকাংশ মুসলিম বসবাস করে। ক্রমবর্ধমান ধারায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আগমনের বিষয়টি বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিরূপ প্রভাব ফেলে চলেছে। আন্তর্জাতিক মহলে জনমত সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আমাদের সরকার এবং আন্তর্জাতিক মহলকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। স্বদেশ থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিক অনুভূতি নিয়ে তাদের প্রত্যাবাসনে জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। মানবতা ও মূল্যবোধের নিরিখে সৌভ্রাতৃত্ব সৃষ্টির লক্ষ্যে সকলে এগিয়ে আসুক। আর এ লক্ষ্য অর্জিত হলে শুধুমাত্র রোহিঙ্গা নয় আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে সকল উদ্বাস্তু শরণার্থীরা নিরাপদে স্বদেশে পুনর্বাসিত হয়ে মূলস্রোতের সাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথ খুঁজে পাবে। যেহেতু রোহিঙ্গারা আরাকানের স্থায়ী বাসিন্দা, সেহেতু তাদেরকে স্থানীয় স্বীকৃতি প্রদান করে নাগরিকত্ব ফিরে পেতে সংশ্লিষ্ট সকলকে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়াতে হবে। সম অধিকারের ভিত্তিতে তাদেরকে নাগরিকত্ব প্রদান ও পরিচয়পত্র প্রদান করতে হবে। যথাযথ ক্ষতিপূরণসহ তাদের নিজস্ব বসতভিটা ও জমিজমা ফেরত দিতে হবে। সুতরাং স্থায়ী সমাধানের লক্ষ্যে রোহিঙ্গা সমস্যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে মোকাবেলা করা প্রয়োজন।

লেখক : শিক্ষাবিদ, কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, প্রাক্তন অধ্যক্ষ, রাংগুনিয়া সরকারি কলেজ ও বর্তমানে রেক্টর,

বনফুল আদিবাসী গ্রীন হার্ট কলেজ, ঢাকা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমহান ১০ মাঘের ওরশ শরীফের তাৎপর্য এবং করণীয়
পরবর্তী নিবন্ধড. মইনুল ইসলামের কলাম