আমাদের সকলের জানা; আত্মকর্মসংস্থান, অধিক বেতন, উন্নত কর্মপরিবেশে জীবনযাপনের লক্ষ্যে দেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক মানুষ বিদেশে পাড়ি জমান। তারা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির ভীত মজবুতসহ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে উত্তরোত্তর সমৃদ্ধ করছেন। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারিকালে বাংলাদেশের অর্থনীতির ভারসাম্য বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রবাসী আয়ের ব্যাপক ভূমিকা কারো অজানা নয়। বিশ্বপরিমন্ডলে অদম্য উন্নয়ন অগ্রগতিতে এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশের সামগ্রিক অগ্রগতিতে রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অবদান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ‘জাতীয় প্রবাসী দিবস ২০২৩’ উপলক্ষ্যে দেয়া বাণীতে প্রবাসীদের অবদান আন্তরিক কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে বলেন, ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাংলাদেশীরা অনন্যসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন, যুদ্ধ–বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন, বৈদেশিক সহায়তা এবং কূটনৈতিক কার্যক্রম জোরদার করতে প্রবাসীদের সক্রিয় সহযোগিতা ও অবদান অনস্বীকার্য।’
বিশ্বব্যাংকের মতে, প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের আর্থ–সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। ব্যবসা–বাণিজ্য, শিল্প উৎপাদন, স্কুল–মাদ্রাসা, মসজিদ, হাসপাতাল স্থাপনসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডেও এ অর্থ ব্যয় হয়। রেমিট্যান্স আয়ের প্রায় ৬৩ শতাংশ দৈনন্দিন খাতে খরচ হওয়ায় পরিবারগুলোর দরিদ্রতা দূর হচ্ছে।
২০২৩ সালে বিশ্বের ১৩৭টি দেশে কর্মসংস্থান হয়েছে ১৩ লাখের বেশি বাংলাদেশী কর্মীর যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে বিদেশে যাওয়ার রেকর্ড। এসব কর্মসংস্থানের বেশিরভাগই হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি কর্মী গেছে সৌদি আরবে। দেশটিতে ১১ মাসে যায় ৪ লাখ ৫১ হাজার ৫০২ কর্মী। দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ কর্মী যাওয়া দেশ হচ্ছে মালয়েশিয়া ও ওমান। দেশগুলোতে যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৩ লাখ ২৯ হাজার ৪৩১ ও ১ লাখ ২৫ হাজার ৯৬১ জন। সমসূত্র অনুযায়ী ২০২২ সালে বিদেশ যাওয়া কর্মীর সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার, ২০২১ সালে ৬ লাখ ১৭ হাজার ২০৯, ২০২০ সালে ২ লাখ ১৭ হাজার ৬৬৯ এবং ২০১৯ সালে ৭ লাখ ১৫৯ জন। প্রাসঙ্গিকতায় প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা গণমাধ্যমে বলেন, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা এবং শ্রমখাত নিয়ে সরকারের আন্তরিকতার কারণে রেকর্ড পরিমাণ কর্মী বিদেশে পাঠানো সম্ভব হয়েছে। সরকার বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য নতুন নতুন শ্রমবাজার তৈরি করছে। আগামী বছর হয়তো এই রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্যের বাইরে ইউরোপের অনেক দেশে কর্মী যাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে বেতন নিরাপত্তাসহ সবকিছু নিশ্চিত করে দক্ষ কর্মী পাঠাতে বেশি জোর দিতে চায় সরকার যাতে রেমিট্যান্সের পরিমাণ আরও বাড়ানো যায়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে উন্নয়নে বিস্ময়কর অর্জনে বিশ্বস্বীকৃত বাংলাদেশ সরকারের যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ ও কার্যকর বাস্তবায়নে অর্থনীতির চাকাকে সচল করার গৃহীত সকল উদ্যোগ সর্বমহলে প্রশংসিত। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে প্রবাসীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের গুরুত্ব বিবেচনায় বিদেশে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষের কষ্টার্জিত আয় দেশে বৈধ উপায়ে প্রেরণে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ওয়েজ আর্নার্স রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে সরকার ১ জুলাই ২০১৯ হতে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা বা নগদ সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেয়। পরবর্তীতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধকল্পে সরকার ১ জানুয়ারি ২০২২ হতে রেমিট্যান্সের বিপরীতে নগদ প্রণোদনার হার ২ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ নির্ধারণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ধারাবাহিকতায় বৈধ উপায়ে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধিতে প্রবাসীদের সিআইপি সম্মাননা, প্রবাসী আয়ের বিপরীতে প্রণোদনা, রেমিট্যান্স আহরণ–বিতরণ প্রক্রিয়া দ্রুতকরণ, দেশে আবাসন খাতসহ বিশেষ বিনিয়োগ স্কিম চালু ও প্রশিক্ষিত লোক পাঠানোর মতো নানাধরনের কর্মতৎপরতা অতিশয় দৃশ্যমান।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ২ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার যা সাত মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় তা বেড়েছে ৮ শতাংশ। এছাড়াও ২০২৩–২৪ অর্থবছরের জুলাই–জানুয়ারি সময়ে প্রবাসী আয় ৩ শতাংশ বেড়ে ১২ দশমিক ৮৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বিদায়ী ২০২২–২৩ অর্থবছরে ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রবাসীরা এ যাবৎকালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন ২ হাজার ১৬১ কোটি মার্কিন ডলার। পূর্বে করোনাকালীন ২০২০–২১ অর্থবছরে দেশে সর্বোচ্চ রেসিট্যান্স এসেছিল ২ হাজার ৪৭৭ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমটি) তথ্যানুসারে, এখন পর্যন্ত বছরভিত্তিক হিসাবে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় আসে ২০২১ সালে যার পরিমাণ ২ হাজার ২০৭ কোটি ডলার। ২০২২ সালে তা কমে হয় ২ হাজার ১২৯ কোটি ডলার এবং ২০২৩ সালে সামান্য বেড়ে তা দাঁড়ায় ২ হাজার ১৯১ কোটি ডলার। এছাড়া চলতি এপ্রিল মাসের প্রথম ৫ দিনে রেমিট্যান্স এসেছে ৪৫ কোটি ৫৪ লাখ মার্কিন ডলার (৪৫৫ মিলিয়ন) যার মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ৩ কোটি ৮৫ লাখ, বিশেষায়িত একটি ব্যাংকের মাধ্যমে ২ কোটি ৭৩, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ৩৮ কোটি ৭৭ লাখ এবং বিদেশি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে এসেছে ১৭ লাখ ৬০ হাজার মার্কিন ডলারের রেমিট্যান্স। কিন্তু জনশক্তি রপ্তানিতে মাইলফলক অর্জন সত্ত্বেও এর বিপরীতে বাড়েনি রেমিট্যান্স প্রবাহ। উল্লেখ্য যে, প্রবাসী আয় অর্জনে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য; এই ধরিত্রীর বিভিন্ন দেশে অক্লান্ত পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্জিত অর্থ–রেমিট্যান্স যারা দেশে পাঠাচ্ছে তাদেরকে দেশে ও বিদেশে বিভিন্ন হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। তাদের প্রতি বিদেশে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোর অসহযোগিতা–অভিযোগের অন্ত নেই। দালালের দৌরাত্ম্য, পাসপোর্ট জটিলতা, কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তা নিয়ে অস্বস্তিকর পরিবেশ নতুন কোন বিষয় না হলেও তার সাথে যুক্ত হয়েছে মৃত্যুর পর প্রবাসীদের প্রতি অবহেলাও। প্রবাসীদের অস্বাভাবিক মৃত্যু বৃদ্ধি পেলেও তা প্রতিরোধে বা ঘটনা তদন্তে উদ্যোগী নয় দূতাবাসগুলো। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুসারে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স প্রেরণকারী মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমিকেরা দেশে অধিকতর নিগৃহীত হচ্ছেন। বিমানবন্দরে নেমেই তারা অরাজক আচরণ–ভোগান্তিতে নিপতিত হয়। অভিবাসন খাতের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (বামারু) প্রতিবেদনেও প্রবাসী কর্মীদের নানান দুর্দশার চিত্র উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে উপস্থাপিত তথ্যমতে, উপসাগরীয় দেশগুলোতেই বেশি মৃত্যু হচ্ছে প্রবাসী কর্মীদের। বিদেশের মাটিতে অনেক প্রবাসীর দাফন হচ্ছে। কিন্তু এসব মৃত্যুর কারণ নিয়েও কখনো অনুসন্ধান করেনি মন্ত্রণালয়। মৃত্যু সনদে গণহারে ‘স্বাভাবিক মৃত্যু’ বা ‘হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধে মৃত্যু’ লিখে দেওয়ায় অর্ধেকের বেশি মৃত্যুর কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় নি। এতসব উত্থাপিত অভিযোগসমূহ সংশ্লিষ্ট মহলের আমলে নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ডের (ডব্লিউইডব্লিউবি) বার্ষিক প্রতিবেদনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে রেকর্ড ৪ হাজার ৫৫২ প্রবাসী শ্রমিকের মরদেহ দেশে এসেছে। ২০২২ সালে এসেছিল ৩ হাজার ৯০৪ মরদেহ। উল্লেখ্য সংস্থার ১৯৯৩ সালে প্রথম প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে শুরু করে ২০২৩ পর্যন্ত মোট মরদেহ আসে ৫১ হাজার ৯৫৬ এবং গত ১০ বছরে আসে ৩৪ হাজার ৩২৩ প্রবাসী শ্রমিকের। ২০১৭ সালের জুন থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত আসা ১৭ হাজার ৮৭১ মরদেহের ৬৭ দশমিক ৪ শতাংশই এসেছে উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থার (জিসিসি) আওতাভুক্ত ছয় দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েত, কাতার ও বাহরাইন থেকে।
এছাড়াও বিপুল সংখ্যক প্রবাসী সর্বস্ব হারিয়ে–পুলিশের হাতে আটক হয়ে শূন্য হাতে একপ্রকার ব্যর্থ হয়ে দেশে ফেরার দৃষ্টান্তও অনেক। ডব্লিউইডব্লিউবি’র পরিসংখ্যান মতে, ২০২৩ সালে শূন্য হাতে দেশে ফিরে আসা প্রবাসীর সংখ্যা ৮৬ হাজার ৬২১ জন। তন্মধ্যে পুরুষ ৮৩ হাজার ৭১৯ এবং নারী ২ হাজার ৯০২ জন। তবে সংস্থাটির নিকট পাসপোট নিয়ে দেশে ফেরা প্রবাসীর কোন হিসাব নেই। অভিবাসন খাত সংশ্লিষ্টদের অভিমত, ব্যর্থ অভিবাসনের প্রকৃত চিত্র আরও নাজুক। বছরে এ সংখ্যা হতে পারে লাখের বেশি। দেশে ফিরে আসা ২১৮ প্রবাসীর ওপর রুমারু কর্তৃক পরিচালিত সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিদেশে গিয়ে কোনো কাজ পাননি এমন কর্মীর সংখ্যা ১৫ শতাংশ এবং চুক্তি অনুসারে কাজ পাননি ২০ শতাংশ। ফলশ্রুতিতে এসব কর্মীর দেশে ফিরে আসা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। উক্ত জরিপে অংশ নেওয়া কর্মীদের ১৫ শতাংশ বিদেশে যাওয়ার ১ মাসের এবং ২৯ শতাংশ কর্মী ৬ মাসের মধ্যে দেশে ফেরেন। অভিবাসন খাত বিশেষজ্ঞদের দাবি, যে ধরনের কাজে বাংলাদেশি কর্মীরা বিদেশে যাচ্ছেন, সেসব কাজের জন্য অন্যান্য দেশ থেকে দক্ষ কর্মীরা যাচ্ছেন। তাই বিদেশের কর্মক্ষেত্রে বাংলাদেশের কর্মীদের চাহিদা কমছে। এই ক্ষেত্রে এটি সুস্পষ্ট যে, রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের অধিকতর অনুপ্রাণিত করার জন্য প্রচলিত সুবিধাদি পর্যাপ্ত নয়। তাদের দেশে থাকা মা–বাবা–স্ত্রী–সন্তান–সন্ততিসহ পরিবার পরিজনদের জন্য শিক্ষা–স্বাস্থ্য–পর্যটন–ব্যাংক–বীমাসহ সরকারি–বেসরকারি সেবাখাতসমূহে কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করে সুবিধাদির সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। অন্যথায় বৈধ পথে নয়; বরং অবৈধ পথে বা হুন্ডি ও টাকা পাচারের কদর্য পন্থায় তাদের সৎ উদ্যোগকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার সমূহ সম্ভাবনা প্রবল।
লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়