রূপান্তরের রক্তক্ষরণ

নাইম হোসেন তামিম | শুক্রবার , ৩ অক্টোবর, ২০২৫ at ৬:৪৫ পূর্বাহ্ণ

এক.

অপরাহ্ণের ক্রান্তিলগ্নে টিএসসির অভ্যন্তরে নিঃসঙ্গ বসে আছে জিদান। দূর হতে তাকে বসে থাকতে দেখে আবিদও এসে বসলো তার পাশে। আবিদ ও জিদান দু’জনেই সমবয়সী, ভালো সহপাঠী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধুও। কিন্তু ইদানীং তাদের সম্পর্কে কেমন একটা ভাটা পড়েছে। পূর্বের ন্যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা পুলকিত চিত্তে হাসিঠাট্টা, আমোদপ্রমোদ করতে দু’জনেই সংকোচ বোধ করে এখন। স্বল্পদৈর্ঘ্য নীরবতার পরে কিছুটা সন্দিগ্ধ কণ্ঠে আবিদ বললো– “গতকাল বিকেলে ‘রাজু’র সামনে বিশেষ একটি গোষ্ঠীর সমাবেশে তুমিও ছিলে, তাই না?” জিদান মুখ না তুলেই উত্তর দিলো, “হু”। আবিদ পুনরায় বললো, “বেশ, ভালো। কিন্তু জিদান, তোমরা যা চাইছো, তা কোনোভাবেই মানবপ্রকৃতির স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য নয়। আর একথা তোমাদেরও অজ্ঞাত নয়।”

জি: “অন্য কারো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিঘ্ন ঘটানোও সংবিধান পরিপন্থি। আশা করি, একথাও তুমি ভুলে যাওনি।”

: “বটেই, বটেই! কিন্তু সংবিধানও যে তোমাদের বিকৃতির সাক্ষ্য দেয়! যাই হোক, সেই পুরনো একপেশে তর্কে আর যাচ্ছি না। শুধু বলবো, একটা বিকৃত, অন্যায় কাজের বৈধতা চেয়ে তোমরা সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছো।”

জি: “ভুলে যেওনা আমাদের নিয়েই সমাজ। আমরাও সমাজেরই অংশ।”

: “তাই বলে তোমাদের মতিভ্রমকে মাথা ঠুকে সেলাম করতে হবে?” ভ্রুকুচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো সামনের দিকে। কিন্তু জিদানের নিরুদ্যম ভাব দেখে আবারও বলতে শুরু করলো-“মনে মনে যে আমিও জাতিসংঘের মহাসচিব! এখন মনের কৃত্রিম বোধকে পুঁজি করে গুতেরেসের সঙ্গে গুতোগুতি করতে যাওয়া কি আদৌ বুদ্ধির কাজ? শোনো জিদান, পাশ্চাত্যের পুঁজিবাদের পণ্য হয়ো না। বিকৃত মতাদর্শের সমর্থক কয়েকজন বিজ্ঞানী আর কিছু ভুলভাল পরিসংখ্যান বাদ দিলে প্রমাণ করার মতো তোমাদের আর কিছুই থাকে না। বিজ্ঞান সামগ্রিকভাবে কখনোই তোমাদেরকে স্বীকার করবে না, করতে পারে না।”

জি: “সে দায় নেহাতই বিজ্ঞানের, আমাদের নয়।”

আবিদ একবার সম্মুখে তাকিয়ে শুষ্ক হেসে বললো-“হ্যাঁ তাই। সৃষ্টির খুঁত ধরে স্রষ্টার দিকে আঙুল তুলতে উঠেপড়ে লেগেছো তোমরা! কিন্তু জেনে রাখো, ‘কাল্লা তুফলিহুন’সাফল্য কখনোই তোমাদের স্পর্শ করবে না।”

স্রষ্টার কথা স্মরণ হওয়ায় সহসা উত্তর দিতে পারলো না জিদান। গ্রামে থাকতে ধর্মকর্মে অনেকটাই আগ্রহ ছিল তার। শহরে এসে একটু বিগড়েছে, এই যা! জিদানের বিব্রত অবস্থা লক্ষ্য করে আবিদ একটু হেসে পুনরায় বলতে লাগলো, “পরনে লালপেড়ে শাড়ি জড়িয়ে, চোখের নিচে মোটা কাজল দিয়ে, কপালে সিঁদুররাঙা বড়ো একটা তিলক লাগিয়ে তুমি তোমার পুরুষত্বকে লুকাতে চাইছো! আর ওইদিকে দেখো, কারো ঘরের অতি আদুরি কন্যা শার্টপ্যান্ট পড়ে, হাতের জ্বলন্ত সিগারেটে টান দিয়ে ঊর্ধ্ববদনে হতাশার ধোঁয়া ছাড়ছে! তোমার কি মনে হয় না, এসব কেবল সভ্য জাতিকে অসভ্য করার কৌশল মাত্র?”

প্রশ্নের উত্তর দেওয়াকে বাহুল্য মনে করলো জিদান। কিন্তু ততক্ষণে রাগেক্ষোভে রক্তবর্ণ হয়ে উঠলো তার চোখমুখ। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে আবিদের দিকে তাকিয়ে কর্কশকণ্ঠে বললো– “আমার ব্যক্তিগত বিষয়ে নাক গলানোর তুমি কে?”

ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বের সুবাদে আবিদ এতক্ষণ নির্বিঘ্নে ও স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলে আসছিল। কিন্তু অকস্মাৎ জিদানের এরূপ রূঢ় ব্যবহারে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো সে। আশপাশের লোকজনের কৌতূহলী দৃষ্টি লজ্জিত করলো তাকে। দ্বিতীয় বাক্য উচ্চারণের আগেই ব্যাগটা হাতে নিয়ে পূর্বনির্ধারিত গন্তব্যের দিকে ধীর পদক্ষেপে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলো।

নিশীথের নিষ্কলুষ স্বচ্ছতায় শহিদমিনার প্রাঙ্গণে বসে জিদানের কর্মপরিণতি নিয়ে ভাবতে ভাবতে সহসা চিন্তিত হয়ে পড়লো আবিদ। কূলকিনারা করতে না পেরে অন্তত তার বাবাকে সত্ত্বর জানানো জরুরি মনে করলো সে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। প্রত্যুষে উঠে হ্যান্ডসেটটায় খুঁজে খুঁজে ফোন করলো জিদানের বাড়ির নম্বরে। গ্রামের অক্ষরজ্ঞানশূন্য কৃষক মোবারক মিয়া কতক বুঝলেন, কতক বুঝলেন না। যেটুকু বুঝলেন, বিশ্বাস করতে চাইলেন না। কিন্তু আবিদকে আগ থেকে জানতেন বলে অগ্রাহ্যও করতে পারলেন না। আবিদ যখন তাকে বিস্তারিত বুঝিয়ে দিলো, বৃদ্ধ গুরুতর বিপদের আশঙ্কা করে মাথায় হাত দিলেন। ছেলেকে ফোন দিয়ে শীঘ্রই বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। কিন্তু বাহ্যদৃষ্টিতে যখন ছেলের কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন না, তখন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মোবারক মিয়া নিশ্চিন্ত হলেন।

দুই.

দিনান্তে গ্রামবাংলায় চাষাভুষা মিলে চাপানের জমজমাট আড্ডা বসে। ঘটনার দুই মাস পরে একদিন, জোয়ানপ্রবীণ নিয়ে চায়ের আসর বেশ জমে উঠেছে। একজন গল্পচ্ছলে কারো চৌদ্দপুরুষ উদ্ধার করছে, আর বাকিরা তন্ময় হয়ে শুনছে। হঠাৎ মোবারক মিয়ার আবির্ভাবে গল্পের সুর কেটে গেলো। আসরের মধ্য থেকে গ্রামের চৌকিদার মহাশয় সহাস্যে হাঁক দিয়ে উঠলো। “আরে মোবারক ভাই যে! আহো, বহো। কই হে ফকা ভাই, লিকার কমাইয়া ন্যাভাইরে এককাপ চা দ্যাও দেহি।” শারীরিক কুশলাদি জিজ্ঞাসার পরে একটু ভণিতা করে বললো, “পোলাডা তোমার লেখাপড়ায় গাঁয়ের মুখ উজ্জ্বল করছে, মাশাল্লাহ। তা তোমাগো খোঁজটোজ লয় নি?” অপত্যের উচ্চশিক্ষার প্রসঙ্গ উত্থিত হলে মোবারক মিয়া সর্বদাই পুলকিত হয়ে ওঠেন। স্বতঃস্ফূর্ত উৎসাহের সঙ্গে বলতে লাগলেন, “, হ্যা লয়। হপ্তায় একফির হইলেও অর মায়ের লগে কল দিয়া কথা কয়।” চৌকিদার হাস্যজ্বল ভঙ্গিতে বললো, “বেশ, বেশ। তা শহরের আলোবাতাস পাওয়া পোলা। দিনকালতো এহন আর ভালো না। খবরটবর রাহো নি কিছু?” মোবারক মিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন সামনের দিকে। চৌকিদার একটু নড়েচড়ে বসে শুরু করলো, “হপ্তাহখানেক আগে আমার বড়ো পোলাডা গেছিলো শহরে। কই নাকি দেখছিল তোমার পোলারে। দূর থাইক্যা ডাক দিছিলো হ্যারে। তা হ্যায় ফিররাও চায় নাই একবার। পোলা কি তোমার আর পোলা আছে মিঁয়া! মাইয়াগো সুরতে ঘুরে নাকি হ্যায়!” কথাটা শেষ করতেই চৌকিদার মুখের ভাবখানা এমন করলো, বোধ করি ওয়াটার লু যুদ্ধ জয়ের পরে ওয়েলিংটনের মুখেও এতটা প্রফুল্লতা দেখা যায়নি। মোবারকের ঔদাসীন্যের অবসরে আশপাশে একটু খোঁচা দিয়ে আরেকটু আমোদ করে নিলো চৌকিদার, কারণ মোবারকের আবির্ভাবের পূর্বের হাসিঠাট্টাটা তার পুত্রকে নিয়েই হচ্ছিল। অন্যদিকে মোবারক মিয়া লজ্জায়ঘৃণায় মাথা হেট করে, অর্ধসমাপ্ত চায়ের কাপটা ফেলে রেখে হনহনিয়ে বাড়ির পথ ধরলেন। রোয়াকে কর্মনিযুক্ত মধ্যবয়স্কা স্ত্রীকে অভিধানবহির্ভূত শ্রাব্যঅশ্রাব্য শব্দাবলীতে সম্ভাষণ করে উঠানে আশপাশের বাড়ির লোকজন জড়ো করলেন। শেষমেশ, জিদানকে ফোন দিয়ে জননীর অসুস্থতার মিথ্যা সংবাদ জানিয়ে অনতিবিলম্বে বাড়ি ফেরার হুকুম জারি করে ক্ষান্ত দিলেন।

চৌকিদারের জ্যেষ্ঠ সুপুত্রের গাঁয়ের প্রতিটি বাড়ির হাড়ির খবর বের করে আনতে পারার যথেষ্ট সুনাম আছে। আর সেই সব খবর গাঁয়ের গলিঘুঁজি ঘুরে ঘুরে, সকলের কর্ণগোচর করার গুরুভারও তার উপরেই ন্যস্ত। তাই স্বভাবজাত কারণেই হোক বা হিংসার, শহরফেরত আব্দুল আমোদমিশ্রিত এই সংবাদটি চায়ের বৈঠক থেকে তাসের আসর পর্যন্ত সবখানে নির্বিঘ্নে সমপ্রচার করতে লাগলো। একে শূন্য দশ হলো, দশে শূন্যে শত, আর শতে শূন্যে সহস্র। এবং নিমেষেই আব্দুল এই মহা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদটি গ্রামের আনাচেকানাচে পৌঁছে দিলো। ফলাফল হলো এই, জিদান বাড়িতে ফিরলে গ্রামের মুরুব্বিরা ঠোঁট উল্টিয়ে বলতে লাগলেন, “অ্যাহ্‌, ও আবার হয় নাকি?” মহিলারা পর্দার আড়াল থেকে গালেমুখে হাত দিয়ে ‘তৌবা তৌবা’ পড়তে লাগলেন, “ছি ছি, এমন তো জন্মেও শুনিনি বাপু!” বাল্যসখীরা আপনা থেকে গায়ে পড়ে টিটকারি করতে লাগলো, “আয় লো সখী, তোকে বধূ সাজিয়ে বিয়ে দিয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠাই।” একথা বলে সমবেত কণ্ঠে খিলখিল শব্দে হাস্যকলরব তুললো। ফলত জিদান লজ্জায়সংকোচে এতটুকু হয়ে গেলো। কিন্তু যে অন্ধকারাচ্ছন্ন গোলকধাধায় সে প্রবেশ করেছে, সেখান থেকে বের হতেও চাইলো না। অনুচিত কর্মের রম্যতা এমনই প্রবল যে, মানুষ তার বন্ধন থেকে সহজে নিজেকে মুক্ত করতে চায় না।

তিন.

ছেলেসন্তানের প্রতি মায়ের স্নেহবাৎসল্য এবং বাবার সঙ্গে কিছুটা মারপিটের সম্পর্ক হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই জিদান আর মোবারক মিয়ার মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। আর জিদান যতই বাবার স্নেহ থেকে দূরে সরেছে, ততই মায়ের মমতা আর বোনের ভালোবাসায় সেই ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করেছে। আবার ধর্মীয় রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান হওয়ায় পাড়ার দুরন্ত ছেলেপুলেদের সাথে দুরন্তপনার ফুরসতও তেমন একটা পায়নি সে। ফলে শৈশব থেকেই পুরুষালি দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তেমন পরিচিত হয়ে ওঠা হয়নি তার। ওদিকে ভার্সিটিতে পা দিতে না দিতেই রংধনুপতাকাধারীদের সঙ্গে মিশে চরিত্রবিকৃতির ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে। বিয়াল্লিশ বছরে পা দিয়ে মোবারক মিঁয়া উপলব্ধি করলেন, বাবার সংস্পর্শেই কেবল একটি শিশু পুরুষ হয়ে ওঠে। সঠিক সময়ে সন্তানকে সঠিক শিক্ষাটি দিতে না পারলে ভুল সময়ে ভুল মানুষ এসে ভুল শিক্ষাটি দিয়ে যায়। বাইশ বছর পরে এসে অনুশোচনা করতে লাগলেন, কেন ছেলেকে ছোটোবেলা থেকে সঙ্গে সঙ্গে রাখলেন না, কেন হাত ধরে হাঁটতে নিয়ে গেলেন না, কেনইবা ছেলের হাতে বাজারের থলেটালাঙলের ঈষটা তুলে দিলেন না। এই তো পুরুষত্বের দাবি। শৌর্যেবীর্যে বলবান পুরুষ যদি প্রসাধনী ব্যাগ স্কন্ধে ঝুলিয়ে মেয়েলি ভঙ্গিতে সঞ্চরণ করে বেড়ায়, তবে যে তা পুরুষের লজ্জা এবং পুরুষত্বের অপমান। তবে, এই মুহূর্তে ভাবনা ছাড়া আর যে পথ নেই। ব্যঞ্জন যে সম্মুখেই উপস্থিত! চক্ষু মুদ্রিত করে ভক্ষণ ব্যতীত আর উপায় কী?

লোকসমাজের নিন্দার বিষ এবং একান্ত আপনার জনের বিরূপ প্রতিক্রিয়া হজম করতে না পেরে গৃহত্যাগে উদ্যত হলে মোবারক মিয়া শেষবারের মতো সন্তানের কাছে আকুতি জানালেন। কিন্তু অভিযুক্ত বিনম্রভাবে তা প্রত্যাখ্যান করলে মোবারক মিয়া ক্রোধান্বিত হয়ে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করত ক্ষিপ্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন, “বাইর হইয়া যা আমার বাড়ি থেইক্যা। তোর মতো কুলাঙ্গার পোলা লাগবো না আমার। আর আহিস না তুই বাড়িতে, আর আহিস না।” শেষোক্ত কথাটা কয়েকবার পুনরুক্তি করে মোবারক মিঁয়া দরজার হাতলটা ধরে ধীরে ধীরে মেঝেতে বসে পড়লেন। চোখেমুখে তীব্র বেদনার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠলো। জিদান ততক্ষণে বাড়ির আঙিনা ডিঙিয়ে পথের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেছে। জননী আড়ালে দাঁড়িয়ে আঁচলে কয়েক ফোঁটা অশ্রু মুছে নিয়ে জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইলেন শ্রীহীনবন্ধুর পথের পানে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাহলিল জিবরানের ছোট গল্প
পরবর্তী নিবন্ধইছানগর যুব সংঘের চিকিৎসা ক্যাম্প