রুগ্‌ণ ব্যাংকগুলোকে একীভূত করা প্রসঙ্গে

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ১৪ মে, ২০২৪ at ৭:৪৬ পূর্বাহ্ণ

বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান সমস্যা খেলাপি ঋণ কালচার। একটি প্রভাবশালী মহল ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদের যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাজনৈতিক ফায়দা নিয়ে ব্যাংকগুলোকে লুটেপুটে খেয়েছে। এসব লুটপাট ও অপকর্মে জড়িতদের সবাই চিনলেও তাদের টিকিটি কেউ ছুঁতে পারেনি। উল্টা রুগ্‌্‌ণ ব্যাংকগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক। যা সত্যিই দুঃখজনক। তবে বিলম্ব হলেও কর্তৃপক্ষ এখন চাইছে রুগ্‌ণ ব্যাংকগুলো সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত হয়ে সবল হয়ে উঠুক। সেজন্য চলতি বছরের মধ্যে ৭ থেকে ১০টি দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। এর মধ্যে ৫ টি দুর্বল ব্যাংককে সবল ৫ টি ব্যাংকের সাথে একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এর বাইরে আর কোনো ব্যাংককে এখন একীভূত করা হবে না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারা বলেছেন, যে পাঁচটি ব্যাংক একীভূত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তার ফলাফল ও অভিজ্ঞতা যাচাইয়ের পর অন্য কোনো দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এ বিষয়ে আমাদের সক্ষমতা কতটুকু আছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ। একটি ব্যাংক নিরীক্ষা করতে তিনটি প্রতিষ্ঠান লাগে। দেশে ভালো নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব রয়েছে। ইতিমধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংক এখন একীভূত হতে রাজি নয় বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছে। আর বেসিক ব্যাংক বেসরকারি কোনো ব্যাংকের সাথে একীভূত হতে সম্মত নয় বলে জানিয়েছে।

গত ৩১ জানুয়ারি২৩ ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে এক বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করার বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দেওয়া হয়। একই ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয় ৪ মার্চ ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির একটি প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকেও। মার্চে বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকের শীর্ষ ব্যক্তিদের ডেকে সংকটে থাকা পদ্মা ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার পরামর্শ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপর ৩ এপ্রিল সরকারি খাতের দুটি ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। সেদিন রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে (রাকাব) বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে ও বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে (বিডিবিএল) সোনালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। ৮ এপ্রিল সিটি ব্যাংকের সঙ্গে সমস্যাগ্রস্ত বেসিক ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়। সর্বশেষ ৯ এপ্রিল বেসরকারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের সঙ্গে সংকটে থাকা ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত হয়।

এদিকে দুর্বল ব্যাংককে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে স্বেচ্ছায় ও জোরপূর্বক একীভূত করণের বিষয়ে নীতিমালা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একীভূত করার নীতিমালার বেশ কিছু বিধান নিয়ে খাতসংশ্লিষ্ট ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উদ্বেগ থাকলেও সবাই বলছেন, ব্যাংক একীভূত করণের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট একটি নীতিমালার দরকার ছিলসেটি অন্তত হয়েছে। এখন দরকার সব পক্ষের মতামতের ভিত্তিতে এটিকে আরো কার্যকর ও বাস্তবসম্মত করা।

সমপ্রতি বিশ্বব্যাংক বলেছে, ব্যাংক একীভূত করার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা দরকার। সম্পদের মান ও সুনির্দিষ্ট নীতি মালার ভিত্তিতে ব্যাংক একীভূত করা উচিত বলে মনে করে সংস্থাটি। নীতিমালায় স্বেচ্ছায় একীভূত হলে কী করতে হবে আর স্বেচ্ছায় একীভূত না হলে বাংলাদেশ ব্যাংক কী প্রক্রিয়ায় খারাপ ব্যাংককে একীভূত হতে বাধ্য করবে, তার আলাদা বিধান রয়েছে। ব্যাংক একীভূত নীতিমালায় বলা হয়েছে, দুর্বল যে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত হবে, সেটির পরিচালকেরা পাঁচ বছর পর আবার একীভূত হওয়া ব্যাংকের পর্ষদে ফিরতে পারবেন। যদিও এ ক্ষেত্রে তাঁদের কিছু শর্ত মানতে হবে। কিন্তু ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাঁদের কারণে ব্যাংক খারাপ হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে পাঁচ বছর পর তাঁদের আবার পর্ষদে ফেরার বন্দোবস্ত রাখা হলো।

নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে, একীভূত হওয়া ব্যাংকের কর্মীদের তিন বছর পর্যন্ত ছাঁটাই করা যাবে না। এমনকি একীভূত হওয়ার আগে কর্মকর্তাকর্মচারীরা যে বেতন ও শর্তে কর্মরত ছিলেন, সেই একই বেতন ও শর্তে তাঁদের বহাল রাখতে হবে। ব্যাংকাররা বলছেন, এ বিধানের ফলে ব্যাংকের কর্মীদের মধ্যে একধরনের বৈষম্য তৈরি হতে পারে। তাঁরা বলেন, সাধারণত ব্যাংকে প্রতিবছর কর্মীর কার্যমূল্যায়ন করা হয়। তার ভিত্তিতে তাঁদের পদোন্নতি ও অন্যান্য বিষয় নির্ধারিত হয়ে থাকে। নীতিমালায় খারাপ ব্যাংকের কর্মীদের তিন বছরের জন্য চাকরি ও আর্থিক সুবিধার গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে। অথচ ভালো ব্যাংকের কর্মীরা প্রতিবছর তাঁদের কাজের ভিত্তিতে মূল্যায়িত হোন। তবে একীভূত হওয়া ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), অতিরিক্ত এমডি ও ডিএমডিরা চাকরি হারাবেন। নীতিমালায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যাংক স্বেচ্ছায় একীভূত হলে তিন বছর পর্যন্ত পৃথক আর্থিক বিবরণী প্রণয়ন করতে পারবে। এতে অধিগ্রহণকারী ব্যাংকের আর্থিক বিবরণীতে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। তবে তিন বছর পর সমন্বিত আর্থিক বিবরণী তৈরি করতে হবে। স্বেচ্ছায় একীভূত হওয়া ব্যাংকের ক্ষেত্রে বিলুপ্ত হওয়া ব্যাংকের ব্যক্তি আমানতকারীরা আগে টাকা ফেরত পাবেন।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানও একীভূত করতে পারবে। এছাড়া সমঝোতার মাধ্যমে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নির্দিষ্ট কিছু শাখা, শাখার অদলবদল, ব্যবসা স্থানান্তর ও ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া প্রতিষ্ঠানও অধিগ্রহণ করতে পারবে। স্বেচ্ছায় একীভূত হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হবে একীভূত কোম্পানির মূলধন, সম্পদ ও দায় মূল্যায়ন, হস্তান্তর মূল্য/বিনিময়, হস্তান্তর মূল্য পরিশোধ পদ্ধতি এবং শেয়ারের সোয়াপ অনুপাত নির্ধারণ, হস্তান্তরকারী কোম্পানির দায় পরিশোধ, মুনাফার ওপর প্রভাব, হস্তান্তর কোম্পানির শাখা পুনর্গঠন, প্রযুক্তিগত পরিকল্পনা, কর্মকর্তাকর্মচারী, শেয়ারবাজারে একীভূতকরণের প্রভাব, একীভূত কোম্পানির শেয়ার ধারণের কাঠামো, একীভূত কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ ও নাম পরিবর্তনের বিষয়টি। একীভূত হওয়া ব্যাংকের আর্থিক সূচক যাতে খারাপ না হয়, এ জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতি ছাড় ও তারল্য সুবিধা প্রদান করবে। পাশাপাশি একীভূত হওয়া ব্যাংককে বিশেষ নীতি সহায়তা দিতে সরকারের কাছে আবেদন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

একীভূত হতে যাওয়া ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মূল্য নির্ধারণ কীভাবে হবে, তাও নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সরকারি সিকিউরিটিজ ব্যতীত অন্যান্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আগের মাসের শেষ তারিখের বাজার দরে মূল্যায়ন হবে।

নীতিমালা অনুযায়ী, দুর্বল চিহ্নিত হওয়া ব্যাংক মানোন্নয়নে ব্যর্থ হলে ওই ব্যাংকের পর্ষদ বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারবে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ধরনের ব্যাংক একীভূত করার সিদ্ধান্ত হলে বাংলাদেশ ব্যাংক দায় ও সম্পদ গ্রহণের জন্য দরপত্র আহ্বান করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশ করবে।

২০২২ সালের জুলাইয়ে আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকে গভর্নর হিসেবে যোগ দেওয়ার পর পদ্মাসহ ১০টি দুর্বল ব্যাংকে পৃথক তদারকি শুরু করেন। এতে সুফল না পাওয়ায় ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ)’ শীর্ষক একটি নীতিমালা জারি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেসব ব্যাংকের প্রকৃত খেলাপি ঋণ ৫% বেশি এবং ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণের অনুপাত (সিআরএআর) ১২.% কম, সেগুলোকে চার ভাগে ভাগ করা হবে। এর মধ্যে ৩ ও ৪ শ্রেণিভুক্ত ব্যাংকের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য এক বছর সময় দেওয়া হবে। এ সময়ের মধ্যে আর্থিক অবস্থার উন্নতি না হলে সেসব ব্যাংককে একীভূত করার উদ্যোগ নেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে দেশে ৬১টি ব্যাংকের মধ্যে ৪০টির মতো ব্যাংক ভালো অবস্থায় আছে। বাকিগুলোর মধ্যে ৮১০টির অবস্থা খারাপ।

এখন প্রশ্ন হলো ব্যাংকগুলো দুর্বল হলো কেন? বা কারা এর জন্য দায়ী? আসলে এই ব্যাংকগুলো একদিনে দুর্বল হয়নি। দিনের পর দিন ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের অদক্ষতা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও লুটপাটের জন্য এসব ব্যাংকের এই করুণ দশা। নামে বেনামে ঋণ নিয়ে বা সহযোগিতা করে পরিচালনা পর্ষদই ব্যাংকগুলোকে দুর্বল করেছে। তাই দোষী পরিচালকদেরকে আইনের আওতায় এনে তাদের অর্জিত সম্পদ বাজেয়াপ্ত ও কঠিন এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করে, কোনো প্রকার ছাড় না দিয়ে অতিদ্রুত এইসব রুগ্‌্‌ণ ব্যাংককে একীভূত করা জরুরি।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার গ্রাম আমার শহর
পরবর্তী নিবন্ধঐতিহাসিক কদলপুর : প্রথম চট্টগ্রাম বিজয়ী মুসলিম সেনাপতি কদল গাজীর স্মৃতি ও অধুনা মুসলিম চৌধুরী