চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী রিয়াজউদ্দিন বাজার। এক বাজারেই শত বাজারের সমন্বয়। শত বছর ধরে নগরবাসীর হাজারো চাহিদা মিটিয়ে আসছে এই বাজার। দুইশটিরও বেশি ভবনে দোকান আছে প্রায় ২০ হাজারের মতো। চট্টগ্রামের সম্ভ্রান্ত ও বনেদী পরিবারের সন্তান চট্টগ্রাম–নোয়াখালী অঞ্চলের প্রথম মুসলিম গ্র্যাজুয়েট শেখ রিয়াজউদ্দিন আহমদ সিদ্দিকী চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনের নিকট জঙ্গলাকীর্ণ বিশাল অঞ্চল কিনে রিয়াজউদ্দিন বাজার প্রতিষ্ঠা করেন।
ঐতিহ্য রিয়াজউদ্দিন বাজার এখন অপরাধের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। চোরাচালান, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, হুন্ডি ও চোরাই মোবাইল ব্যবসায়ীদের দাপটে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা পড়েছেন ইমেজ সংকটে। আর রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় নানারকম অবৈধ কর্মকাণ্ডের ভাগ বাঁটোয়ারা নিয়ে খুনের ঘটনাও ঘটছে। সাম্প্রতিক সময়ে রিয়াজউদ্দিন বাজারে বিভিন্ন ঘটনায় ৭টি খুন হয়েছে। মাঝে মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলে, ভ্রাম্যমাণ আদালতও পরিচালিত হয়। অভিযোগ রয়েছে, রাজনৈতিক আশীর্বাদ এবং আর্থিক প্রলোভনের কাছে মুখ থুবড়ে পড়ে সকল অভিযান।
সর্বশেষ গত ৯ জুলাই দুপুরে রিয়াজউদ্দিন বাজার রয়েল টাওয়ারের সামনে থেকে ব্যবসায়ী নুর মো. ইয়াছিন কবিরের দুই কর্মচারী মোরশেদ আলম ও ত্রিদীপ বড়ুয়াকে মারধর করে নগদ ৯ লাখ ৮০ হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাহিদুল কবীর আজাদীকে বলেন, রিয়াজউদ্দিন বাজারে দিনেদুপুরে মোবাইল ব্যবসায়ীর পৌনে ১০ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িতরা সংঘবদ্ধ একটি ডাকাত চক্র। তারা বড় বড় ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে এবং ব্যাংকিং লেনদেনের বিষয়ে খোঁজখবর রাখত। তিনি বলেন, চক্রটি ব্যবসায়ীদের টাকা নিয়ে কে কখন কোন ব্যাংকে জমা দিতে যায়, কে উত্তোলন করতে যায় তাদের টার্গেট করে গতিবিধি নজরদারিতে রাখে। একপর্যায়ে যে ব্যাংকে টাকা জমা দিতে যায় বা উত্তোলন করে তাকে টার্গেট করে পূর্ব থেকে ওত পেতে থাকা স্থানে পৌঁছামাত্রই মারামারির পরিস্থিতি সৃষ্টি করত, যাতে কোনো পথচারী বাঁচানোর চেষ্টা না করে। মারামারির একপর্যায়ে সুযোগ বুঝে নগদ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যেত। অভিযান চালিয়ে এ ঘটনায় জড়িত চারজনকে গ্রেপ্তার ও সাত লাখ দশ হাজার টাকা উদ্ধার করেছে কোতোয়ালীর একটি টিম।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের মাঠ পর্যায়ের দুই কর্মকর্তা আজাদীকে জানান, ঘটনাটির পর মূল পরিকল্পনাকারী একরামুল আলমের পক্ষে রাজনৈতিক তদবির এসেছিল একের পর এক। তবে ডিসি সাউথ স্যার থেকে ওসি স্যার পর্যন্ত সকলে ডিটারমাইন্ড ছিলেন যে রিয়াজউদ্দিন বাজারের অপরাধ জগতে হানা দেওয়ার এটিই প্রকৃত সময়। যারা তদ্বির করেছিলেন তারাও একপর্যায়ে বুঝেছিলেন বিষয়টি।
নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ–কমিশনার (দক্ষিণ) নোবেল চাকমা শাহ আজাদীকে বলেন, যেখানে অবৈধ ব্যবসা হবে, সেখানে কাঁচা টাকার লোভে অপরাধীদের ভিড় বাড়বে–এটাই স্বাভাবিক। আমরা যদি অভিযোগ না পাই তবে অভিযান চালানোটা কঠিন। তিনি বলেন রিয়াজউদ্দিন বাজার ও তামাকুমন্ডি লেইন ঘিঞ্জি এরিয়া। তাই সুনির্দিষ্ট তথ্য ছাড়া এখানে অভিযান চালাতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। কারণ বাজারে ঢুকলেই কোনো না কোনোভাবে অপরাধীদের কাছে খবর পৌঁছে যায়। তবে অভিযোগ পেলে আমরা যে ঠিকই ব্যবস্থা নিই, দশ লাখ টাকা ডাকাতির ঘটনায় আমাদের সার্থকতা তারই প্রমাণ।
রিয়াজউদ্দিন বাজার ও তামাকুমন্ডি লেইনের একাধিক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজাদীকে বলেন, এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমরা ব্যবসায়ী সমাজ নির্যাতিত, আতঙ্কিত। নামে–বেনামে বিভিন্ন ব্যানার, সাইনবোর্ড ব্যবহার করে বাজারে ঢুকছে, নানা অপরাধ করছে, আমরা কিছুই বলতে পারছি না। এদের কারণেই পেশাদার অপরাধীরা সুযোগ পাচ্ছে। সরকারের কাছে আকুল আবেদন, ব্যানার ও সাইনবোর্ড ব্যবহার করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমকারী এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। বাকি অপরাধীদের শায়েস্তা করতে আমরা ব্যবসায়ী সমাজই যথেষ্ট।
সরেজমিনে গত বৃহস্পতিবার রিয়াজউদ্দিন বাজার ও তামাকুমন্ডি লেইন ঘুরে জানা গেছে, ঐতিহ্যবাহী এই বাজারে ছোট–বড় দুই শতাধিক মার্কেটে ১০ হাজারের অধিক ব্যবসায়ী রয়েছেন। তবে এই বাজারে চোরাই মোবাইল, ইয়াবা, স্বর্ণ পাচার, হুন্ডি ও সিগারেট ব্যবসায়ী বাড়ছে। এ বাজার থেকে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে স্বর্ণ পাচারের ব্যবসা। বাজারটিতে প্রতিদিন ঢুকছে হাজারো চোরাই মোবাইল।
রিয়াজউদ্দিন বাজারে চোরাই মোবাইল ও ইয়াবার ব্যবসা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। জলসা মার্কেট, করিম সুপার মার্কেট, সিডিএ মার্কেট, নালা হকার মার্কেট, রিজোয়ান কমপ্লেক্স ও ইসলাম মার্কেটে বেশ কিছু ব্যবসায়ী এসব ব্যবসার সাথে জড়িত। র্যাবের সাথে বন্দুকযুদ্ধে ইয়াবা সম্রাট জাহেদুল ইসলাম আলোর মৃত্যুর পরও ইয়াবার সাম্রাজ্যে এতটুকু চিড় ধরেনি। ইয়াবা ব্যবসায় জাহিদ, মঞ্জুরুল আলম মঞ্জু, চোরাই মোবাইল ব্যবসায় সৈয়দ নুর, হাসান, দোস্ত মোহাম্মদ মানিক, বেলাল, আবুল, হোসেন, আব্বাস, আবসার, জাহাঙ্গীর ও শরীফের নাম আছে পুলিশের তালিকায়।
নোয়াখালীর বাসিন্দা লিটন থাকতেন লালখান বাজারের বস্তিতে। শুরুতে মোবাইল চুরির সাথে জড়িত ছিলেন। পরে চলে যান ঢাকায়। লিটন এখন ঢাকা শহরের কয়েকজন শীর্ষ মোবাইল চোরদের মধ্যে একজন। থাকেন ফ্ল্যাটে। রিয়াজউদ্দিন বাজারে চোরাই মোবাইল সাপ্লাইয়ের অন্যতম হোতা এই লিটন। কুরিয়ার সার্ভিস কিংবা এসি চেয়ার কোচে এসব মোবাইলের কার্টন আসে রিয়াজউদ্দিন বাজারে।
জাহেদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে শতাধিক কিশোর, যারা ইয়াবা বহন ও বিক্রি করে। আগে ছিলেন ট্যাক্সিচালক। ২০০৬ সালে পাড়ি দেন দুবাইয়ে। অনেক কিছুই বদলে গেছে তার। এখন অঢেল বিত্ত–ভৈববের মালিক। ইয়াবা ব্যবসার টাকার ভাগ–বাঁটোয়ারাকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে বিভিন্ন সময় মারামারি, হাতাহাতি লেগেই থাকে।
ইয়াবার পাশাপাশি বিশজনের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে স্বর্ণ পাচারের ব্যবসা। এদের প্রত্যেকেই কোটি টাকার মালিক। হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন হয় স্বর্ণ পাচারের টাকা। রিয়াজউদ্দিন বাজার, তামাকুমন্ডি লেইন এলাকায় বিভিন্ন মার্কেটে কক্ষ ভাড়া নিয়ে অবৈধ স্বর্ণের গুদাম বানিয়েছে চোরাচালানিরা। বিমানবন্দর দিয়ে আসা চোরাচালানের স্বর্ণ প্রথমে এসব গুদামে জমা হয়। এরপর সেখান থেকে দেশের বাজারে যায় এবং বিদেশে পাচার হয়।
পুলিশ জানতে পেরেছে, রিয়াজউদ্দিন বাজারকেন্দ্রিক দুটি চোরাচালান সিন্ডিকেট এই অবৈধ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। তারাই মূলত রিয়াজউদ্দিন বাজারে গুদাম ভাড়া নিয়ে গড়ে তুলেছে অবৈধ স্বর্ণের ভান্ডার। এর মধ্যে একটির নেতৃত্ব দেন ব্যবসায়ী আবু আহম্মেদ। আরেকটিতে নেতৃত্ব দেন হাকিম ও সাত্তার নামে দুজন।
গোয়েন্দা সূত্রমতে, অবৈধভাবে বিদেশি যত সিগারেট চট্টগ্রামে আসে, তার বড় অংশের মজুদ হয় রিয়াজউদ্দিন বাজারে। সরেজমিন বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারের ২০ থেকে ২৫টি দোকানে প্রকাশ্যেই এসব সিগারেটের বেচাকেনা চলছে। প্রতিটি দোকানে প্রতিদিন গড়ে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার বিদেশি সিগারেট বেচাকেনা হয়। এই হিসাবে প্রতিদিন এ বাজারে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকার বিদেশি সিগারেট বিক্রি হচ্ছে। মাসে বিক্রি হচ্ছে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এসব দোকানের একটিতেও নাম লেখা নেই। কিন্তু সাজানো আছে অর্ধশতাধিক ধরনের বিদেশি সিগারেট। বন্দরের কর্মকর্তা ও পুলিশের সঙ্গে যোগসাজশে দোকানদাররা এই কাজটি করে থাকেন বলে অভিযোগ আছে। এসব চোরাই সিগারেট কেনাবেচার নির্দিষ্ট কিছু লোক আছে। ফোন করে খবর দিলেই তারা এসে দোকানে দোকানে সিগারেট দিয়ে যায়। খুচরা বিক্রেতাদের এসব সিগারেট কিনতে বা বেচতে ঝক্কি পোহাতে হয় না।