অলিম্পিক বিস্কুটের পরিবেশক কে এম ফোরকানের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করত তিন শিশু। বেতন কমসহ নানা কারণে বনিবনা হচ্ছিল না দেখে তারা চাকরি ছেড়ে দেয়। এতে চটে গিয়ে ছুরি ধরে টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগ তুলে তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা টুকে দেন কে এম ফোরকান।
এদিকে তদন্ত করতে গিয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তাও রেহাই দিলেন না তিন শিশুকে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে মর্মে আদালতে তিন শিশুর বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করে দেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় মামলা বিচারে গেলে এবং সাক্ষ্যগ্রহণ ও যুক্তিতর্ক কার্যক্রম শেষ হলে বিচারক উক্ত মামলার রায় ঘোষণা করেন এবং তিন শিশুকে খালাস দেন। সেই রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে অবুঝ, নিরপরাধ তিন শিশুকে ফাঁসানোর এ গল্প। নিরপরাধকে ফাঁসানো যেহেতু অপরাধ সেই বোধ থেকে আদালত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করবে না তা তো হতে পারে না। আদালতের বিচারক নিজে বাদী হয়ে কে এম ফোরকান এবং তার ছেলে (সাক্ষী) ইফতেখার হোসেনের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট–১ এ মামলা দায়ের করেন। অন্যদিকে তদন্ত কর্মকর্তা ও পাঁচলাইশ থানার এসআই কাজী মাছুমের রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনারকে নির্দেশ দেন।
আদালত সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার কে এম ফোরকান ও তার ছেলের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়ের ও সাক্ষ্য দেওয়ার অভিযোগে চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট–১ এ চট্টগ্রামের শিশু আদালত ও নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল–৭ এর বিচারক ফেরদৌস আরা উক্ত মামলাটি দায়ের করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, নগরীর পাঁচলাইশের হামজারবাগ হিলভিউ এলাকার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ২০২০ সালের ২২ জুলাই বাসায় ফিরছিলেন কে এম ফোরকান। তখন তার সাথে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪৮৮ টাকাসহ একটি ব্যাগ ছিল। এসময় তিন শিশুসহ অপর একজন ছুরির ভয় দেখিয়ে তার কাছ থেকে টাকার ব্যাগটি ছিনিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। তা দেখে স্থানীয়দের হাতে তিন শিশুর একজন আটক হয়। এরপর পুলিশ এসে তার পকেট থেকে ছুরি উদ্ধার করা হয় সংক্রান্ত অভিযোগে কে এম ফোরকান পরদিন ২৩ জুলাই তিন শিশুর বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। বিচার চলাকালে তিনি ও তার ছেলে অর্থাৎ ইফতেখার হোসেন উক্ত এজাহারের স্বপক্ষে যথাক্রমে ২০২৩ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ও চলতি বছরের ৬ মে সাক্ষ্য প্রদান করেন। একপর্যায়ে গত ২৪ জুন এ মামলার রায় ঘোষণা করা হয়।
রায়ের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে– ঘটনার পরপর ধাওয়া করে যে শিশুকে আটকের কথা বলা হয়েছে তার কাছ থেকে ছিনতাইকৃত টাকার ব্যাগটি পাওয়া যায়নি। তাকে হাতেনাতে আটক করার পরও কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়া ২৪ ঘণ্টা বিলম্বে মামলা দায়ের করা হয়েছে। ঘটনার সময় এজাহারকারী তথা কে এম ফোরকান আহত হয়ে বাম হাতের কনুইতে ও বাম পায়ের আঙ্গুলে জখমপ্রাপ্ত হয়ে চিকিৎসা গ্রহণের দাবি উত্থাপিত হলেও সে সংক্রান্ত মেডিকেল রিপোর্ট প্রদর্শিত হয়নি। শিশুরা তার কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও এজাহারে তা গোপন রাখা হয়েছে। ঘটনা ও পারিপার্শ্বিকতা বিষয়ে কে এম ফোরকান ও তার ছেলে ইফতেখার হোসেনের আদালতে দেওয়া সাক্ষ্য পরস্পর বিরোধী প্রমাণিত হয়েছে। ঘটনার বিষয়ে কোনো নিরপেক্ষ সাক্ষী ছিল না। মূলত তিন শিশু এজাহারকারীর কর্মচারী থাকাকালে কম বেতন ও এজাহারকারীর রাগারাগির কারণে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়েছে। তদন্তকারী কর্মকর্তা তদন্তের অস্বাভাবিকতা এবং ঘটনা ও পারিপার্শ্বিকতা একত্রে বিবেচনা করেননি। এজাহারকারী তদন্তকারী কর্মকর্তার সহায়তায় নিজ কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ তুলে মামলা দায়ের করেছেন এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা এজাহারকারী দ্বারা অন্যায়ভাবে প্রভাবিত হয়ে তিন শিশুর বিরুদ্ধে অগ্রহণযোগ্য ও ভিত্তিহীন দোষীপত্র দাখিল করেছেন। এছাড়া এজাহারকারী ও তার ছেলে এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে উক্ত বিষয়ে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করেছেন।
আদালতসূত্র জানায়, মিথ্যা মামলা দায়ের ও সাক্ষ্য দেওয়ার অভিযোগে বাবা–ছেলের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পাশাপাশি তদন্ত কর্মকর্তা কাজী মাছুমের রহমানের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে আদালতের পক্ষ থেকে সিএমপি কমিশনার বরাবর চিঠি দেওয়া হয়েছে। মামলার নথি, দোষীপত্রসহ সাক্ষীদের সাক্ষ্য বিশ্লেষণে মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে তদন্তকারী কর্মকর্তার অদক্ষতা ও দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে উল্লেখ করে সেই চিঠিতে বলা হয়, তিন শিশুর একজনের স্বীকারোক্তি ও দেখানো মতে অপর দুই শিশুকে তাদের বাড়ি থেকে আটক করার কথা বলা হলেও উক্ত দুই শিশুর কাছ থেকে ছিনতাইয়ের কোনো আলামত উদ্ধার হয়নি। এ অবস্থায় দুই শিশুকে ঘটনার সাথে জড়িত মর্মে অন্তর্ভুক্ত করার কোনো আইনগত সুযোগ ছিল না।
আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে বলা হয়েছে– তিন শিশুর একজনকে আটকের সময় তার ঘরের দরজা খোলা ছিল এবং সে তার ঘরে বসা অবস্থায় ছিল। কিন্তু দাবি অনুযায়ী উক্ত শিশু ঘটনাস্থল থেকে পালিয়েছিল। এ অবস্থায় একজন পালিয়ে যাওয়া আসামি ঘরের দরজা খোলা রেখে ঘরে বসে থাকার বক্তব্য বাস্তবতা বিবর্জিত ও অগ্রহণযোগ্য। এছাড়া এজহারের বর্ণনা অনুযায়ী ঘটনার পর স্থানীয়রা তিন শিশুর একজনকে ছোরাসহ আটক এবং পুলিশ এসে জব্দ তালিকা প্রস্তুত করে অস্ত্র উদ্ধারের কথা বলা হয়। কিন্তু জব্দ তালিকা পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ঘটনার দিন রাত ১১টার সময় জব্দ তালিকা প্রস্তুত দেখানো হলেও পরবর্তীতে তার স্থলে ওভার রাইটিং করা হয়। রাত ১১টার স্থলে রাত ১০টা উল্লেখ করা হয়। যা সন্দেহজনক। তদন্ত কর্মকর্তার আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে ও এজাহারে রাত সাড়ে ১০টায় তিন শিশুর একজনকে এবং অপর দুই শিশুকে ঘটনার রাতে আটকের বর্ণনা রয়েছে। মামলা হয়েছে ঘটনার পরদিন সকাল সাড়ে ১০টায়। ফলে কোনো জিডি ছাড়া মধ্যবর্তী ১২ ঘণ্টা অভিযুক্ত শিশুদেরকে কিভাবে আটক রাখা হলো তার যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায় যায়নি। এছাড়া ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আটক শিশুদের আদালতে উপস্থাপনের সুযোগ থাকলেও তা করা হয়নি। তদন্তকারী কর্মকর্তা আটক শিশুদের যৌক্তিক কারণ ছাড়া ২৪ ঘণ্টার অধিক সময় নিজ হেফাজতে রেখেছিলেন।
চট্টগ্রামের শিশু আদালত এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুনাল–৭ এর বেঞ্চ সহকারী কফিল উদ্দিন দৈনিক আজাদীকে বলেন, কে এম ফোরকানের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ছিল তিন শিশু। আদালতে দেওয়া সাক্ষ্যে ফোরকান ও তার ছেলে তা স্বীকার করেছে। অথচ সরেজমিনে তদন্তকালে তদন্তকারী কর্মকর্তা কর্তৃক তা উদঘাটন করা বা জানা স্বাভাবিক ছিল। এছাড়া ঘটনার বিষয়ে কোনো প্রত্যক্ষদর্শী ও নিরপেক্ষ সাক্ষী না থাকা সত্ত্বেও এবং ঘটনাস্থল থেকে আটককৃত শিশুর দখল থেকে কথিত ছিনতাই হওয়া টাকা উদ্ধার না হওয়া সত্ত্বেও তদন্তকারী কর্মকর্তা মিথ্যা ও ভিত্তিহীন দোষীপত্র দাখিল করেছেন। এজাহারকারীর মাধ্যমে অন্যায়ভাবে প্রভাবিত হয়ে তিনি এ কাজ করেছেন। যার দায়ভার পুরোপুরি তদন্তকারী কর্মকর্তার উপর বর্তায়। কেননা যেকোনো ব্যক্তির দায়েরকৃত অভিযোগের সত্যতা নিরূপনের জন্যই তদন্তকারী কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়।
বেঞ্চ সহকারী বলেন, এজাহারকারীর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন তদন্ত রিপোর্ট দাখিল এবং দোষীপত্রের স্বপক্ষে শপথ গ্রহণপূর্বক মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান করা দণ্ডবিধির ১৭৭ ও ১৮১ ধারার অপরাধ। উক্ত অপরাধে তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়েরের সুযোগ থাকলেও একটি সুশৃক্সখল বাহিনীর সদস্য হওয়ায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেয়া যৌক্তিক মনে করেছেন বিচারক।
চট্টগ্রামের মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট–১ এর বেঞ্চ সহকারী আবুল হাশেম দৈনিক আজাদীকে বলেন, মিথ্যা মামলা দায়ের ও সাক্ষ্য দেওয়ার অভিযোগে দায়ের করা মামলাটি আমলে নিয়ে বিচারক দুই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।