রাষ্ট্র সংস্কারে মৌলিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়

ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী | শনিবার , ৩১ আগস্ট, ২০২৪ at ৪:৫০ পূর্বাহ্ণ

২৫ আগস্ট ২০২৪ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শান্তিতে নোবেল জয়ী বরেণ্য অর্থনীতিবিদ সর্বজনশ্রদ্ধেয় ইউনূস স্যারের ভাষণ ছিল অভূতপূর্ব আশাজাগানিয়া। গভীর তাৎপর্যের সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানের আলোকে প্রতিফলিত হয়েছে রাষ্ট্রীয় আদর্শ। গণতান্ত্রিকউদারঅসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার অসাধারণ সমীকরণে ভাষণটি ছিল সর্বজন সমাদৃত। মহান ব্রত নিয়ে ছাত্রজনতার বিপুল প্রাণ বিসর্জনে সংঘটিত হয়েছিল যুগান্তকারী গণঅভ্যুত্থান। বিগত সরকারের সকল প্রকার অসঙ্গতিকে সমূলে উৎপাটন করে নতুন চেতনায় সমৃদ্ধ দেশ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ভাষণে সুস্পষ্ট। রাষ্ট্র মেরামতের প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং অর্থবহ টেকসই সাফল্য অর্জনের লক্ষ্যে দেশবাসীকে ধৈর্য ধরার আহ্বান ছিল অনবদ্য। যৌক্তিক সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান ও জনপ্রতিনিধিমূলক সরকার গঠনে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টিও উল্লেখযোগ্য। শিক্ষাস্বাস্থ্যকৃষিপরিবেশব্যাংকিংবিচার বিভাগঅবাধ তথ্য প্রবাহআইনশৃঙ্খলাসহ রাষ্ট্রের সকল খাতকে পরিশুদ্ধ ব্যবস্থায় উন্নীত করাই সরকারের প্রকৃত উদ্দেশ্য হিসেবে বিবেচ্য।

নতুন প্রজন্মের নতুন এক বাংলাদেশ গড়ার গভীর আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টায় তিনি দেশের বয়সপেশাদলমতধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে বিনা দ্বিধায় এই সংগ্রামে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান। ছাত্রজনতার প্রত্যাশিত বৈষম্যশোষণহীন, কল্যাণময় এবং মুক্ত বাতাসের রাষ্ট্রের স্বপ্নপূরণে তিনি অঙ্গীকারবদ্ধ। দেশে গণতন্ত্র সুসংহতকরণে ভাষণে তাঁর চমৎকার অভিব্যক্তি প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বলেন, ‘গণতন্ত্রকে সুসংহত করতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করা হবে। ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানকে সফল পরিণতি দিতে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনি ব্যবস্থা, আইনশৃঙ্খলাখাত এবং তথ্য প্রবাহে প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পূর্ণ করে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করা হবে। এর লক্ষ্য হবে দুর্নীতি, লুটপাট ও গণহত্যার বিরুদ্ধে একটি জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সূচনা।’

ভাষণের শেষভাগে তিনি আরও বলেন, ‘নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে সুযোগ ছাত্রজনতার রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করলাম, আমরা আমাদের মতানৈক্যের কারণে সেটা যেন হাতছাড়া না করে ফেলি এটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। এ সুযোগ এবার হারিয়ে ফেললে আমরা জাতি হিসেবে পরাজিত হয়ে যাব। শহীদ, আহত ও জীবিত ছাত্রজনতার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে চাই আমরা এ অর্জনকে কিছুতেই হারিয়ে যেতে দেব না। যে সুযোগ তারা আমাদের দিয়েছে তার মাধ্যমে আমাদের দেশকে পৃথিবীর একটি শ্রদ্ধেয়, সব দিকে দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী দেশে পরিণত করতে আমরা শপথ নিয়েছি।’

আমাদের সকলের জানা, দ্বিজাতিত্বত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর ভিত্তি স্থাপিত হলেও অর্থরাজনৈতিক নির্মম বৈষম্য সৃষ্টি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর মূল লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্যকে পরিপূর্ণতাদানে সুনিপুণ নষ্ট পরিকল্পনায় তারা ধর্মকেই শোষণের ঢাল হিসেবে বেছে নিয়েছিল। কিন্তু বাঙালি আদিকাল থেকেই ঐতিহ্যিক চেতনায় ধর্মান্ধকে বর্জন ও ধার্মিকতাকে গ্রহণ করার মাধ্যমেই মানবিকগণতান্ত্রিকঅসাম্প্রদায়িকতার শ্বাশত বৈশিষ্ট্যকে ধারণলালন করে জাতির ঐক্যবদ্ধতায় অবিজ্ঞেয় আলোয় একাশ্রিত হয়। সমাজ সংস্কৃতির বিকাশ আবরণে ধর্ম আপেক্ষিক কোন বস্তু হিসেবে নয়, সনাতনিক নিয়ম বা স্বাভাবিক সহজ সরল মানবিক বৃত্তিকে গঠন করার প্রক্রিয়ায় এর ভূমিকা সাবলীল অবারিত ও চিরঞ্জীব। বিভিন্ন সূত্রমতে বর্তমানে বিশ্বে প্রায় দুইশত সত্তরটি শাখাপ্রশাখা ও সমপ্রদায়ে বিভক্ত উনিশটি প্রধান ধর্মমত প্রচলিত আছে। এইচ.পি. বেকার’র মতে অসাম্প্রদায়িক প্রত্যয়টি অপবিত্র, পাপী, ঈশ্বরহীন, বিধর্মী ইত্যাদির সমার্থক নয়। বরং স্ব স্ব ধর্মের প্রতি নিজস্ব শ্রদ্ধাবোধ ও বিশ্বাসের সাথে অন্য ধর্ম ও ধর্মাবলম্বীদের প্রতি যুক্তি ও প্রায়োগিক বিবেচনায় সৌহার্দ, সম্প্রীতি ও বন্ধুত্বের বিনিময়ে ছন্দোবদ্ধ হয় মানবিক নির্যাস।

বাংলার সামাজিক ইতিহাসের অপ্রতুলতা, বস্তুনিষ্ঠ তথ্যপ্রবাহ ইত্যাদি এই অসামপ্রদায়িক সম্পর্কের স্বরূপ নির্ণয়ে অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছে। বস্তুতপক্ষে অজানাকে জানার আগ্রহ, প্রোথিত অনুভূতি এবং অদম্য ইচ্ছার বস্তুনিস্ট নিয়ামক হিসেবে আদর্শগত সমাজ উদ্ভূত উপাদান হচ্ছে শুভসত্য ও সুন্দরের পরিপূরক বিকিরণ। পবিত্র ইসলাম ধর্মে নানমূখী অপসংস্কৃতি বা সন্ত্রাসবর্বরতানৃশংসতাহত্যাপ্রতিহিংসাপরায়ণতাকে উম্মাদিত করা কোনভাবেই সমর্থনপুষ্ট নয়। ইসলাম ধর্মের নিগূঢ়তম পবিত্রতামানবিকতাসর্বজনীনতানান্দনিকতাসৃজনশীলতাঅগ্রসরমানতা এবং সর্বোপরি শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতি অবিচল কল্যাণ প্রবৃত্তিকে বিনষ্টবিভ্রান্তকলুষিত করার অব্যাহত অপচেষ্টাঅপকৌশল সম্পূর্ণরূপে পবিত্র ইসলামকোরআনসুন্নাহ্‌র পরিপন্থী।

প্রকৃত অর্থে ধর্ম মানব চেতনার সমপ্রসারিত রূপ। তবে এটি সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের ব্যাপার হলেও নীতিনৈতিকতার ভিত্তিতে সমাজকে পরিশুদ্ধ করার অপূর্ব নিয়ামক। মানবাধিকার ঘোষণার ১৮ অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে ‘প্রত্যেক মানবের তার স্বাধীন চিন্তা, বিবেক ও ধর্ম বিশ্বাসের অধিকার আছে। এই অধিকারের মধ্যে সংশ্লিষ্ট আছে ধর্ম ও বিশ্বাস পরিবর্তনের স্বাধীনতা এবং একক বা যৌথভাবে ব্যক্তিগত বা গোষ্ঠীগতভাবে তার ধর্ম বা বিশ্বাসের শিক্ষা, প্রথা, উপাসনা ও আচারণ জনসমক্ষে ব্যক্ত করার অধিকার। স্মরণ রাখতে হবে, অন্যতম সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘ সনদের ৫৫ ও ৫৬ অনুচ্ছেদে উল্লেখিত মূলনীতি একক ও যৌথভাবে পালন করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।

সাধারণত একটি ভৌগোলিক ভূখন্ডের জনগণ স্বাধীনতা ও সমতার ভিত্তিতে আপন জনজীবন, রাজনীতিক, অর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ন্ত্রণ করবে এবং সেখানে সকলের সমান অধিকার থাকবে, কেউ বেশি, কেউ কম অধিকারী হবে না ধর্ম, বর্ণ ও মতবাদের জন্য। এর চালিকা আত্মিক ভাবধারা হচ্ছে মানবতাবাদ। একটি বিশেষ ভূখন্ডের জনগোষ্ঠী এই ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে জাতির মনন ও ঐতিহ্যের নিরন্তর পথ পরিক্রমা নির্মাণ করে। এই সার্বিক ভাবধারাকে কোন ধর্ম, বর্ণ বা বিশেষ মতবাদের দ্বারা বিভাজিত করলে যা দাঁড়ায় তা হল সামপ্রদায়িকতা। যে কোন ধরনের পারস্পরিক নিন্দার্হ আচরণকে পরিহার করে অন্যের মঙ্গলে আত্মনিবেদনের মধ্যেই প্রকৃত অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতার জয়গান।

পক্ষান্তরে উদারনৈতিক গণতন্ত্র বলতে এমন একটি সংকীর্ণতামুক্ত আদর্শকে বোঝায় যেখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতাকে স্বীকৃতিদানে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উপাদানও সংশ্লিষ্ট। সপ্তদশ শতাব্দী উদারনৈতিক গণতন্ত্রের সূচনাকাল হিসেবে পরিগণিত। ধারণা করা হয় যে, জন স্টুয়ার্ট মিলের পূর্ববর্তী সময়ে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের দার্শনিকরা যে গণতন্ত্রের প্রচার করেন তা সাবেকি গণতন্ত্রের রীতি নামে পরিচিত। কিন্তু জন স্টুয়ার্ট মিলের পরবর্তীকালে প্রচারিত গণতন্ত্রকে বলা হয় আধুনিক গণতান্ত্রিক রীতি। উদারনৈতিক গণতন্ত্রের মূল বৈশিষ্ট্য হল রাজনৈতিক সাম্যের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা। এই ধরনের গণতন্ত্রে সংবিধানও গণতান্ত্রিক হয়ে থাকে। কারণ আপামর জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা সংবিধান দ্বারাই সম্ভব। গণতান্ত্রিক সংবিধানে স্বীকৃত হয় জাতিধর্মবর্ণনারীপুরুষ বা ধনীদরিদ্রের সমান অধিকার। এ ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভোটে যে সরকার গঠিত হয় সেই সরকারকে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকার বলা যায় না। সেটি নিয়োজিত থাকে সকল ব্যক্তির কল্যাণে। কিন্তু সরকার জনকল্যাণবিরোধী কোনো কাজ করলে জনগণ নির্বাচনের মাধ্যমে সেই সরকারের পরিবর্তন করে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। এর অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে রয়েছেসংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনব্যবস্থা, সংখ্যালঘুর অধিকারের স্বীকৃতি, শাসনতন্ত্রের প্রাধান্য, নিরপেক্ষ আদালতের প্রাধান্য, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও ভোটদানের স্বীকৃতি।

বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান সুরক্ষা পাওয়ার অধিকারী।’ অনুচ্ছেদ ২৮ অনুসারে শুধুমাত্র ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ বা জন্মস্থানের ভিত্তিতে রাষ্ট্র কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করবে না এবং রাষ্ট্র ও জনজীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীপুরুষের সমান অধিকার থাকবে। অনুচ্ছেদ ২৯ অনুযায়ী সাংবিধানিক বিধান রয়েছে যা ধর্মের ওপর ভিত্তি করে যে কোনো ধরনের বৈষম্যকে নিষিদ্ধ করে। দেওয়ানি এবং ফৌজদারি কার্যবিধিতে জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিকের জন্য সমান অধিকার প্রদান করে যে কোনো ধরনের বৈষম্য বা সহিংসতার বিরুদ্ধে ব্যক্তিকে রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বৈষম্য এখনও সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গভীর অনুভূত। রাজনীতিঅর্থনীতিসংস্কৃতিশিক্ষাপ্রশাসনপ্রতিরক্ষাসহ সকল ক্ষেত্রে নাগরিকবৃন্দ প্রতিক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সকল দমনপীড়ননিপীড়ননির্যাতনমানবাধিকার লঙ্ঘন ও শোষণবঞ্চনার বিরুদ্ধে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থান শিক্ষণীয় নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। এই আন্দোলনের সকল শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল হয়ে তরুণদের নেতৃত্বে নতুন ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে সকলকেই ব্রতী হতে হবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হবু উপাচার্যের করণীয় ও প্রাসঙ্গিক আলোচনা
পরবর্তী নিবন্ধওয়েব ফিল্মে মেহজাবীনের নায়ক ইয়াশ রোহান!