মিষ্টি এবং বেকারি পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিজলের চেয়ারম্যান লায়ন আলহাজ্ব মোহাম্মদ নুরুল আলমকে আমরা অভিনন্দন জানাতে চাই। কেননা তিনি তাঁর নিজের কারখানা এবং শোরুমে ৫০ জন বোবা এবং ট্রান্সজেন্ডারকে (রূপান্তরিত নারী) নিয়োগ দিতে চান। দৈনিক আজাদী সম্পাদক মোহাম্মদ আবদুল মালেকের প্রকাশিত ‘তারাও করবে জয়’ শীর্ষক লেখা পড়ে তিনি এ উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর এ মানবিক উদ্যোগ সমাজের জন্য হবে বড় দৃষ্টান্ত। গত ১৬ মার্চ দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে মোহাম্মদ নুরুল আলম বলেন, ১৯৯৭ সালে সিজল যাত্রা শুরু করে। প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ দিনে সিজল বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগরীর পাশাপাশি জেলা পর্যায়েও বেশ কিছু শোরুম পরিচালনা করে। বেশ কয়েকটি কারখানায় সিজল নিজেদের মিষ্টি ও বেকারি পণ্য উৎপাদন করে। এসব শোরুম ও কারখানাতে এক হাজারেরও বেশি মানুষ কাজ করেন। এদের মধ্যে প্রতিটি শোরুমে একজন করে এবং কারখানাগুলোতে পাঁচ সাতজন করে বোবা ও তৃতীয় লিঙ্গের লোকের চাকরি দেয়ার সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক সমাজের অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে পরিণত করার একটি পথ বাতলে দিয়েছেন। ওই পথ ধরেই আমি অন্তত ৫০ জন মানুষকে চাকরি দিতে চাই। তিনি বলেন, বোবা কিংবা তৃতীয় লিঙ্গের লোকদের একটু প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে অনায়াসে মূল স্রোতের লোকবলে পরিণত করা যাবে।
বাংলাদেশে প্রায় চার কোটি পরিবার আর তার প্রায় ১৮ কোটি মানুষ নিয়ে আমাদের গর্বের সমাজ এবং ৫০ বছরের একটি রাষ্ট্র। করোনাকালীন সময়ে এই ভিত্তি বা স্তম্ভকে কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় আমরা ফিরে পেয়েছি তা ইতিমধ্যে বোধগম্য হয়েছে হয়তোবা। বলতে পারি, মানবিক সমাজ, সংসার এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে যদি আমরা অগ্রসর হতে না পারি, তাহলে আমাদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়।
সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, বাংলাদেশের এই ভূখণ্ডের সমাজব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল কয়েক হাজার বছর আগে অসংখ্য সামাজিক মূল্যবোধ, দৃষ্টিভঙ্গি আর অপার সাংস্কৃতিক মিশ্রণে, যা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে। আর এই সামাজিক সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের ভিত্তির ওপর গড়ে উঠেছে আমাদের সাংসারিক পারিবারিক সামাজিক পরিবন্ধন।
এই সংসার পারস্পরিক সম্মান, শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় পরিপূর্ণ, তা হোক যৌথ কিংবা একক পরিবার। আর এটাই এদেশের মানুষের শিকড়। আমরা বিশ্বাস করি কিংবা করতে চাই, আমরা সবসময়ই সমাজ কিংবা পরিবার কেন্দ্রিক, কখনই ব্যক্তি কেন্দ্রিক না। আমরা মানবিক এবং পারস্পরিক সম্পর্কে বা প্রয়োজনে নিবেদিত।
মানবিক পরিবার, পারিবারিক মূল্যবোধ এবং ভালবাসায় গড়ে ওঠা সম্পর্ক আমাদেরকে উদ্দীপ্ত করে সবসময় সবখানে। চরম খাটনির পরে বাবা-মা কিংবা সন্তান-স্ত্রী-স্বামীর হাসিমুখ খানা আমাদের প্রজ্বলিত করে। সম্পর্কগুলোএমনই ভালবাসায় মজবুত হয়েছে। তার সঙ্গে জড়িত সমাজের মানুষ। এদের যদি মানবিক দৃষ্টিকোণে বিচার করা যায়, তাহলে রাষ্ট্রও হবে মানবিক। আর এ মানবিক সমাজ গড়ে তোলার জন্য তারুণ্যের শক্তি ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। এদের কাজে লাগিয়ে দেশ ও সমাজকে বদলে দিতে হবে। তাই যুব সমাজের চরিত্র গঠন, তাদের মাঝে নৈতিক চেতনা ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করার উদ্যোগ নেওয়াও জাতীয় কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে রাখা দরকার, যুব সমাজ জাতির ভবিষ্যৎ কর্ণধার। কিন্তু জাতির ভবিষ্যৎ এ যুব সমাজের একটি অংশ হতাশা ও নেশাগ্রস্ত হয়ে খুন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। ভুলে গেলে চলবে না যে যুব সমাজের শিক্ষা, যোগ্যতা ও কর্ম তৎপরতার ওপর নির্ভর করে একটি জাতির ভবিষ্যৎ। যুব সমাজের সৃজনশীলতায় দেশকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে বহুমাত্রিক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হবে। যুব সমাজকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দিয়ে ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখিয়ে সৎচরিত্রবান কর্মঠ আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এতে রাষ্ট্রের পাশাপাশি পরিবার ও সচেতন মহলের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। সিজলের মতো যদি অন্যান্য ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানও এভাবে অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে পরিণত করার কাজে এগিয়ে আসে, তাহলে অনেক লোকের কর্মসংস্থান হবে। সমাজে অপাংক্তেয় হিসেবে পরিগণিত মানুষরা পাবে তাদের যোগ্য সম্মান। আমরা এমন মানবিক উদ্যোগে সক্ষম ব্যক্তিদের শামিল হওয়ার আহ্বান জানাই।