রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগের আল্টিমেটাম

শহীদ মিনারে বিক্ষোভ সমাবেশ, বঙ্গভবনে ঢোকার চেষ্টা সংবিধান বাতিল, ছাত্রলীগ নিষিদ্ধসহ ৫ দাবি

আজাদী ডেস্ক | বুধবার , ২৩ অক্টোবর, ২০২৪ at ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন মিথ্যাচার করেছেন অভিযোগ তুলে এ সপ্তাহের মধ্যে তার পদত্যাগের দাবিতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষোভ ও সমাবেশ হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকাল ৩টা থেকে বিভিন্ন ব্যানার নিয়ে দলে দলে শহীদ মিনারে জড়ো হন আন্দোলনকারীরা। সেখানে সমাবেশে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ও সংবিধান বাতিলসহ পাঁচটি দাবি তুলে ধরেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। এদিকে গতকাল আন্দোলনকারীদের একটি পক্ষ দিনভর বঙ্গভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগের সময় বেঁধে দেয়। সন্ধ্যার পর তাদের একটি পক্ষ বঙ্গভবনের সামনে ব্যারিকেড ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে বাধা দেয়। এ সময় দুই শিক্ষার্থীসহ তিনজন আহত হন। খবর বিডিনিউজের।

বৈষম্যবিরোধী চিকিৎসক ও স্টুডেন্ট পরিষদ, জাতীয় নাগরিক কমিটি, ঢাকা মহানগর, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, মিরপুর লেখা সম্বলিত ব্যানার নিয়ে শহীদ মিনারে সমবেত হন আন্দোলনকারীরা। তারা রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ চেয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন। সমাবেশ শেষে তারা বিকাল ৫টায় মিছিল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘুরে রাজু ভাস্কর্যের সামনে যান।

শহীদ মিনারে সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, আমরা এই শহীদ মিনার থেকে বিপ্লব শুরু করেছিলাম। সেই বিপ্লবের ভয়ে বাংলাদেশ থেকে পালিয়েছিলেন ফ্যাসিস্ট হাসিনা। আর এখন আপনি রাষ্ট্রপতি হিসেবে জনতার সঙ্গে প্রতারণা করছেন। আপনি ৫ আগস্টে যা বলেছেন, তা এখন কার নির্দেশে ভুলে গিয়ে নতুন কথা বলছেন? আমরা স্পষ্ট বলে দিতে চাই, খুনি হাসিনা যেভাবে পালিয়েছে, চুপ্পুকেও পালাতে হবে। দেশের প্রশ্নে, দশের প্রশ্নে বিপ্লবীরা সবসময় মাঠে আছে। ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করে আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন মাসউদ। তার ভাষ্য, যে ছাত্রলীগের হাতে মানুষের মৃত্যু হয়েছে তাদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।

সমাবেশে ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ পাঁচটি দাবি ঘোষণা করেন। এগুলো হলো : . বিদ্যমান সংবিধান অনতিবিলম্বে বাতিল করে ২৪এর গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে নতুন সংবিধান লেখা। ২. ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে এই সপ্তাহের মধ্যে আজীবন নিষিদ্ধ করতে হবে। ৩. রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে এই সপ্তাহের মধ্যে পদত্যাগ করতে হবে। ৪. চলতি সপ্তাহের মধ্যে জুলাই বিপ্লবের আলোকে ‘প্রোকলেমেশন অব রিপাবলিক’ ঘোষণা করতে হবে। বাংলাদেশের বিদ্যমান গণতন্ত্রকামী ক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলের মতের ভিত্তিতে বাংলাদেশ চলবে। ৫. দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করতে হবে। এই তিন নির্বাচনে যারা নির্বাচিত হয়েছে, তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করতে হবে এবং তারা যেন কখনও বাংলাদেশে নির্বাচন করতে না পারে, সেজন্য আইনি ব্যবস্থা নেওয়া।

হাসনাত বলেন, এই সপ্তাহের মধ্যে আমাদের পাঁচ দফা দাবি না মানা হলে আমরা আবার রাজপথে নেমে যাব। সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সারজিস আলম, নুসরাত তাবাসসুম, আবু বাকের মজুমদার, রিফাত রশীদও বক্তব্য দেন।

বঙ্গভবনের সামনে অবস্থান : বঙ্গভবন ঘেরাও কর্মসূচি থেকে রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগের জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছে শিক্ষার্থীদের কয়েকটি সংগঠন। ওই সময়ের মধ্যে মো. সাহাবুদ্দিন রাষ্ট্রপতির পদ না ছাড়লে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।

রক্তিম জুলাই ২৪, স্বাধীনতাসার্বভৌমত্ব রক্ষা কমিটি, বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতা, ইনকিলাব মঞ্চসহ বিভিন্ন ব্যানারে গতকাল দুপুর থেকে শিক্ষার্থী ও জনতা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে রাজউকের সামনের মোড়ে অবস্থান নেয়। পরে বিকাল সাড়ে ৪টায় বঙ্গভবনের সামনের থেকে ছাত্র জনতার পক্ষে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে রাষ্ট্রপতিকে পদত্যাগ করার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দেন এমদাদ বাবু।

রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দোসর আখ্যায়িত করে এমদাদ বাবু বলেন, আমরা পরীক্ষিত সৈনিক, সম্মুখ যোদ্ধা। আমরা সংগ্রাম করতে গিয়ে হাতপাচোখ হারিয়েছি। যদি আরেকটা হাত পা চোখ দিতে হয় আমরা তাও দিতে প্রস্তুত আছি। রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের পাশাপাশি সংবিধান বাতিল, বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠন, আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলকে নিষিদ্ধ করারও দাবি জানানো হয় সমাবেশ থেকে।

এ কর্মসূচির কারণে বঙ্গভবন এলাকা জুড়ে কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশের পাশাপাশি সেনাবাহিনীর সদস্যদেরও দেখা যায় সেখানে। বঙ্গভবনের সামনে যাওয়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ঘণ্টাব্যাপী অবস্থান কর্মসূচি পালন করে স্বাধীনতাসার্বভৌমত্ব রক্ষা কমিটি (স্বারক)। সেখানে তারা রাষ্ট্রপতির অপসারণসহ ৪ দফা দাবি তুলে ধরেন। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে, ফ্যাসিবাদের দোসর অবৈধ রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা; সংবিধান বাতিল করা; বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠন করা এবং আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও ১৪ দলকে নিষিদ্ধ করা।

বঙ্গভবনে ঢোকার চেষ্টা : গতকাল আন্দোলনকারীদের একটি পক্ষ দিনভর বঙ্গভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগের সময় বেঁধে দেয়। সন্ধ্যার পর তাদের একটি পক্ষ বঙ্গভবনের সামনে ব্যারিকেড ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করতে চাইলে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাদেরকে বাধা দেয়।

এর কিছুক্ষণ পর পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে আসে। শিক্ষার্থীরা তখন তাদের ওপর চড়াও হয় বলে গণমাধ্যম ও সামাজিকমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা যায়। পুলিশও আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিপেটা করে। এ সময় সাউন্ড গ্রেনেডও ছোড়া হয়। সেখানে যাওয়া পুলিশের একটি গাড়িতে লক্ষ্য করে আন্দোলনকারীদের ইটপাটকেল ছুড়তে দেখা গেছে। গাড়িতে উঠে পুলিশকে লাঠি দিয়ে আঘাত করতেও দেখা যায়। রাতে এই প্রতিবেদন লেখার সময় মতিঝিল থানার সামনে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে একদল মানুষকে।

এদিকে বঙ্গভবনের সামনে অবস্থানরত দুই শিক্ষার্থীসহ তিনজন আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। আহতরা হলেন শ্যামপুর বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফয়সাল আহমেদ বিশাল, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী আরিফ খান এবং ফুটপাতের দোকানি শফিকুল ইসলাম সেলিম।

গতকাল রাত সাড়ে আটটার কিছুক্ষণ আগে এই ঘটনা ঘটে। পরে আহতদেরকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের আঘাত গুরুতর নয় বলে তথ্য মিলেছে। আহতদেরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া মেহেদী হাসান বলেন, তারা বঙ্গভবনে ঢুকতে গেলে পুলিশ সদস্যরা তাদের বাধা দেয় ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। এ সময় তারা আহত হন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ক্যাম্পের ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক বলেন, আঘাত গুরুতর নয়। তাদেরকে জরুরি বিভাগে অবজারভেশনে রাখা হয়েছে।

রাত ১০টার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসুদ ও আরিফ সোহেল বঙ্গভবনে যান। সেনাবাহিনীর মাইক নিয়ে আব্দুল হান্নান বিক্ষোভরত জমায়েতকে শান্ত করার চেষ্টা করলে উল্টো ফল হয়। পরে হান্নান ও আরিফ সোহেল বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে রাস্তার উপর বসে পড়েন।

প্রসঙ্গত, মানবজমিন পত্রিকার সম্পাদককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি বলেছিলেন শেখ হাসিনার কোনো পদত্যাগপত্র তিনি খুঁজে পাননি। পত্রিকাটির একটি ম্যাগাজিনে এই কথা প্রকাশ হওয়ার পর সরকার পতন আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করছে।

৫ আগস্ট গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারউজজামান বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে বলেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। সেই রাতে তিন বাহিনীর প্রধানকে পেছনে দাঁড় করিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণে রাষ্ট্রপতিও বলেন, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন। তিনি সেই পদত্যাগপত্র পেয়েছেন।

এর তিন দিন পর মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নেয় রাষ্ট্রপতির কাছেই। এর আড়াই মাস পর শেখ হাসিনার পদত্যাগ বিষয়ে নতুন বিতর্ক উঠেছে, যদিও বঙ্গভবন থেকে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে একে মীমাংসিত ঘটনা উল্লেখ করে বিতর্ক না করার আহ্বান জানানো হয়েছে।

আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তার বিবেচনায় রাষ্ট্রপতি ‘অসত্য’ বক্তব্য দিয়ে শপথ ভঙ্গ করেছেন। তাকে অপসারণ করা যায় বলেও মত দিয়েছেন তিনি। গতকাল প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং সংবাদ সম্মেলনে এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নে বলেছে, আইন উপদেষ্টার বক্তব্য সমর্থন করে সরকার। তবে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অবশ্য সংসদ বহাল না থাকায় রাষ্ট্রপতিকে সংবিধানসম্মত উপায়ে সরানোর উপায় আছে কিনা, এ নিয়ে প্রশ্ন আছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসেন্টমার্টিনে ভ্রমণের বিষয়ে নতুন সিদ্ধান্ত
পরবর্তী নিবন্ধভারতে পালানোর সময় বিনাজুরির সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার