রাত হলেই শুরু হয় কৃষিজমির মাটি ও হালদার পাড় কাটা

ফটিকছড়িতে দুষ্কৃতকারীরা সক্রিয়

ফটিকছড়ি প্রতিনিধি | বৃহস্পতিবার , ২৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ at ৬:৩১ পূর্বাহ্ণ

পরিবেশ আইন অমান্য করে ফটিকছড়ির বিভিন্ন এলাকায় রাতের আঁধারে এশিয়ার সর্ববৃহৎ মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীর পাড় এবং কৃষিজমির ঊর্বর মাটি কেটে সরবরাহ করে বিক্রি করছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং দুষ্কৃতকারীরা। অন্যদিকে দিনে দুপুরে চলে হালদা নদী, ধুরুং খাল, সর্তা খাল ও ফটিকছড়ি খাল থেকে ড্রেজার মেশিন এবং নৌকা দিয়ে বালু উত্তোলন।

এতে একদিকে ঊর্বর জমি বিলীন হচ্ছে, অন্যদিকে নদী ও খাল ভাঙনের আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা। এতে হুমকির মুখে পড়েছে হালদার জীববৈচিত্র্য, তেমনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্যও। রাতের অন্ধকার নেমে আসলেই উপজেলার বিভিন্ন জায়গায় মাটিভর্তি শতাধিক ট্রাক চলাচল শুরু করে। চলে রাতভর। মাটিবাহী এসব ট্রাকের প্রভাব পড়ছে সড়কগুলোতেও। মাটি ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য দিন দিন বেড়েই চলেছে।

সরেজমিনে পরিদর্শন করে এবং খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ফটিকছড়ি উপজেলার সুন্দরপুর ইউনিয়নের নাসির মোহাম্মদ ঘাটের বিপরীতে উত্তরে হালদার পাড়, নাজিরহাট পৌরসভা সুয়াবিল ইউনিয়ন পরিষদের সামনে, সুয়াবিল অংশের বিভিন্ন স্থানে, হারুয়ালছড়ি ইউপি, ভূজপুর ইউপিসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার কৃষি জমি থেকে রাতের আঁধারে অবাধে কাটা হচ্ছে মাটি। শুষ্ক মৌসুমে চলে এই ধরনের মাটিকাটা। সমপ্রতি তা বেড়েছে।

অন্যদিকে, পাইন্দং এলাকা এবং সুয়াবিল এলাকার হালদা অংশ, সর্তা খালের খিরাম অংশ, ধুরুং এবং ফটিকছড়ি খালে ড্রেজার মেশিন এবং নৌকা দিয়ে বালি উত্তোলন করা হচ্ছে।

মাটি দস্যুদের দৌরাত্ম্যে ফটিকছড়িতে আশঙ্কাজনক হারে ঊর্বরতা হারাচ্ছে ফসলি জমি। হুমকির মুখে পড়ছে নদীখাল। এ দস্যুরা রাতের আঁধারে সাবাড় করে দিচ্ছে ফসলি জমির ওপরের অতিগুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি সমৃদ্ধ মাটি (টপ সয়েল) এবং নদীর পাড়ের মাটি ও বালু।

মাটি ব্যবসায়ীদের লুট থেকে বাদ যাচ্ছে না মালিকানা জমি, খাসজমি, খাল ও নদীর পাড়।

গভীর গর্ত করে মাটি কেটে নেওয়ায় কৃষিজমি জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। জমিতে বোরো ধান আর মৌসুমী চাষ করা হতো। গভীর গর্ত করে মাটি কাটায় ওই সব জমিতে দিন দিন কমে যাচ্ছে ফসল উৎপাদন। ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।

এলাকাবাসী জানিয়েছে, উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন/ পৌরসভায় কৃষি জমির ‘টপ সয়েল’ এবং খালনদীর পাড়ের মাটি কেটে এবং অবৈধ বালু উত্তোলন করে চলছে রমরমা ব্যবসা। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী এবং স্থানীয় ক্ষমতাসীন মানুষ এ কাজে জড়িত। ফলে স্থানীয়রা এর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করতে পারেন না।

প্রশাসন বলছে, অভিযান চলছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র হলো, দিনে এবং মাঝেমধ্যে রাতে অভিযান চললেও মাটি ব্যবসায়ীরা বেছে নিচ্ছে রাতের আঁধার।

স্থানীয়দের অভিযোগ, মাটি পরিবহনে ব্যবহৃত ভারী যানবাহনগুলোর কারণে গ্রামীণ সড়কগুলো বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি হলেই তা পিচ্ছিল হয়ে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে সড়কগুলো নির্মাণ করলেও এসব কারণে সড়কের করুণ দশা হয়েছে। সৃষ্ট ধুলোবালিতে শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নাসির মোহাম্মদ ঘাটের এক যুবক বলেন, রাত নামলে শুরু হয় মাটি পাচার। ১০১২টি ড্রাম ট্রাক দিয়ে হালদার পাড় কেটে নিচ্ছে দুস্কৃতকারীরা। এদেরকে কিছু বলার সাহস কারো নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সুন্দরপুর ইউপির আরেক আ.লীগ নেতা বলেন, দলের লোক হোক বা যেই হোক ফটিকছড়িতে যেভাবে জমির মাটি এবং বালি তোলার মহোৎসব চলছে এসব বন্ধ হওয়া উচিৎ। এলাকার পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এদের যেভাবেই হোক দমাতে হবে।

কৃষি বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিতভাবে মাটি কাটায় পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে, ফসলি জমি হারাচ্ছে ঊর্বর শক্তি।

ফসলি জমির উপরিভাগের গুরুত্ব প্রসঙ্গে উপজেলা কৃষি অফিসার মো: হাসানুজ্জামান বলেন, কৃষিকাজের জন্য টপ সয়েল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি দীর্ঘদিন ধরে প্রাকৃতিকভাবে ও জৈব ব্যবস্থাপনার ফলে মাটির ওপরের ৮১০ ইঞ্চি জমির প্রাণশক্তিতে পরিণত হয়। এ টপ সয়েল সরিয়ে নিলে মাটির গুণাবলী নষ্ট হয়ে যায়। এর ফলে যে মাটি জমিতে থাকে তা ফসল ফলানোর জন্য উপযুক্ত থাকে না।

তিনি বলেন, টপ সয়েল কাটার ফলে জমির যে ক্ষতি হবে তা ১০০ বছরেরও পূরণ করা সম্ভব নয়। মাটিতে যে জৈব পদার্থ প্রয়োগ করা হয় বা প্রাকৃতিকভাবে যে জৈব পদার্থ যুক্ত হয় তা ধীরে ধীরে হয়। একবার তা কেটে নিলে জমির প্রাণশক্তি ফিরে পেতে দীর্ঘকাল প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে, হালদার চর সোনার চেয়ে খাঁটি। এ মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া সত্যিই অমানবিক।

এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক বলেন, আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। কিন্তু এতবড় ফটিকছড়িতে সবাই সহযোগিতা না করলে আমার সারাদিন অভিযানই করতে হবে অফিস করা যাবে না। স্থানীয় মেম্বার চেয়ারম্যানদের এত করে বলার পরেও তারা আমাদের কোনো ধরনের সহযোগিতা করছেন না। এলাকার মানুষ কষ্ট পাচ্ছে।

এ ব্যাপারে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা নদী গবেষণা পরীক্ষাগারের সমন্বয়ক অধ্যাপক ড.মঞ্জুরুল কিবরিয়া বলেন, একসময় হালদা নদীতে ১৭টি বালু মহাল ছিল। ২০১৭ সালে যখন ডলফিন এবং মা মাছ মারা যাচ্ছিল সবগুলো বালুর ইজারা সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা সব সময় হালদা রক্ষার জন্য উপর মহলে বলে যাচ্ছি। রাউজান ও রাঙ্গুনিয়ায় হালদাকে পুরো রক্ষা করা গেলেও ফটিকছড়িতে তা এখনো করা যাচ্ছে না। আগামী বিভাগীয় প্রশাসনিক সভায় বিষয়টি আমি আবারো উপস্থাপন করবো।

জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম জেলা অফিসের সহকারী পরিচালক নূর হোসেন সজীব বলেন, পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। যেখানেই খবর পাব আমাদের অভিযান চলবে।

এদিকে ফটিকছড়ি পৌরসভার উত্তর রাঙ্গামাটিয়া এলাকায় নিজস্ব কৃষি জমি থেকে মাটি কেটে নিয়ে গেছে বলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন জমির মালিক রফিকুল আলম, মোহাম্মদ শফিউল আজম ও মঈন উদ্দিন শাহজাহান। এর বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ইউএনও এসিল্যান্ডকে নির্দেশনা প্রদান করেন বলে জানা গেছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভাসানচরে গ্যাস বিস্ফোরণে দগ্ধ আরও এক রোহিঙ্গা শিশুর মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধরামুতে রাংকূট বিহার পরিদর্শনে ২৪ দেশের ৩৪ কূটনীতিক