রাতে বৃষ্টি দিনে ভোগান্তি

সড়ক ও খাল পানিতে একাকার, নালায় সিএনজি

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ২০ জুন, ২০২১ at ৫:৫২ পূর্বাহ্ণ

শুক্রবার রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা। একটানা ভারী বৃষ্টি হয়েছে নগরীতে। এ সময় ৮৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করে আবহাওয়া অধিদপ্তর। রাতের এ বৃষ্টির গতি কমে আসে গতকাল শনিবার দিনে। কিন্তু কমেনি নগরবাসীর দুর্ভোগ। কারণ রাতেই তলিয়ে গিয়েছিল শহরের নিঁচু এলাকা। যার রেশ ছিল দিনেও। গতকাল সকাল পেরিয়ে বিকেল হলেও পানিবন্দী ছিলেন অনেক এলাকার লোকজন। এমনকি সন্ধ্যার পরও পানি দেখা গেছে কয়েকটি আবাসিক এলাকায়।
এদিকে তীব্র জলজটে রাস্তা ও নালা একাকার হয়ে যাওয়ায় দুর্ঘটনাও ঘটে কয়েক জায়গায়। এর মধ্যে গতকাল সকালে চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার বি ব্লক ১২ নম্বর সড়কে একটি সিএনজি ট্যাক্সি তিন নারী যাত্রীসহ নালায় পড়ে যায়। এ সময় স্থানীয় লোকজন দ্রুত এগিয়ে এসে উদ্ধার করে যাত্রী ও চালককে। এর মধ্যে একজনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। অবশ্য প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরেন তিনি।
চালক জানিয়েছেন, পানির জন্য রাস্তা এবং নালা আলাদা করতে পারেননি। এতেই দুর্ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দ্রুত উদ্ধার করা না গেলে প্রাণহানিও ঘটতে পারতো। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত রাতেও আবাসিক এলাকাটির বিভিন্ন ব্লকে পানি জমেছিল।

আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, শুক্রবার রাত ১১টা থেকে শুরু হয় হালকা বৃষ্টি। রাত বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে বৃষ্টির গতিও। যা একটানা ভোর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এরপর থেমে থেমে ১২টা পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে। পরে বিকেলে আবারও বৃষ্টি শুরু হয়। সন্ধ্যায়ও থেমে থেমে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হয়েছে। তবে রাতের ভারী বৃষ্টি হয়ে ওঠে দুর্ভোগের প্রধান কারণ। কোথাও হাঁটু এবং কোথাও তার চেয়ে বেশি পানিতে নগরবাসীর দুর্ভোগ হয়ে ওঠে অসহনীয়। রাস্তাঘাট তো ডুবেছে। চকবাজার-বাঁদুরতলাসহ বিভিন্ন বাসা-বাড়ির নিচতলায় পানি ঢুকে যায়। রাস্তাঘাট ডুবে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে আটকা পড়ে গণপরিবহন। এতে সকালে কর্মস্থলমুখী মানুষের দুর্ভোগ ছিল অসহনীয়। অবশ্য গতকাল সরকারি অফিস-আদালত বন্ধ থাকায় কর্মস্থলমুখী মানুষের চাপ অন্যদিনের তুলনায় কম ছিল।
পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিস সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ১৩৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়। এর আগে দুপুর ১২টা পর্যন্ত সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড করা হয় ১৪০ দশমিক ৩ মিলিমিটার। এদিকে শুক্রবার রাত ১২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ৩ ঘণ্টায় রেকর্ড করা হয় ৫০ দশমিক ৫ মিলিমিটার। গতকাল দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ৬ ঘণ্টায় ৩১ মিলিমিটার রেকর্ড করা হয়।
এদিকে আজও বৃষ্টি হতে পারে বলে জানিয়েছেন পতেঙ্গা আবহাওয়া অফিসের পূর্বাভাস কর্মকর্তা ও আবহাওয়াবিদ সেখ ফরিদ আহমেদ। তিনি বলেন, আজ আকাশ মেঘলা থেকে মেঘাচ্ছন্ন থাকতে পারে। সেই সাথে অধিকাংশ জায়গায় অস্থায়ী দমকা বাতাসের সাথে মাঝারি থেকে ভারী এবং কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতিভারী বর্ষণ হতে পারে। ভারী বর্ষণের ফলে পাহাড়ি এলাকায় ভূমি ধসের আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত ও দিনের তাপমাত্রা সামান্য বাড়তে পারে। পাশাপাশি দক্ষিণ অথবা দক্ষিণ-পশ্চিম দিক হতে ঘণ্টায় ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার বেগে দমকা হাওয়ার আকারে ৪৫ থেকে ৬০ কি.মি. পর্যন্ত বাতাসের গতিবেগ বৃদ্ধি পেতে পারে।
এদিকে গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে, মানুষের দুর্ভোগ।
বহদ্দারহাট থেকে মুরাদপুর, ২ নং গেইট থেকে জিইসি হয়ে ওয়াসা পর্যন্ত প্রধান সড়কেও হাঁটু থেকে কোমর পানি দেখা গেছে। শুলকবহর ফ্লাইওভারের মুখে রাতে বেশি থাকলেও দিনে হাঁটুর উপর পানি ছিল। শুলকবহরের নিঁচু অংশে বিভিন্ন বাসা-বাড়ির নিচ তলায় পানি ঢুকে গেছে। ২ নং গেইট, মুরাদপুর মোহম্মদপুর রোডও তলিয়ে যায় পানির নিচে। ১২টার দিকে বহদ্দারহাট-জিইসি-ওয়াসা পর্যন্ত প্রধান সড়কে পানি কমে যায়। তবে ওই সময় মোহম্মদপুরসহ আশেপাশের সড়ক পানির নিচে ছিল।
ষোলশহর, কাপাসগোলা, চকবাজার বাদুরতলা, আবদুল হামিদ লেইন, চাক্তাই, বাকলিয়া, ডিসি রোড, রহমতগঞ্জ, হালিশহর, চান্দগাঁওয়ের বিভিন্ন এলাকা, দক্ষিণ কাট্টলী ও কাতালগঞ্জ, চকবাজার জেলে পাড়া, মুহাম্মদ আলি শাহ দরগাহ লেইন, ডিসি রোড, ঘাসিয়ার পাড়া, ফুলতলা, কে বি আমান আলী রোড, ঝর্ণাপাড়া ও রসুলবাগ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। আগ্রাবাদ, সিডিএ আবাসিক, কমার্স কলেজ রোড, হালিশহর ও প্রবর্তক মোড়েও তীব্র জলাবদ্ধতা হয়েছে।
ঘুরে দেখা গেছে, হাঁটুর উপর পানি ছিল বহদ্দারহাট মোড়ে। বহদ্দারহাট থেকে কাপাসগোলা হয়ে চকবাজার পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে পানি দেখা গেছে। সেখানে কোথাও হাঁটু পর্যন্ত, কোথাও বেশি পানি দেখা গেছে। চকবাজার কাঁচাবাজারের সামনেও ছিল পানি। কাঁচাবাজার থেকে রাহাত্তারপুল সড়কও হাঁটু সমান পানি। আলকরণ ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায়ও বাসা-বাড়িতে পানি ঢুকেছে।
এদিকে আগ্রাবাদ মা ও শিশু হাসপাতালের নিচ তলায় পানি প্রবেশ করে। এতে চিকিৎসা নিতে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। নিচতলায় থাকা একটি ওয়ার্ড সাময়িকভাবে দ্বিতীয় তলায় স্থানান্তর করা হয়।
এদিকে সড়কে পানি থাকায় বিভিন্ন গণপরিবহন ও প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার করে আক্তারুজ্জামান ফ্লাইওভার। কিন্তু শুলকবহর ফ্লাইওভার থেকে নামার মুখে প্রায় কোমর সমান পানি ছিল। তাই গাড়িগুলো এগুতে পারেনি। তাই প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ফ্লাইওভারে আটকে ছিল বিভিন্ন যানবাহন।
এদিকে খতিবের হাট, মৎস্যপুকুর পাড়, সুন্নিয়া মাদ্রাসা, লিভার সোসাইটি, দাম্মপুকুর পাড়, নাপিত পাড়ায় হাঁটু সমান পানি দেখা গেছে দুপুরের পর। এ বিষয়ে ষোলশহর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোবারক আলী তার ওয়ার্ডের বিভিন্ন স্থানের জলাবদ্ধতার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করে লিখেন, ‘একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে এই ভিডিও ও ছবিগুলো আপলোড করা অত্যন্ত কষ্টের ও অপমানজনক। সত্যটা গোপন করে নিজেকে সফল দাবি করে জনগণের সাথে প্রতারণা করা আমার দ্বারা অসম্ভব, তবে আমি ব্যর্থ নই। বারংবার বলার পর ও ত্রিপুরা খালের উপর স্থাপিত বাঁধ খুলে না দেওয়ায় পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডের বিশাল এলাকা জলমগ্ন হয়ে পড়েছে’।
তিনি বলেন, ছোট নালাগুলো সম্পূর্ণভাবে পরিস্কার করার পরেও শুধুমাত্র ত্রিপুরা খালের বাঁধের জন্যই পশ্চিম ষোলশহর ওয়ার্ডের মানুষ জলাবদ্ধতার কবলে রয়েছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জলাবদ্ধতা নিরসন মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান থাকলেও বর্ষার সময় যেহেতু বিকল্প কোন ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ নেই অনতিবিলম্বে সকল খালের বাঁধ খুলে দেওয়া না হলে সমগ্র চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকায় নতুন নতুন এলাকা জলাবদ্ধতার শিকার হবে নি:সন্দেহে।
জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মোহাম্মদ শাহ আলী আজাদী বলেন, বৃষ্টি বন্ধ হওয়ার পর পানি দ্রুত নেমে যায়। আমাদের বাঁধগুলো কিন্তু আমরা কেটে দিয়েছি। এরপর পানি জমে থাকার জন্য কারণ খুঁজতে গিয়ে কিছু জায়গায় প্রতিবন্ধকতা আমরা চিহ্নিত করেছি। সেখানে আমাদের চারটি ইর্মাজেন্সি রেসপন্স টিম কাজ করে। তিনি বলেন, ডোমখালী খালে সিটি কর্পোরেশন একটি ব্রিজ করছে। সেজন্য তারা বাঁধ দিয়েছে। শমসের পাড়ায় সিডিএ ব্রিজ করার জন্য বাইপাস করে। স্টো কেটে দিয়েছি। নোয়াখালের মুখে রেলওয়ে একটা ব্রিজ করছে। সেজন্য দেয়া বাঁধটি আমরা কেটে দিয়েছি।
চান্দগাঁও আবাসিক এলাকার জলাবদ্ধতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেখানে ইর্ন্টানাল ড্রেনের কানেকটিভিটি নাই। সেটা আমরা ঠিক করে দিতে পারবো। কিন্তু ইন্টার্নাল ড্রেনগুলো পরিষ্কার করতে হবে সিটি কর্পোরেশনকে। ফুলতলা ও রসুলবাগেও সিটি কর্পোশেনের কালভার্টের কারণে সমস্যা হয়েছে। বাকলিয়া তক্তার পুল এলাকায় ব্রিজ করছে সিটি কর্পোরশেন। সেখানে বাঁধের জন্য পুরো এলাকায় পানি ওঠে গেছে। স্থানীয় সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর বিষয়টি আমাকে জানিয়েছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ২৪ ঘণ্টায় ৬৭ মৃত্যু, দেড় মাসে সর্বাধিক
পরবর্তী নিবন্ধসভাপতি পদে ৪২ সাধারণ সম্পাদকে ৩৩ প্রার্থী