আগামী ৭ জানুয়ারি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের যে তারিখ রেখেছে নির্বাচন কমিশন, সেই ভোটের মধ্য দিয়েই নতুন সরকার গঠন হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নির্বাচনী বিভিন্ন আইন সংস্কার, সেই সঙ্গে নির্বাচন কমিশন গঠনে আইন করার কথা তুলে ধরে তিনি বলেছেন, আমাদের সবসময় লক্ষ্য ছিল জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। ভোটের মধ্য দিয়েই সরকার গঠন হবে; অস্ত্র হাতে না, রাতের অন্ধকারে না। ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’ এ স্লোগান দিয়ে মানুষকে আমরা ভোট নিয়ে সচেতন করি। ভোট ও ভাতের অধিকার আদায়ে সংগ্রাম করি। যে ক্ষমতা সেনানিবাসে বন্দি ছিল, সেটা জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিই আমরা। গতকাল শুক্রবার তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে দলের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভায় সভাপতির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। ভোটে অংশ নিতে সরকার বিরোধীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যারা অপরাধ করেছেন, বিশেষ করে বিএনপি–জামায়াত, জনগণকে অগ্নিসন্ত্রাসে হত্যা, জানমালে ক্ষতি করেছেন, সেজন্য জাতির কাছে মাফ চেয়ে নির্বাচনে আসেন। সেটাই আমরা চাই। নির্বাচনের দরজা সকলের জন্য উন্মুক্ত। খবর বিডিনিউজের।
টানা তিন মেয়াদে সরকার পরিচালনার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের উন্নয়নের পরিকল্পনা তৃণমূলের মানুষকে লক্ষ্য রেখেই করা। শুধুমাত্র মুষ্টিমেয় লোক লাভবান হবে, যা ক্ষমতায় আসলে স্বৈরশাসকরা করত, ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে কিছু এলিট শ্রেণি তৈরি করত, হাতে সমস্ত ব্যবসা–বাণিজ্য, ধন–সম্পদ তুলে দিয়ে তাদেরকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করত। আমাদের সেটা ছিল না। আমাদের ছিল জনগণের ক্ষমতার ক্ষমতায়ন; তৃণমূলের মানুষ যাতে ক্ষমতা পায় তা করা।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আমরা সারা বাংলাদেশে সংগঠনগুলোকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেছি। মানুষের মধ্যে আস্থা–বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি। একটা দল টানা দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পর মানুষের বিশ্বাস–আস্থা অর্জন করা কঠিন। আমরা পরিকল্পিতভাবে দেশের উন্নয়ন করেছি। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকায় দেশের উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, এ ১৪ বছরে বাংলাদেশে বিরাট পরিবর্তন আমরা আনতে পেরেছি। আজকে মানুষকে বিদেশি পুরান কাপড় এনে পরাতে হয় না। দেশের মানুষকে খাদ্যের জন্য হাহাকার করতে হয় না।
অতি বাম ও অতি ডানপন্থিরা একাকার : ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলার ঘটনায় সরকারের প্রতিবাদ জানানোর কথাও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, দুর্ভাগ্য হলো যারা অগ্নিসন্ত্রাস করে মানুষকে পুড়িয়ে মারে, যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে; সেসব দলের কাছে কোনো আওয়াজই পাচ্ছি না, কিছুই বলছে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে অতি বামপন্থি ও অতি ডানপন্থিরা সব একাকার হয়ে মিলে গেছে। কে যে কার আদর্শ বিচ্যুত হলো, সেটাই প্রশ্ন। অতি বামদের আদর্শ নেই, তারা বলে। এখন আমাদের সরকারকে উৎখাত করতে হবে। আমাদের অপরাধটা কী? আর নির্বাচন বানচাল করতে হবে। তার মানে হলো যারা রাতের অন্ধকারে অস্ত্র হাতে নিয়ে ক্ষমতা দখল করে, তারপর নিজেদের রাজনৈতিক নেতা বানানো, নির্বাচন নামে প্রহসন।
অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের যে ইতিহাস বাংলাদেশের আছে, সেই প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, জিয়াউর রহমান, এরশাদের ক্ষমতা দখলকে উচ্চ আদালত অবৈধ বলে রায় দিয়েছে। তাদের হাতে গড়া দলের কাছ থেকে শুনতে হয় নির্বাচন, বিএনপির আমলে যত নির্বাচন হতো মানুষ ভোটই দিতে পারেনি। ভোট চুরির অপরাধে খালেদা জিয়া পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিল। ভোট চুরি করলে এ দেশের মানুষ মেনে নেয় না। আমরা জনগণের ভোটের অধিকার জনগণের হাতে ফিরিয়ে দিয়ে তাদের সচেতন করেছি।
বিএনপি–জামায়াতের অবরোধ–হরতালের মধ্যে সম্প্রতি বিভিন্ন যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার যেসব ঘটনা ঘটেছে সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগুন নিয়ে খেলছে। বিএনপি ও তাদের জোটকে বলব, আগুন নিয়ে খেলা বাংলাদেশের মানুষ কখনো মেনে নেবে না। তারা নির্বাচন বানচাল করতে চেয়েছে। এটা তারা বানচাল করতে পারবে না। বাংলাদেশের নির্বাচন জনগণের অধিকার। জনগণ তার ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে, যাকে (ভোট) দেবে তারাই সরকার গঠন করবে। মানুষকে গণতান্ত্রিক ধারা সম্পর্কে সচেতন আমরা করেছি।
দুর্যোগ ও দুর্বিপাকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মানুষের পাশে থেকে সেবা করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা মানুষের সেবা, অধিকারটা সুনিশ্চিত করেছি বলেই তাদের আস্থা–বিশ্বাস অর্জন করেছি। আজকে সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞাসা করা হয় যে কোন দলের উপর তাদের আস্থা আছে? সেটা আওয়ামী লীগের উপরই আছে। এ আস্থা–বিশ্বাসটা ধরে রেখেই আমাদের এগুতে হবে। আজকে যারা নির্বাচন বানচালের নামে অগ্নিসন্ত্রাস শুরু করেছে, এদের কিন্তু ক্ষমা নেই। এগুলো আমরা বরদাশত করব না।
বিএনপি মুণ্ডুহীন দল হয়ে গেছে : নির্বাচন বানচালের নামে এক দশক আগে প্রায় ৫০০ স্কুল পুড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি নির্বাচনী কর্মকর্তা, বিচারক, আইনজীবীদের ওপর হামলা হয়েছিল উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এরা মানুষকে মানুষ মনে করে না। এখন নিজেরা লুকায় থাকে। আমার কথা হচ্ছে বিএনপির নেতৃত্ব কোথায়? একজন তো এতিমের অর্থ আত্মসাৎ করে সাজাপ্রাপ্ত; বয়স হয়ে গেছে, অসুস্থ।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করে মুক্তি দেওয়ার প্রসঙ্গেও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমি খালেদা জিয়াকে বাসায় থাকার অনুমতিটা দিয়েছি, সে স্বাধীনভাবে চিকিৎসা নিচ্ছে। কোনও সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে হয়, তাহলে তাকে কোর্টে যেতে হবে। আমরা বলেছি কোর্টে গিয়ে হাজিরা দিয়ে অনুমতি নিক। সেটা না করে ওইটা নিয়ে আবার আন্দোলনের চেষ্টা করে। আসলে এরা ইস্যু হিসাবে দেখে। আদৌ যদি চিকিৎসার জন্য বাইরে পাঠাত, তাহলে বিএনপির পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নেওয়া হতো।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ছেলে তো মাকে দেখতে আসল না কোনোদিন। এত যায় যায়, মরে মরে, এত কথা শুনেও ছেলে আর আসে না। ছেলে আসবে কি? সে তো ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাকারবারি, গ্রেনেড হামলায় আমাদের নেতা আইভী রহমানসহ নেতাকর্মীদের হত্যা, অর্থপাচার, দুর্নীতি…। দুর্নীতি ও অর্থপাচারের মামলা আমাদের করা না, আমেরিকা থেকে এফবিআই এসে সাক্ষী দিয়ে গেছে। খালেদা জিয়ার নাইকো দুর্নীতি মামলায় কানাডা থেকে এসে সাক্ষী দিয়ে গেছে। এদের দুর্নীতি ও দুঃশাসন নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে তথ্য এসেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, তারেক রহমান লন্ডনে বসে হুকুম দেয়, আর এখানে যারা অগ্নিসন্ত্রাস করে তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, যে দলের নেতাই নেই, মুণ্ডুহীন দল, মাথা নাই; সে নেতা কখনোই আসবে না। আসার ইচ্ছা থাকলে চলে আসতে পারত। তার হুকুমে বাংলাদেশে যারা মানুষের ক্ষতি করে যাচ্ছে, আগুন দিয়ে পোড়াচ্ছে, জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে তাদের ক্ষতি করছে; এ দায়িত্বটা তারা নিচ্ছে কেন? তারা নির্বাচন করতে চায় না, কারণ এটা মুণ্ডুহীন একটা দল হয়ে গেছে। কারণ সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়া নির্বাচন করতে পারবে না। এজন্য তারা নির্বাচন চায় না। চায় না বলেই নির্বাচন বানচাল করতে হবে। বানচাল করে তাদের লাভটা কী হবে? বাংলাদেশের মানুষের লাভটা কী হবে? যারা এ ধরনের নেতৃত্বের হুকুমে মানুষের ক্ষতি করে; তারা তো অভিশাপ পাবে, মানুষের অভিশাপ পড়বে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে কয়টা মানুষ অগ্নিসন্ত্রাসের শিকার তারা তো অভিশাপ দিচ্ছে, তাদের পরিবার দিচ্ছে। কারণ তাদের জীবন–জীবিকা, পোড়া ঘা নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে।
যারা সাধারণ মানুষকে হত্যার পরিকল্পনা করে, তাদের কেন মানুষ ভোট দেবে–এ প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, মানুষ কেন আস্থা রাখবে? মানুষ আস্থা রাখে না। মানুষ তাদের বিশ্বাস করে না। তারা ঘাতক, ষড়যন্ত্রকারী হিসাবে চিহিৃত। নির্বাচন জনগণের সাংবিধানিক অধিকার। এটা তাদের ভোটের অধিকার। সময় এসেছে, নির্বাচন হবে, জনগণ ভোট দেবে। কারণ যদি সাহস থাকে নির্বাচন করবে, জনগণের ভোট পাওয়ার মতো শক্তি থাকলে তারা ভোট পাবে। জনগণ যাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে, সে সরকার গঠন করবে। জনগণের উপর আস্থা রাখতে না পেরে হামলা করছে। দেশবাসীকে বলব সচেতন থাকতে। প্রত্যেক এলাকায় যেখানে অগ্নিসন্ত্রাস, গাড়িতে বোমা মারছে বা পোড়াচ্ছে, ওই অঞ্চলে বিএনপি–জামায়াতের কারা করছে, খুঁজে বের করতে হবে।
পাহারা দিয়ে অপরাধীদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বানও জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, জনগণ প্রতিরোধ করলে এরা সাহস পাবে না। যে পোড়াবে, তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এবার আর কোনো ছাড়াছাড়ি নেই।
মনোনয়ন যিনি পাবেন, তিনিই নির্বাচন করবেন : আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করবে বলে জানান শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, যাদের মনোনয়ন দেওয়া হবে, তারাই নির্বাচন করবে। জনগণের ভোট পাব–এই আশা আমার আছে। এ বিশ্বাস জনগণের উপর আছে। তা না হলে ১৪ বছরে যে উন্নতিটা করেছি, আজকে যে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ, এটাকে ওরা আগুন দিয়ে ধ্বংস করবে, পোড়াবে। কাজেই পোড়াতে বা ধ্বংস করতে না পারে সেদিকেও জনগণকে সচেতন থাকতে হবে।
জনগণের ভোটের অধিকার নিয়ে কেউ যেন ছিনিমিনি খেলতে না পারে, স্বাধীনভাবে জনগণ ভোট দিতে পারে, সেই পরিবেশ সৃষ্টির আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তফসিল ঘোষণার জন্য নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
শেখ হাসিনা মনোনয়ন ফরম কিনবেন আজ : আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দলীয় মনোনয়ন ফরম কিনতে আজ শনিবার সকালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাবেন দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা। গতকাল শুক্রবার এ তথ্য জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক রিয়াজ উদ্দিন। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় মনোনয়ন ফরম আগামীকাল (আজ) সকালে সংগ্রহ করবেন। তিনি ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে মনোনয়ন ফরম কিনবেন। সকালে প্রথম ফরমটি তিনিই সংগ্রহ করবেন।