রাজা তৃতীয় চার্লসের রাজ্যাভিষেক আজ

| শনিবার , ৬ মে, ২০২৩ at ৫:০৯ পূর্বাহ্ণ

গত বছর সেপ্টেম্বরে ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে যুবরাজ চার্লস উত্তরাধিকার হিসেবে তাৎক্ষণিকভাবে রাজা তৃতীয় চার্লস হিসেবে পরিচিত হন। রাজা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও রাজ্যাভিষেকের আনুষ্ঠানিকতা সে সময় হয়নি। কয়েক মাসের বিস্তারিত প্রস্তুতি শেষে এখন সময় হয়েছে তৃতীয় চার্লসকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজমুকুট পরিয়ে ব্রিটেনের রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করার। বিবিসি জানাচ্ছে, শনিবার ধর্মীয় অনুশাসন আর ব্রিটিশ কেতা মেনে লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে অভ্যাগত ও রাজপারিষদদের সামনে ব্রিটেনের রাজা হিসেবে আনুষ্ঠানিক অভিষেক হবে তৃতীয় চার্লসের। তিনি হবেন বৃটেনের ৪০তম রাজা। গত ৭০ বছর ধরে ব্রিটেনের রাজমুকুটের উত্তরাধিকারী হিসেবে জীবন কাটিয়ে অবশেষে মুকুট পরতে চলেছেন চার্লস। এই অভিষেক অনুষ্ঠান উপলক্ষে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে কয়েক হাজার অতিথির পাশাপাশি আশপাশে সেন্ট্রাল লন্ডনের রাস্তাগুলোতে উপস্থিত থাকবেন প্রজারা। খবর বিডিনিউজের।

ব্রিটিশ রাজার কাজ আসলে কী?

এক সময় দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হলেও ইংল্যান্ড হোক, গ্রেট ব্রিটেন হোক কিংবা যুক্তরাজ্য হোক, এখন রাজার পদটি কেবলই আলঙ্কারিক। রাজা যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্রপ্রধান হলেও তার বেশিরভাগ ক্ষমতাই আসলে প্রতীকী, আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ।

ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে প্রতিদিন রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রাজার কাছে একটি লাল চামড়ায় মোড়া বাঙে দৈনন্দিন কাজের ফিরিস্তি ও নথিপত্র আসে, যার মধ্যে থাকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সভার সারসংক্ষেপ, অথবা তার স্বাক্ষরের জন্য পাঠানো নথি। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী সাধারণত প্রতি সপ্তাহের বুধবার বাকিংহ্যাম প্রাসাদে রাজার সঙ্গে দেখা করতে যান এবং সরকারের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তাকে জানান। এই বৈঠকগুলো পুরোপুরি ব্যক্তিগত এবং এসব বৈঠকের কোনো আনুষ্ঠানিক রেকর্ড রাখা হয় না। এছাড়া পার্লামেন্টের জন্য কিছু আনুষ্ঠানিক ভূমিকা পালন করতে হয় রাজাকে।

রাজ্যাভিষেক কী?

প্রাচীনকাল থেকে রাজ্যাভিষেক একটি রীতি হিসেবে বিভিন্ন দেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে। সাধারণভাবে এটা নতুন রাজা বা রানির সিংহাসনে আরোহন উপলক্ষে প্রজাদের জন্য একটি আনন্দ উদযাপনের দিন এবং একইসঙ্গে বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে দিয়ে রাজাকে প্রজাদের শাসক ও দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা, যা বিভিন্ন ধর্মীয় আচারঅনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন করা হয়।

রাজ্যাভিষেক বা সিংহাসনে আরোহন যেহেতু সাধারণভাবে আনন্দ উদযাপনের ঘটনা, আর আগের রাজা বা রানির মৃত্যুর পর রাজ পরিবার ও প্রজারা যেহেতু কিছু সময় শোক পালন করেন। তাই কিছুটা বিরতি দিয়ে আয়োজন করা হয় রাজ্যাভিষেকের এই আনুষ্ঠানিকতা।

রানী দ্বিতীয় এলিবেথের মৃত্যুর পরপরই উত্তরাধিকার সূত্রে ব্রিটেনের রাজা হয়েছেন তৃতীয় চার্লস। স্বাভাবিকভাবেই সেটা ছিল রাজ পরিবার এবং দেশের জন্য শোকের সময়। ব্রিটেন সর্বোচ্চ সময় ধরে সিংহাসনে থাকা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী শাসককে বিদায় জানিয়েছে।

আট মাস পরে এখন সময় বদলেছে, রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানও তাই ভিন্ন আমেজ বয়ে আনবে। নতুন রাজাকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানানোর এখনই সময়। প্রজারা নতুন রাজার অভিষেক উদযাপন করবে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অতিথিরা আসবেন এই জাঁকজমকপূর্ণ রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এবং কোটি কোটি মানুষ সরাসরি এই রাজ্যাভিষেকের আনুষ্ঠানিকতা দেখবে।

সাত দশক আগে যখন রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের রাজ্যাভিষেক হয়েছিল, তা ছিল এক এলাহি ঘটনা। তবে সিএনএন বলছে, ব্রিটেনে নতুন শতকের প্রথম এই রাজ্যাভিষেকের আনুষ্ঠানিকতা আগেরটির চেয়ে সংক্ষিপ্ত হবে। গত শতাব্দীতে টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচারিত প্রথম রাজ্যাভিষেকের আনুষ্ঠানিকতা তিন ঘণ্টার বেশি সময় ধরে চলেছিল। বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, এবার দুই ঘণ্টার মধ্যেই সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে ফেলা হবে।

রাজ্যাভিষেকে আসলে কী হবে?

শুধু ইংল্যান্ডের ক্যান্টরবুরির আর্চবিশপই ব্রিটেনের রাজা বা রানির অভিষেকের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার অধিকার রাখেন। সে অনুযায়ী বর্তমান আর্চবিশপ জাস্টিন ওয়েলবি এ আনুষ্ঠানিকতা পরিচালনা করবেন। ধর্মীয় এই আচারঅনুষ্ঠান কয়েকটি ধাপে বিভক্ত, যার মধ্যে আছে স্বীকৃতি, শপথ, পবিত্র তেলে সিক্ত করা, সিংহাসনে আরোহন, রাজমুকুট পরিয়ে দেওয়া ও সংবর্ধনা বা রাজার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন। এরপর রাজাকে স্বীকৃতি দানের পালা। এবার শুধু প্রিন্স উইলিয়ামই একমাত্র রয়্যাল ডিউক হিসেবে হাঁটু গেড়ে সম্মান প্রদর্শন করবেন।

এসব আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাজা ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবির থিয়েটারে গিয়ে দাঁড়াবেন এবং জনগণের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করবেন। এবারই প্রথম স্বজনদের পরিবর্তে আর্চবিশপ অব ক্যান্টরবুরি অতিথিদের অ্যাবিতে আমন্ত্রণ জানাবেন।

এর আগে করোনেশনের শপথ হবে, আইন অনুযায়ী দেশ শাসন, দয়া ও ক্ষমার মাধ্যমে বিচার করা এবং চার্চ অব ইংল্যান্ডকে সমুন্নত রাখার শপথ নেবেন রাজা। শপথের পর আর্চবিশপ রাজাকে পবিত্র তেলে সিক্ত করবেন। এই পবিত্র তেলে সিক্ত করার মুহূর্তটিকে রাজ্যাভিষেকের সবচেয়ে পবিত্র মুহূর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

কোন রাজমুকুট ব্যবহার করবেন রাজা?

রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকটি উপকরণ যেমন রাজমুকুট, রাজ গোলক, রাজদণ্ড, আংটি ও অন্যান্য পবিত্র ও প্রতীকি অলংকারে রাজাকে ভূষিত করা হয়। এরমধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণটি হচ্ছে সেইন্ট এডওয়ার্ডের রাজমুকুট। এটা অভিষেকের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় থাকে, কারণ অভিষেকের মুহূর্তে এই রাজমুকুটটি পরিয়ে দেওয়া হয়। ১৬৬১ সালে রাজা দ্বিতীয় চার্লসের অভিষেক উপলক্ষে এ মুকুটটি গড়া হয়। ধারণা করা হয়, ১১ শতকের ইংল্যান্ডের রাজা এডওয়ার্ড দ্য কনফেসরের শাসনামলে বানানো হয়েছিল এ মুকুট, যা ১৬৪৯ সালে গলিয়ে ফেলা হয়েছিল।

সোনায় গড়া এই রাজমুকুট বেগুনি মখমলের টুপি ও আরমাইন ব্যান্ডে দিয়ে সজ্জিত। তাতে খচিত আছে ৪৪৪টি মূল্যবান পাথর, যার মধ্যে আছে পান্না, নীলা, নীলকান্ত মনির মত রত্ন। ঐতিহাসিকভাবে, এই রাজমুকুট ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতেই রক্ষিত থাকে, তাই দ্বিতীয় একটি রাজমুকুট গড়া হয় যা রাজা অ্যাবির বাইরে পরতে পারেন।

দ্বিতীয় এই রাজমুকুটের নাম ইমপেরিয়াল স্টেট ক্রাউন, যা সাধারণত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে রাজা পরেন, যেমন ব্রিটেনের পার্লামেন্টের স্টেট ওপেনিং অনুষ্ঠানে। এই মুকুটেও দ্যুতিময় ২ হাজার ৮৬৮টি হীরা রয়েছে, যার মধ্যে আছে বিশাল আকৃতির কালিনান টু হীরা। ১৯৩৭ সালে এই মুকুটটি গড়া হয়, যা এরআগে রানি ভিক্টোরিয়ার পরা ইমপেরিয়াল স্টেট ক্রাউনেরই একটি প্রতিরূপ। এই মুকুটে যে খিলানগুলো রয়েছে, তা প্রকাশ করছে যে ইংল্যান্ড কোনো পার্থিব শক্তির অধীন নয়।

রাজ শোভাযাত্রা

এটি একটি রাজকীয় উদযাপন। মূলত দুটি শোভাযাত্রা হবে। প্রথমটি হবে যখন রাজা বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে বের হয়ে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে যাবেন এবং দ্বিতীয় ও আরও বড় শোভাযাত্রাটি হবে যখন তিনি রাজ্যাভিষেকের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে আবার প্রসাদে ফিরবেন। এ সময় রাজা ও রাজপরিবারের সদস্যরা প্রাসাদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রজাদের উদ্দেশে হাত নাড়বেন।

বাকিংহাম প্রাসাদে ফ্লাইপাস্ট

রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের রাজ্যাভিষেকের সময় ১৯০২ সাল থেকে এটা এক ধরনের রীতি হিসেবে প্রচলিত হয়ে গেছে যে বাকিংহাম প্রাসাদের সামনে মলে উপস্থিত জনগণকে প্রাসাদের বারান্দা থেকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাবেন সদ্য অভিষিক্ত রাজা বা রানি। ১৯৫৩ সালে অভিষেকের দিনে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তার মা ও স্বামীসন্তানপরিজনদের নিয়ে বারান্দায় উপস্থিত ছিলেন এবং সামরিক বিমানের ফ্লাইপাস্ট উপভোগ করেন। বাকিংহাম প্রাসাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, রাজা চার্লস এবং তার স্ত্রী ক্যামিলাও এই রীতি বজায় রাখবেন, তবে বারান্দায় তাদের সঙ্গে পরিবারের আর কোন সদস্য উপস্থিত থাকবেন, তা জানানো হয়নি। ছয় মিনিটের ফ্লাইপাস্টে সেনাবাহিনী, রয়্যাল নেভি এবং রয়্যাল এয়ার ফোর্সের সদস্যরা অংশ নেবেন।

প্রিন্স হ্যারি ও মেগান কি অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন?

ডিউক অব সাসেঙ প্রিন্স হ্যারি নিশ্চিত করেছেন, তিনি তার বাবার সবচেয়ে ঐতিহাসিক দিনটিতে উপস্থিত থাকবেন। তবে তিনি একাই আসছেন। তার স্ত্রী মেগান যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় তাদের দুই সন্তানপ্রিন্স আর্চি ও প্রিন্সেস লিলিবেটের দেখভালের জন্য থেকে যাচ্ছেন। মেগান যাচ্ছেন না, তার কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে যে রাজ্যাভিষেকের দিনটি আর্চির চতুর্থ জন্মদিনেই পড়েছে।

অতিথি হিসেবে আর কারা আমন্ত্রণ পেয়েছেন?

রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিতদের তালিকা নিয়ে জল্পনা চলছেই। রাজপ্রাসাদের পক্ষ থেকে সাধারণত আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রিতদের তালিকা প্রকাশ করা হয় না। সাধারণত আমন্ত্রিত অতিথিরা নিজেরাই তাদের আমন্ত্রণ পাওয়ার কথা প্রকাশ করেন। সিএনএন জানিয়েছে, সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র দেশগুলোর রাষ্ট্র প্রধান ও সরকার প্রধানরা আমন্ত্রণ পেয়ে থাকেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন সেদেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেবেন। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন রাজ পরিবারের সদস্যদেরও অতিথি হিসেবে লন্ডনে উপস্থিত হতে দেখা যাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘গ্রাম’ সিরিয়ালের সিএনজি টেক্সি চলছে শহরে
পরবর্তী নিবন্ধঘূর্ণিঝড়ের পর এবার মৃদু তাপপ্রবাহের আভাস