রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিধান থাকছে না ট্রাইব্যুনাল আইনে

আন্তর্জাতিক আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারবেন বাদী-বিবাদীরা, বিদেশে বসে অপরাধ করলেও আমলে নিতে পারবে ট্রাইব্যুনাল

| বৃহস্পতিবার , ২১ নভেম্বর, ২০২৪ at ৬:২৩ পূর্বাহ্ণ

সরকার পতন আন্দোলনে সংঘাতে প্রাণহানির ঘটনাকে গণহত্যা ধরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাতে আইন সংশোধনে সংগঠনের সাজার বিষয়টি অনুমোদন করেনি উপদেষ্টা পরিষদ। আইন সংশোধনের খসড়াতে রাজনৈতিক দল ও তার সহযোগী সংগঠনের অপরাধ প্রমাণ হলে ১০ বছর নিষিদ্ধের প্রস্তাব করা হলেও গতকাল বুধবার এই বিষয়টি বাদ রেখে সংশোধনী অনুমোদন হয়েছে। গতকাল বুধবার সচিবালয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৪ অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে সন্ধ্যায় ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বৈঠকের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। খবর বিডিনিউজের।

গত ২৩ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এক আয়োজনে আইন আইন উপদেষ্টা জানান, তারা আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ এ আটটি সংশোধনী আনতে যাচ্ছেন। এর সবশেষ সংশোধনীতে কোনো রাজনৈতিক দল যদি এ আইনের অধীন কোনো অপরাধ করে তাহলে সে দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব রাখার কথা বলেন আসিফ নজরুল। দুই মাস পর উপদেষ্টা পরিষদের সিদ্ধান্ত তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা আইনের যে সংশোধন করেছিলাম সেখানে সংগঠনকে শাস্তি দেওয়ার বিধান ছিল এবং আমাদের প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছিল কোনো সংগঠনকে যদি মনে করে শাস্তি দেওয়া দরকার, তাহলে ট্রাইব্যুনাল শাস্তি দেওয়ার সুপারিশ করতে পারবে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের কাছে। আজকে আমাদের উপদেষ্টা পরিষদের আলোচনাতে বলা হয়েছে, আমরা এই বিচারকে অন্য কোনো বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত করতে চাই না। রাজনৈতিক দল বা কোনো সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্ন আসলে এই আইনকে অযথাই প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ সৃষ্টি হবে আমরা সেই সুযোগ দিতে চাই না। আমরা একদম ভদ্রভাবে, নিরপেক্ষভাবে বিচার করতে চাই, এই জন্য ওই বিধান বাতিল করা হয়েছে।

এখন সংসদ নেই বলে উপদেষ্টা পরিষদে গৃহীত সিদ্ধান্ত গেজেট আকারে প্রকাশ হলেই সেটি আইনে পরিণত হবে। সংবিধান অনুযায়ী পরবর্তী সংসদে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এটি অনুমোদন না করলে অন্তর্বর্‌তী সরকারের করা অধ্যাদেশ বাতিল হয়ে যাবে। আইন উপদেষ্টা বলেন, সরকার চাইলে প্রচলিত আইনে বিদ্যমান দল বা সংগঠন নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। জনমতের প্রতি, জনদাবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এই ধরনের (দল নিষিদ্ধ) কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ আর থাকল না সেটা না, মানে যুদ্ধাপরাধ আইনে থাকল না। কিন্তু অন্যান্য প্রচলিত আইন এ দেশে রয়েছে। রাজনৈতিক ঐকমত্য হলে বিভিন্ন আমাদের জনদাবি আসে, সেটা পরে বিবেচনা করা হবে। এটা আইনের ভেতরের অন্তর্ভুক্ত করার বিষয় না। আমরা অনুভব করেছি কোনো রাজনৈতিক দল বা অন্য কোনো সংগঠন তাদের অপরাধমূলক কার্যক্রমের জন্য যদি নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন হয়যদি নিষিদ্ধ করার দাবি উঠে, আমাদের অন্যান্য আইন রয়েছে, সেই সমস্ত আইনে নিষিদ্ধ করার বিধান আছে, সন্ত্রাস দমন আইনে রয়েছে, নির্বাচনি আইনে রয়েছে, পলিটিক্যাল পার্টি অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮ এ রয়েছে, কাজেই এখানে এই বিধান নেই।

সরকার পতন আন্দোলনে প্রাণহানির বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার বিষয়ে প্রথমে কথা বলেছিলেন আসিফ নজরুল, যে ট্রাইব্যুনাল আওয়ামী লীগ সরকার ২০১০ সালে গঠন করেছিল মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে। সরকার পতন আন্দোলনে প্রাণহানির বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ বিষয়ে প্রথম কথা বলেছিলেন আসিফ নজরুল।

সরকার পতন আন্দোলনে প্রাণহানির বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ বিষয়ে প্রথম কথা বলেছিলেন আসিফ নজরুল। এরই মধ্যে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য, দল হিসেবে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠন, এমনকি বেশ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জমা পড়েছে। অভিযোগ জমা পড়েছে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক থেকে শুরু করে বাহিনীর ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে; সব মিলিয়ে ‘গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের’অভিযোগে জমা পড়া অভিযোগের সংখ্যা ৫৬টি।

ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী, তার পরিবারের সদস্য ও দলের শীর্ষ নেতাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিচারের অংশ হিসেবে প্রসিকিউটরদের বদলে ফেলার পর নতুন তিন বিচারককে দায়িত্ব দিয়ে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসি কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদদের আইনজীবী তাজুল ইসলামকে চিফ প্রসিকিউটর করা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩ সংশোধনের উদ্যোগ কেন, সে বিষয়েও কথা বলেন আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, বিগত সরকারের আমলে এই আইনে যখন বিচার করা হয় তখন এই আইনের বিভিন্ন ত্রুটি বিচ্যুতি নিয়ে বিভিন্ন মহলে অনেক সমালোচনা করা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, দেশীয় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্টেক হোল্ডাররা বিভিন্ন ত্রুটি বিচ্যুতি তুলে ধরেছিলেন। আমরা যেহেতু চেয়েছি একটু ফেয়ার ট্রায়াল করতে ডিউ প্রসেস মেইনটেইন করতে চাই, এজন্য সেই তাগিদ থেকে আমরা সংশোধন করার উদ্যোগ নেই।

এই উদ্যোগের ক্ষেত্রে যতটা ব্যাপক সম্ভব মানুষের মতামত নেওয়া হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, আমরা একটা আলোচনা করেছিলাম সেখানে আমাদের দুই উপদেষ্টা হাসান আরিফ ও আদিলুর রহমান খান ছিলেন। দেশের যত আইন বিশেষজ্ঞ আছেন, মানবাধিকার কর্মী আছেন, সাংবাদিক আছেন, আমরা ৫০৬০ জনকে আমন্ত্রণ করেছিলাম, তারা এসেছিলেন। তাদের মতামত আমরা গ্রহণ করেছি খসড়ার উপর। দেশি, বিদেশি প্রসিদ্ধ আইনজীবী এবং মানবাধিকার নিয়ে কাজ করে সেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে (খসড়া) পাঠিয়েছি, জাতিসংঘের যে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান আছে সেখানে পাঠিয়েছি। সব মতামতের উপর ভিত্তি করে খসড়া তৈরি করেছি। আজকে সেই খসড়া উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে মতামতের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছিল, তা গৃহীত হয়েছে।

উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদন পাওয়ার পর আইনে কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে মন্তব্য করে আসিফ নজরুল বলেন, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সংজ্ঞা, গণহত্যার সংজ্ঞা, এটি রোম স্ট্যাটিউট অবলম্বনে করেছি, যাতে বাংলাদেশ পক্ষরাষ্ট্র হয়েছে। একদম আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে আমরা সংজ্ঞায়িত করেছি। এই আইনে অভিযুক্ত যে পক্ষ আছে তাদেরকে বিচারে সমান সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ১৯৭৩ সালের আইনের তুলনায় অভিযুক্ত পক্ষকে অনেক বেশি অধিকার দেওয়া হয়েছে। তারা যে কোনো প্রয়োজনীয় সংখ্যক সাক্ষ্য আনতে পারবেন, যে কোনো সাক্ষ্যের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবেন। এই আইনে বিদেশি আইনজীবী নিয়োগের বিধান আছে, পর্যবেক্ষকের বিধান আছে। আন্তর্জাতিক বা দেশীয় মানবাধিকার সংগঠন যেই চায়এই বিচার শুদ্ধভাবে, গ্রহণযোগ্যভাবে হচ্ছে কি না, উনারা উপস্থিত থেকে পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।

আপিলের সুযোগ আরও বাড়ানো হয়েছে জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিচার শেষ হওয়ার আগেই কোনো পক্ষ যদি প্রশ্ন উত্থাপন করে যে এই আদালতে চলতে পারে কি না বা এই আদালত যদি কারও বিরুদ্ধে অবমাননার অভিযোগ আনে, দুইটা ক্ষেত্রে তারা অন্তর্বর্তী প্রতিকার পাওয়ার জন্য আপিল বিভাগে যেতে পারবে। আইনে ভিকটিম প্রটেকশনের ব্যবস্থা করা হয়েছে জানিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, আরও একটি চমৎকার বিষয় বলে আমরা মনে করি। এই আইনের আরেকটা বিধান করা হয়েছে যে ট্রাইব্যুনাল ইচ্ছা করলে বিচারকার্য অডিও ভিজ্যুয়াল রেকর্ডিং করতে পারবেন। তারা যদি মনে করেন যে এটা প্রচার করা দরকার, এর কোনো অংশ প্রচার করা দরকার, সেটা প্রচার করবে। কিন্তু এখানে পক্ষগুলো আছে তাদের যে মর্যাদা তাদের যে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা, তাদের যে অধিকার, সেটার দিকে নজর রেখে করা হবে।

তিন ধরনের প্রতিষ্ঠানের তিন ধরনের বাহিনীকে বিচারের আওতায় আনার বিধান করা হয়েছে জানিয়ে আসিফ নজরুল বলেন, একটি শৃঙ্খলা বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, আরেকটি হল সহযোগী বাহিনী। সাজা হিসেবে মৃত্যুদণ্ড রাখা নিয়ে এক প্রশ্নে আইন উপদেষ্টা বলেন, আমাদের দেশের আইনে শত শত বছর ধরে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে, আমরা কোনো নতুন বিধান করি নাই। আমাদের দণ্ডবিধিতে বহু অপরাধের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে এবং আমরা মৃত্যুদণ্ড বিলোপ সম্পর্কিত যে আন্তর্জাতিক চুক্তি আছে, প্রটোকল আছে, সেটা পর্যন্ত আমরা অনুমোদন করি নাই। কাজেই মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত করার মত কোনো আইনগত বাধ্যবাধকতা বা আমাদের আইনগত যে সংস্কৃতি, সেই সংস্কৃতির সঙ্গেও এই ধরনের দাবি সঙ্গতিপূর্ণ না।

আন্তর্জাতিক ফোরামগুলোতে এই বিষয়টি সরকার পরিষ্কারভাবে বলেছে বলেও জানান আসিফ নজরুল। সংবাদ সম্মেলনে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, মাহফুজ আলম ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআজ সেনাকুঞ্জে যাচ্ছেন খালেদা জিয়া
পরবর্তী নিবন্ধশিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়ক শিক্ষাব্যবস্থা দরকার : ড. ইউনূস